বর্তমান পৃথিবীতে বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত বিষয় গুলোর মধ্যে একটি হল সমকামীতা। সমকামীতা হল একই লিঙ্গের অন্য কোন সদস্যের প্রতি যৌন আবেগ ও সম্পর্ক থাকা। প্রায় প্রতিটি সমাজেই সমকামীদের খারাপ চোখে দেখা হয়। এমনকি তাদের সভ্য সমাজের অংশ হিসেবেও অস্বীকার করা হয়। কিন্তু এতকিছুর পরেও সমকামীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।
তবে সমাজ আর জায়গা না দিয়ে যাবে কোথায়। মানবাধিকারের নীতিতে জেন্ডার ইকুয়ালিটি সেকশনের আন্ডারে তারাও সম্মান ও সকল সুযোগ সুবিধা পাওয়ার দাবিদার। ফলাফল হিসেবে বহু দেশ সমলিঙ্গ বিবাহকে বৈধ ঘোষণা করেছে।
সমলিঙ্গের প্রতি যৌন আবেগ থাকাটা প্রচলিত স্বাভাবিক আবেগের ব্যাতিক্রম। তবে কেনো মানুষের মাঝে এই আবেগের জন্ম নিচ্ছে? আর সমাজের এত প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও এর অনুসারী কেনো এতো বৃদ্ধি পাচ্ছে?
সব প্রশ্নের উত্তরই জানবো। তবে তার আগে জেনে নিতে হবে কিছু গুরুত্বপূরর্ণ বিষয়। সবার আগে জেনে নিতে সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন সম্পর্কে।
সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন বলতে আমরা সকলেই প্রাথমিকভাবে মানুষের লিঙ্গকে বুঝে থাকি। কিন্তু আসলে তা না। মানুষের লিঙ্গের ধরণ বোঝাকে বলা হয় জেন্ডার আইডেন্টিটি। আর একজন মানুষের যৌন আবেগ কোন লিঙ্গের প্রতি সক্রিয় সেটাকে বলে সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন।
সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন অনেক ধরণের হয়।
- হেটারোসেক্সুয়াল
মানব সমাজের স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক হচ্ছে হেটারোসেক্সুয়াল রিলেশনশিপ। অর্থ্যাৎ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষন।
গে বা হোমোসেক্সুয়ালঃ
যাদের নিয়ে আজকের আলোচনা। সমলিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষনই হল হোমোসেক্সুয়াল। পুরুষ হোমোসেক্সুয়ালদের গে এবনং নারীদের লেসবিয়ান বলা হয়।


- বাইসেক্সুয়ালঃ
কিছু মানুষ থাকে যাদের নারী পুরুষ উভয়ের প্রতি যৌন আবেগ থাকে। এবং উভয়ের সাথেই তারা যৌন সম্পর্কে থাকে। এদের বলা হয় বাইসেক্সুয়াল।
- কুইয়ার বা প্যানসেক্সুয়াল
কিছু মানুষ আছে যাদের জীবনের একেক পর্যায়ে এসে একেক ধরণের মানুষের প্রতি ( ট্রান্সজেন্ডার, নারী, পুরুষ ) যৌন আবেগ জন্মায়। তাদের বলা হয় প্যানসেক্সুয়াল বা কুইয়ার।
- আসেক্সুয়াল
যারা কারোর প্রতিই যৌন আবেগ অনুধাবন করে না তাদের বলা হয় আসেক্সুয়াল।
- কিউরিয়াস
যারা বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পরেও নিশ্চিত হতে পারে না যে ঠিক কাদের প্রতি তাদের যৌন আবেগ সক্রিয় তাদের বলা হয় কিউরিয়াস।
এসব গেলো সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশনের গল্প। এবার আসি মানুষের সমকামী হওয়ার কারণের খোঁজে। গোটা বিশষয়টি বিশদভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছি।
সমকামী বিষয়টি পশু-পাখির মধ্যে বহু আগে থেকেই বিদ্যমান। হোমোসেক্সুয়ালিটির গবেষণায় পাওয়া গেছে যে ৬-১০% ভেড়া যৌন মিলনের জন্য অন্য একটি ভেড়াকেই বেছে নেয়। তারা ভেড়ীর সাথে যৌনসংযোগে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করে না।
জাপানে একধরণের ছোট আকারের বাদর পাওয়া যায়। এদের ম্যাকাও বলা হয়। নারী ম্যাকাওরা কখনো কখনো যৌন সম্পর্কের জন্য আরেকটি নারী ম্যাকাওকে বেছে নেয়। এমনকি এসময় কিছু নারী ম্যাকাও, অন্য নারী ম্যাকাওকে যৌন উদ্দীপনার সাহায্যে আকর্ষনের সময় পুরুষ ম্যাকাওদের সাথে প্রতিযোগিতাও করে থাকে।
