DSLR, আহা ইদানিংকালের মুখে মুখে ঘোরা কি একটা নাম! কেউ এর মানে বুঝুক বা না বুঝুক, কার্যকারিতা বুঝুক বা না বুঝুক তবুও তাদের মুখে মুখে ঘুরে এই শব্দ। অনেকে তো ধরেই নিয়ে থাকে DSLR এর মুখ্য উদ্দেশ্য বুঝি নিজের ছবি তুলে তারপর সেটা ঘষামাজা করে সামাজিক মাধ্যমে আপলোড দেয়া! অন্তত তাদের কাণ্ডকারখানা দেখে তাই মনে হয়!
আবার অনেকেতো কাজে লাগুক বা না লাগুক দেখতে বড় সাইজের লেন্সগুলো কিনে অস্থির হয়ে উঠে পুরোই।
তবে যা ই হোক না কেনো, এইযে আমাদের অনেকের হাতে হাতে ঘোরা এই অদ্ভুত যন্ত্রটি৷ কখনোকি ভেবে দেখেছেন এটা কিভাবে কাজ করে? কিভাবেই বা ঠিক ঠিক লক্ষ্যবস্তুকে (Subject) পুরো ছবির মাঝ থেকে আলাদাভাবে ফোকাস করা যায়?! আজ তাহলে চলুন সেব্যাপারেই জেনে নেয়া যাক!
DSLR এর গঠণ।
১. লেন্স (উত্তল ও অবতল) ২.৪৫ডিগ্রী কোণ করে বসানো ক্যামেরার ভেতরের আয়না ৩. শাটার ৪. ইমেজ সেন্সর ৫. ম্যাট ফোকাসিং স্ক্রিন ৬. কনডেন্সার গ্লাস ৭. পেন্টাপ্রিজম ৮. ভিউফাইন্ডার
DSLR কিভাবে কাজ করে তা জানার আগে প্রথমেই আমাদের জেনে নেয়া দরকার DSLR মানে টা কি?
অনেকেরই DSLR, DSLR বলে চিল্লাপাল্লা করতে করতে অজ্ঞান হবার মত অবস্থা হয় অথচ আদতে জানেই না যে অক্ষরগুলোর মানে কি দাঁড়ায়!
অনেকের কাছে এটা আবার কেবল “পিছনে ঘোলা” করে ছবি তোলার যন্ত্র!
DSLR শব্দটির মূল প্রযুক্তি আসলে SLR। এর কার্যকারিতার সাথে D এর অপরিহার্য সম্পর্ক নেই। যে পদ্ধতিতে ছবি তোলার আলোটা আসে বা ধরা হয় তা হচ্ছে SLR, আর D বলতে ডিজিটাল বুঝায় কেননা আলো ধরার পর ইমেজ প্রসেস করে স্ক্রিনে ছবি রূপে দেখানোর পুরো পদ্ধতিটাই ডিজিটাল।
অপরদিকে SLR শব্দটির মানে হচ্ছে Single Lens Reflex।
এই তিনটি শব্দ দ্বারা দুটি কথা বুঝায়।
প্রথমত,
এপদ্ধতির ক্যামেরাগুলোতে (এনালগ, ডিজিটাল দুটোতেই) একটিমাত্র আলোকপথে লেন্স ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ আলো একটা মাত্র লেন্স (এখানে লেন্স বলতে সামগ্রিকভাবে ভেতরে সবগুলো কাঁচের সমষ্টিকে বুঝানো হচ্ছে) এর ভেতর দিয়েই ক্যামেরায় প্রবেশ করে এবং ছবি তোলার কাজে ব্যবহৃত হয় এবং ওই একই লেন্স থেকে ঢোকা আলো ক্যামেরার পেছনে চোখ রাখার জন্যে থাকা Viewfinder পর্যন্ত পৌছায়। এক্ষেত্রে ভিউফাইন্ডার এ দেখার জন্যে আলাদা কোনো লেন্স ব্যবহার করা হয় না। তাই এগুলো Single Lens Reflex ক্যামেরা।
অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে
i. আলো লেন্স দিয়ে প্রবেশ করে ক্যামেরার ভেতরে ঢুকে।
ii. ক্যামেরার ভেতরে আলো গিয়ে পাশপাশি ৪৫ডিগ্রী এঙ্গেলে বসানো আয়নায় পড়ে এবং সেখান থেকে ক্যামেরার ভেতরে উপরের দিকে থাকা Matte Focusing Screen পেরিয়ে কনডেনসারের মধ্যে দিয়ে পেন্টাপ্রিজমে প্রবেশ করে।
iii. পেন্টাপ্রিজম হচ্ছে ভিউফাইন্ডের অগ্রভাগের উঁচু দিকটার ভেতরের অংশ, যার ভেতর মোট পাঁচটা দেয়াল থাকে যার মাঝে দুটি আয়না। এই আয়নাগুলোতে আলো কনডেনসার থেকে প্রবেশ করে প্রতিফলিত হয়ে ভিউফাইন্ডার দিয়ে বের হয়। যার দরুন ভিউফাইন্ডারে চোখে রাখলে একদম ঠিক যে এঙ্গেলে, যে ফোকাসে ক্যামেরা ছবিটা নিবে সেই অবস্থাটাই আমরা দেখতে পাই।
আর এতেই এই নামকরণের সার্থকতা।
আমরা ক্যামেরা থেকে লেন্স Detach করলে যে চারকোনা ঢালু করে বসানো আয়নাটা দেখি সেটা এই আয়নাই। অনেকে হয়তো একে ইমেজ সেন্সর ভেবে ভুল করতে পারেন। কিন্তু ইমেজ সেন্সর আসলে এর পেছনে থাকে। তাও আবার শাটার দারা আড়াল করা।

তাহলে কথা হল ছবি ওঠে কিভাবে?
এতেই SLR পদ্ধতির কৌশলের দারুণ উদাহরণ রয়েছে। ক্যামেরার মেকানিজম এমনই থাকে যে ঠিক যে সময় আমরা ছবি তোলার জন্যে বাটনে ক্লিক করি, তখনি সামনের আয়নাটা উপরে উঠে যায় আর লেন্স থেকে আসা আলো সেই ক্ষুদ্রসময়ে সরাসরি পেছনের দিকে পড়ে। ঐ একই সময়ে পেছনে থাকা শাটার পড়ে গিয়ে সেন্সর উন্মুক্ত হয়। যতটুকু টাইমিং সেট আপ বা শাটার স্পীড নির্ধারণ করে রাখা হয়, ঠিক ততটুকু সময়ের জন্যে তা খোলা থেকেই আবার শাটার নেমে যায়।
এরপর পরই সেন্সরে যাওয়া অসংখ্য, অগণিত আলোর কণা প্রতিটা ক্ষুদ্রতম অংশে পিক্সেল বাই পিক্সেল হিসেবে তড়িৎ উপাত্তরুপে প্রক্রিয়াজাত (process) হয় এবং তা স্ক্রিনে প্রদর্শিত হয়। একাজের জন্যে প্রতিটা DSLR এর প্রয়োজন পড়ে ইমেজ সেন্সরের। এই ইমেজ সেন্সরের উপরও নির্ভর করে ছবির মান।
অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে শাটার উঠে গেলে কি তখন ভিউফাইন্ডারে দেখা যায় না?
না যায়না, কিন্তু সময়টা এত ক্ষুদ্র যে আমরা লক্ষ্য করিনা, আমরা কেবল ছবি তোলার সময় দেখি ভিউফাইন্ডারে কালোমত কিছু একটা এসে আবার চলে গেল খুব খুব দ্রুত!
আর এজন্যেই আমরা যখন অনস্ক্রিন মুডে ছবি তুলি বা দেখি, তখন ভিউফাইন্ডার শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায়।
তখন মিররের পেছনে থাকা সেন্সরের শাটার খোলাই থাকে কেবল ক্লিক এর সাথে সাথে সঠিক সময়ে আসা আলোক কণাগুলো হিসেব করে ঠিক ঐ সময়ের ছবি দেয়ার চেষ্টা করে। তবে এই টাইমিং শাটারের মত এনালগ না হয় ইমেজ প্রসেসরভিত্তীক হওয়াতে অনেকসময় ক্লিক এর অল্প খানিক পর এর ইমেজটা তোলার হয়। আর সেজন্যেই মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় অনেকসময় ছবি তোলার জন্যে ক্লিক করার পরেও নড়ে গেলে ছবি অনেকসময় ঝাপসা আসে বা দৃশ্যপট বদলে যায়। তাই অনস্ক্রিন মুডে ছবি তুলতে গেলে ক্লিক করার পরেও অল্প কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় ক্যামেরা না নাড়িয়ে।
তবে এব্যাপারটা নিতান্তই প্রসেসরের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। আধুনিক DSLR ক্যামেরাগুলোয় খুব ভালমনের এবং বেশ শক্তিশালী ইমেজ প্রসেসর ব্যবহার করা হয়।

লেন্স – এ্যাপার্চারের খেলা
ভাই, “ডিসলার” (DSLR) কিনলাম, কিন্তু ছবি তুললে ব্যাকগ্রাউন্ড ঘোলা হয়না ক্যান?
আরে ভাই থামেনতো। কেনার আগে অন্তত একটু বুঝুন তো কোনটার কাজ কি?
যাইহোক, ছবিতে লক্ষ্যবস্তু ঠিক রেখে বাকিগুলোকে তথাকথিত “ঘোলা’ করা Focusing এর কেরামতি আসলে নির্ভর করে লেন্স এর উপর। বেশিরভাগ লেন্সগুলোতে জুমিং আর ফোকাসিং দুটো অপশনই থাকে তবে কিছু কিছু লেন্স, যেগুলো Prime বা Fixed Focal Lens (FFL) সেগুলোতে ফোকাল লেংথ বা বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসা আলোকরশ্মির অপতন বিন্দুর মাপ নির্ধারিত করা থাকে।
ক্যামেরা গোটা লেন্স বডির অভ্যন্তরীণ গঠন অনেকটা মানুষের চোখের মত। আর এটা কাজও করে সেই হিসেবেই।
আমরা অনেকেই জানি যে আমাদের চোখের ভেতরে একটা লেন্স থাকে এবং যা আকৃতিতে দ্বি-উত্তল হয়। অর্থাৎ এর সামনে – পিছে দুইপাশেই মাঝে দিক খানিক উঁচু।
ক্যামেরার লেন্সগুলোর বেলাতেও সামনের দিকে থাকা লেন্স গ্লাসটি উত্তল বা Convex থাকে। যার ফলে বস্তুতে প্রতিফলিত আলো এতে যে কোণ থেকেই এসে পড়ুক না কেনো তা অপর প্রান্ত দিয়ে বেরুবার সময় কোনো একটি বিন্দুর দিকেই সব দিক থেকে এসে বেকে যায়। এবং একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে এসে একটি বিন্দুতে মিলিত হয় যে ঘটনাটিকে Convergence বলে। আর যে বিন্দুতে এসে মিলিত তাকে ফোকাল পয়েন্ট (Focal Point) বলে। এরফলে যে কোনো কোন থেকেই আসা বস্তুর আলোর প্রতিফল এই উত্তল লেন্স একদম ক্যামেরার সেন্সর পর্যন্ত পৌছায়।
কিন্তু এতেও লক্ষ্যবস্তুর ছবি পুরোপুরি স্পষ্ট না এসে ঘোলাটে আসে, সাথে রংগুলোও কেমন এলোমেলো আসে যাকে বলে ব্লিডিং।
প্রথমত ছবি ঘোলা আসে কারণ দ্বি-উত্তল লেন্সের পাশগুলো মধ্যভাগের তুলনায় ক্রমনিচু বা চাপা হওয়াতে আলো আপাতদৃষ্টিতে একবিন্দুতে পড়েছে মনে হলেও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসেবে তা আসলে একই বিন্দুতে পড়েনা। যাকে বলা হয় Spherical Aberration। উত্তল লেন্স এর দুইপাশ spherical হওয়াতে এই নাম।
আর দ্বিতীয়ত একই বিন্দু নির্ধারণ করা হলেও লাল, নীল আর সবুজ (আলোকবিজ্ঞানে সবুজ মৌলিক রঙ, হলুদ নয়) আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পার্থক্যের কারণে একই সময়ে তা একই বিন্দুতে পড়েনা। ফলে ছবি রঙের দিক থেকেও রঙের দিক থেকেও এলোমেলো আসে, যাকে বলা হয় ক্রোমাটিন এ্যাবেরেশন (Chromatic Aberration)।
এই দুই ঝামেলা থেকে বাঁচতে আবার এর পেছনে ব্যবহার করা হয় একপার্শ্বিয় অবতল (Concave) লেন্স। যার একপাশ চ্যাপ্টা আর আরেকপাশ সমান থাকে।
ব্যাপারটা ঠিক আমাদের চোখের দৃষ্টি ঠিকঠাক করার জন্যে যেমন + আর – ক্ষমতার চশমা দেয়া হয়!
তবে এ গেল লেন্সের সরলীকৃত বর্ণনা৷ কিন্তু বর্তমান লেন্স বডিগুলোর ভেতর অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধরণের লেন্স ব্যবহার করা হয়, যেন সর্বোচ্চ মানের ছবি আসতে পারে এবং ক্যাপচার যেন আরো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হয়।
অ্যাপারচার (Aperture)
সাধারণ কথায় অ্যাপারচার মানে খোপ বা ফুটা বা ছিদ্র। আমাদের চোখে যেমন পিউপিল দিয়ে আলো প্রবেশ করে, অ্যাপারচার হচ্ছে লেন্স এর সেই অংশ যার মধ্য দিয়ে আলো ক্যামেরার ভেতর প্রবেশ করে।
অ্যাপারচার এর সামনের দিকে থাকা ইলেমেন্ট (Element) আলোগুলোকে এর দিকে ধাবিত করে। আর এ্যাপার্চারের চারপাশে চক্রাকারে থাকা ডায়াফ্রাম (Diaphragm) নিয়ন্ত্রণ করে অ্যাপারচার বা ফুটোর আকার বা একে ছোট/বড় করে। ফিক্সড অ্যাপারচারের লেন্সগুলোতে এই ফুটো ছোটবড় করা যায় না।
ফটোগ্রাফিতে অ্যাপারচারের গুরুত্ব অপরিসীম। এর উপরই নির্ভর করে ছবিতে DOF বা Depth Of Field ব্যাপারটা আসলে কতটা ভালভাবে ফুটে উঠবে। বা সহজ কথায় বললে লেন্স কতটা ভালভাবে Subject কে ফোকাস করে সামনের আর পেছনের দৃশ্যপট কতখানি ঝাপসা (Blur) করতে সক্ষম হবে। অ্যাপারচারের মান নির্ণয় করা হয় f এর সূচকে। f এর মান কম মানে অ্যাপারচারের চারপাশের ডায়াফ্রাম চিকন, অর্থাৎ অ্যাপারচার বা ফুটোটা বড়। আর f বেশি হলে এর মানে হচ্ছে চারপাশের ডায়াফ্রাম চওড়া আর ফুটোটা ছোট।
ফুটো বড় থাকলে আলো সব জায়গা থেকে সমানে আসে এবং প্রচুর আলো লেন্স এ প্রবেশ করে। ফলে ভেতরের উত্তল – অবতল লেন্সকে কাজে লাগিয়ে কোনো একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকা বস্তু থেকে প্রতিফলিত আলোকে কেন্দ্রীভূত করে বাকিগুলোকে ছেড়ে দেয়া যায় ফলে এতে ঐ বস্তুটা সাবজেক্ট হিসেবে Focus করা হয় এবং অন্যান্য দূরত্বের বস্তুগুলো ঝাপসা হয়ে যায়!
আবার একইভাবে যখন অ্যাপারচার বেশি হয়, মানে ফুটো ছোট হয় তখন আলো সবদিক দিয়ে উড়োধুরো আসতে পারেনা। ফলে লেন্স এ আলাদাভাবে ফোকাস করে বাকিটা ছেড়ে দেয়ার মত কিছু থাকেনা ফলে ছবিতে সবই সমান স্বচ্ছতায় দেখা যায় বা Flat দেখায়।
f1, f1.4, f2.0 এগুলো প্রচুর আলো ধরতে পারে অতি অল্প সময়েই। তাই এগুলোকে Fast Lens ও বলা হয়ে থাকে।
আজকের আমাদের আলোচনা তাহলে এখানেই শেষ করছি। এই ছিল DSLR নিয়ে আমাদের আজকের সংক্ষিপ্ত আয়োজন।
পরেরবার আবারো আসবো হয়তো ভিন্ন কিছু নিয়ে।
ততক্ষণ, ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিজের খেয়াল রাখুন।
আর বিজ্ঞানবর্তিকার সাথেই থাকুন।
তথ্যসূত্রঃ
itstillworks.com
photographylife.com
electronics.howstuffworks.com
One Comment
নেপচুন ও হীরকবৃষ্টিঃ অবশেষে আসল কারণ জানতে পারলেন বিজ্ঞানীরা | বিজ্ঞানবর্তিকা
[…] কিভাবে কাজ করে DSLR? […]