
সাবমেরিনের নাম শোনেনি পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সাবমেরিনের কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে এক দানব আকৃতির অদ্ভুত যান যা পানির অতলে চলাচল করে। আবার যুদ্ধের মুভিতে সাবমেরিন যুদ্ধ তো দেখেছিই! মূলত এটুকুই হচ্ছে সাবমেরিন সম্পর্কে সবার প্রাথমিক ধারণা। আজ আমরা একটু গভীরে যাবো এই ধারণাকে সাথে নিয়ে। কীভাবে এই অদ্ভুত সুন্দর যান পানিতে এবং পানির নিচে ভেসে থাকে, চলাচল করে এবং আরো অন্যান্য।
কীভাবে সাবমেরিন পানির নিচে ডুব দেয় এবং আবারও ভেসে উঠে?
এই ঘটনাটি ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদেরকে বিজ্ঞানের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং পানির ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে। সেটি হচ্ছে “প্লবতা” বা buoyancy. হাই স্কুল লেভেলে প্লবতা নিয়ে কিছু হলেও প্রাথমিক ধারণা আমাদের রয়েছে। সহজ বাংলায় প্লবতা হচ্ছে এমন এক প্রকার ঊর্ধ্বমুখী বল যা কোনো বস্তুকে (কাঠের টুকরা থেকে অতিকায় জাহাজ) পানিতে ভেসে থাকতে সাহায্য করে। নিদারুণ সত্য হচ্ছে এই যে, প্লবতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই জলাধির সমাহার আপনার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

যাইহোক, যদি কোনো বস্তু পানিতে তাঁর ওজনের সমপরিমাণ পানি অপসারণ করে তাহলে বস্তুটি ভাসবে, অন্যথায় ডুবে যাবে। কিন্তু সাবমেরিনকে তো পানিতে ডুবতে হবে, তাহলে এখানে প্লবতার কাজ কী? এই প্লবতা বলকে ডুবার কাজে ব্যবহারের জন্য সাবমেরিনে বিশেষ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। Ballast বা ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক। এগুলো সাবমেরিনের সাথে যুক্ত থাকে, যাতে করে অতিরিক্ত পানি বা বায়ু সেগুলোর ভেতর প্রবাহিত করে ভরকেন্দ্রে সমতা রক্ষা করা যায়। ব্যালাস্ট গুলো অতিরিক্ত পানি বা বায়ু দ্বারা পূর্ণ করলে সাবমেরিন ডুববে এবং সেগুলো অপসারণ করলে সেটি আবার ভেসে উঠবে! কত সহজ কর্মনীতি তাইনা? ব্যাপারটা এমন, যখন সাবমেরিন পানির উপরে ভেসে থাকে তখন ব্যালাস্ট গুলো বায়ু দ্বারা পূর্ণ থাকে। এতে সাবমেরিন কর্তৃক অপসারিত পানির ঘনত্ব নদী বা সমুদ্রের পানি অপেক্ষা কম হয়। যখন তাঁকে ডুব দিতে হয় তখন আবার ব্যালাস্টের বাল্ব গুলো খুলে দেয়া হয়। নিয়ন্ত্রিত উপায়ে বাতাস বের করে দিয়ে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি সেখানে প্রবেশ করানো হয়। পানি দ্বারা পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরেই বাল্ব বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সাবমেরিন ডুব দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
পুনরায় যখন পানিতে ভেসে ওঠার প্রয়োজন হয় তখন অভ্যন্তরে থাকা বায়ুর পাম্প গুলো ছেড়ে দেয়া হয়। এই পাম্পগুলো ব্যালাস্টের মধ্যে প্রচণ্ড বেগে বাতাস প্রবাহিত করতে থাকে এবং অভ্যন্তরে থাকা পানি দ্রুত বাহিরে বেরিয়ে যেতে থাকে। ফলাফলস্বরূপ আগের মতো আস্তে আস্তে সাবমেরিনের ঘনত্ব কমতে থাকে এবং তা একসময় পানিতে ভেসে উঠে। ব্যালাস্ট গুলো এমন ভাবে পেছনের দিকে অবস্থান করে যাতে পানি নির্গমনের ধাক্কা সাবমেরিনকে আরো দ্রুত উপরে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

পানির নিচে সাবমেরিন ঘোরানো
নেভিগেট করার মতো গভীরতায় যাওয়ার পর যখন সাবমেরিন চলতে থাকে তখন একে ডানে বা বায়ে ঘোরানোর প্রয়োজন হয়। ক্রুদের তখন এই জিনিসটা মাথায় রাখতে হয় যে, ঘোরানোর সময় যাতে গভীরতার পরিবর্তন নাহয়। সেজন্য ব্যালাস্টের মধ্যে থাকা পানি ও বাতাসের মধ্যে সমতা থাকা জরুরী। ডলফিনের পাখার মতো যে hydroplane রয়েছে সেগুলো নিচের দিকে একটা নির্দিষ্ট কোণ করে বাঁকানো। যখন পেছনের “রাডার” ডানে অথবা বায়ে ঘুরে সেটাই সাবমেরিনকে বিভিন্ন দিকে নিতে সাহায্য করে।

এই হলো প্রাথমিক কার্যনীতি। এবার সাবমেরিনের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ সম্পর্কে জানা যাক।
Pressure Hull

সমুদ্র গভীরতা যত বাড়তে থাকে পানির চাপ তাঁর দ্বিগুণে বাড়ে। যেখানে সাবমেরিন পানির মাত্র ৬০০ মিটার গভীরে সর্বোচ্চ অবস্থান করতে পারে সেখানে পানির চাপ প্রায় ৬০ গুণ বেশি থাকে। এত চাপে কীভাবে এই যান টিকে থাকে? সাবমেরিনের সম্পূর্ণ মাস্তুল টাইটানিয়াম বা স্টিলের সংকর দিয়ে নির্মিত হয় যা পানির চাপ প্রতিরোধে সক্ষম। তাছাড়াও ভেতরের দিকে মাস্তুলের আরেকটা অংশ থাকে যাকে Pressure Hull বলা হয়। এই দুই এ মিলে সাবমেরিনকে পানির প্রচন্ড চাপ মোকাবেলা করতে সহায়তা করে।
Planes
মাছের পাখনার মতো সাবমেরিনেরও পেছনের দিকের অংশে diving plane বা hydroplane ডিজাইন করা হয়ে থাকে। এই plane গুলো এক প্রকার ঊর্ধ্বমুখী বল প্রয়োগ করে পানির ঘর্ষণ কমিয়ে দিকনির্ণয় করতে সহায়তা করে।

Ballast Tanks
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আগেই এটা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক গুলো পানি বা বায়ু দ্বারা পূর্ণ থাকে এবং সাবমেরিনের ডোবা অথবা ভেসে ওঠায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে।
Engines
গ্যাসোলিন বা ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয় গাড়িতে। জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় বিমানে। কিন্তু সাবমেরিনের ক্ষেত্রে ব্যাপার আলাদা। এখানে ডিজেল- ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। পানির নিচে অক্সিজেন কম থাকায় ডিজেল সেখানে ঠিকভাবে কাজ করতে পারবেনা। সেজন্য বৈদ্যুতিক জেনারেটর থাকে যা প্রপেলারকে সেই ডিজেল থেকে শক্তি নিয়ে পানির নিচে ঘুরতে সাহায্য করে। আবার অনেক অতিকায় যুদ্ধ সাবমেরিন গুলো পারমাণবিক শক্তিতে চুলে। তাঁদের ভেতর ছোটো আকৃতির পারমাণবিক চুল্লি থাকে যেগুলো অফুরন্ত শক্তি উৎপন্ন করে। এইসকল সাবমেরিন খুবই শক্তিশালী হয় ও তাঁদের বাহিরে থেকে শক্তির প্রয়োজন পড়েনা।

Life Support System
গভীর সমুদ্রতল, চারিদিকে হিমশীতল পানি। আপনাকে এখানে থাকতে হবে ১ মাস বা তাঁরও বেশি সময়। কীভাবে সাবমেরিনের মতো জায়গায় ক্র্যু রা বেঁচে থাকে, অক্সিজেন পায়? সাবমেরিন সম্পূর্ণ এয়ার টাইট এবং বদ্ধ একটি সিস্টেম। বিশেষভাবে তড়িৎ বিশ্লেষণ করে পানি থেকে অক্সিজেনকে আলাদা করা হয় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য আবারও পানিকে ব্যবহার করা হয়। সমুদ্রের নোনা পানি থেকে তড়িৎবিশ্লেষণ করে বিশুদ্ধ পানিও তৈরি করা যায়। বর্জ্য গুলো স্টিলের ক্যানে ভরে এয়ার টাইট কম্পার্টমেন্টের মাধ্যমে বাহিরে নির্গমন করে দেয়া হয়।
মোটামুটি এই হচ্ছে একটি সাবমেরিনের মৌলিক কার্যনীতি। সব সাবমেরিনেই এই প্রাথমিক যন্ত্রাংশগুলো থাকে তাঁদের কাজ একই। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশেরও বর্তমানে দুটি যুদ্ধ সাবমেরিন রয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো যুক্ত হবে।
Source: scienceabc, howstuffworks