এ বিষয়টি সম্পূর্ণ ন্যাচারাল। পশু পাখির মধ্যে প্রায়সই এই সম্পর্ক দেখা যায়। মানুষের মধ্যেও বিষয়টি ন্যাচারাল কিনা তা জানার জন্য টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রে ব্ল্যাংকার্ড একটি গবেষণা করেন।
গবেষণার ফলাফলটি এরকমঃ
একটি ভ্রূণ ছেলে সন্তান না মেয়ে সন্তান হবে তা নির্ভর করে ক্রমোজোমের উপর। ছেলে সন্তানের জন্য দায়ী Y ক্রমোজোম। এই ক্রমোজোম ভ্রূণে H-Y এন্টিজেন উৎপাদন করে যা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আবেগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। এই এন্টিজেনটি মাতৃ দেহের উপাদান না। তাই এর বিরুদ্ধে মাতৃ দেহ এন্টিবডি তৈরি করে। যদি এন্টিবডির প্রভাবে H-Y এন্টিজেন বাধাগ্রস্ত হয় তবে সন্তানের মাঝে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষন আর থাকে না। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর সে সমকামী হয়ে ওঠে। প্রথম পুত্র সন্তানের সময় এ ধরণের কোন ঘটনা ঘটে না। কিন্তু দ্বিতীয় পুত্র সন্তানের গে হওয়ার সম্ভাবনা ২% এবং পঞ্চম পুত্র সন্তানের গে হওয়ার সম্ভাবনা ৬% থাকে।
তবে এর সাথে জেনেটিক্যাল কোন সম্পর্ক নেই। গবেষকরা ৫ ধরণের জিনকে সন্দেহ করেছিলেন যেগুলো সমকামীতার জন্য দায়ী হতে পারে। এময়াইটি গবেষক আনড্রিয়া গ্যানা এই ৫টি জিনকে নিয়ে গবেষণা করে দেখেন যে সমকামীতার সাথে জিনগত কোন সম্পর্ক নেই।
তবে এভাবে মানব সমাজের মাত্র ২৫% সমকামীতা ব্যখ্যা করা যায়।
বর্তমানে আমেরিকাতে ৯ মিলিয়নের বেশি আইডেন্টিফাইড লেসবিয়ান, গে ও বাইসেক্সুয়াল বিদ্যমান। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে এন্টিজেনের কারণ দিয়ে ব্যখ্যা করা যায় না। আবার মেয়েদের হোমোসেক্সুয়ালিটি বা লেসবিয়ানও ব্যখ্যা করা যায় না। তাই গোটা বিষয়কে অনেকে সামাজিকভাবে ব্যখ্যা করেছে।
সামাজিক প্রেক্ষাপট
অনেক গবেষকদের মতে হোমোসেক্সুয়ালিটি ব্যক্তিগত পছন্দ। এর পেছনে বায়োলজিকাল বা জেনেটিক্যাল কোন কারণ নেই। গে, লেসবো, বাইসেক্সুয়াল কিংবা হেটারোসেক্সুয়াল এটা প্রতিটি মানুষের টেস্ট, চয়েস বা প্রিফারেন্সের উপর নির্ভরশীল।
যারা বাইসেক্সুয়াল তাদের জন্য গোটা বিশষয়টা সেক্স ফ্যান্টাসি। ধরুণ একজন পুরুষ, সে তার সারাজীবন নারীর সাথে যৌন মিলনে আবদ্ধ হয়েছে। সে তার সেক্স ফ্যান্টাসিকে পূরণের জন্য অন্য পুরুষের শরনাপন্ন হল এবং গে একটিভিটিতে লিপ্ত হল। এটা পুরোটাই নিজস্ব পছন্দ। এটা কারো হবে কারো হবে না।
আবার এটি একটি মানসিক রোগও হতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে এটি বেশি হয়। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে নারীরা প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই নানাভাবে পুরুষদের দ্বারা শোষিত হচ্ছে। শিশু বয়সেও অনেক নারী পুরুষদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ফলে তাদের মনে পুরুষজাতিকে নিয়ে একটি ক্ষোভ ও ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। ফলে জীবনের একটি পরর্যায়ে এসে তারা অন্য একটি নারীকেই নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করছে।
এটা সব ক্ষেত্রেই না। অনেক সময় ফ্যান্টাসির কারণেও নারীরা সমকামী হয়। আর ধর্মীয় প্রভাব মানুষের জীবন থেকে প্রায় চলে যাচ্ছে বললেই চলে। ফলে ধর্মীয় আর সামাজিক বাধা এখন সমকামীতা প্রতিরোধে অক্ষম। আর এর ফলে সমকামীতার হারও দিনদিন বেড়ে চলাই স্বাভাবিক।
তথ্যসূত্রঃ nature, planned parenthood, The Atlantic, The Guardian, livingout, Forbes, The newyork times, The Williams institute
কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানাবেন।