প্রতিদিনই তো অনেক প্রাণী মারা যাচ্ছে। তারা সমাহিত হচ্ছে বা পানিতে মাছেরা মরে গিয়ে তলদেশে মিশে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে তাদের দেহ পচে গিয়ে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। কিন্তু কি করে এখনো আমরা ডাইনোসরের হাড় উদ্ধার করছি? কি করে পাচ্ছি আদিম যুগের মানুষের ফসিল?
স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে হাড় পচে যাওয়াটা এক দশকের ব্যাপার কিন্তু শুষ্ক পরিবেশে পচনের কাজটি সম্পন্ন হতে কয়েক হাজার বছর লাগতে পারে।
মানুষের মৃত্যুর পর আমরা দাফন করি। ঢাকা শহরে দাফন দেয়ার ব্যাপারটা মোটেও সহজ নয়। এখানে এক দুই বছরের পুরনো কবরগুলো ভেঙে ফেলা হয়। সেখানে নতুন করে কবর দেয়া হয়। তখনও পুরনো হাড়গোড় পরে থাকে। আমরা বলে থাকি মৃত্যুর পর আমাদের দেহ মাটির সাথে মিশে যাবে। এর দ্বারা আমরা সম্পূর্ণ দেহকে মাটিতে মিশে যাবে বলে ইঙ্গিত করি। কিন্তু কবর থেকে সেই হাড়গুলো কেন পাওয়া যায়? কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাটিতে মিশে যাওয়ার ব্যাপারটা সত্য নাও হতে পারে। কারণ প্রায় সময়ই হাজার বছরের পুরনো হাড়গোড় পাওয়া যায়।
মাংস এবং টিস্যু খুব দ্রুতই মাটির সাথে পচে যায় কিন্তু হাড়ের খুব চমৎকার একটি গুন রয়েছে টিকে থাকার। শুরুতে এই বিষয়টি যতটা সহজ মনে হয় আপনি যদি আরো গভীরে যেতে থাকেন তাহলে জটিল কিছু অভিভুতকর বিষয়ের সাথে পরিচিত হবেন।
হাড়কে মাটির সাথে মিশে যেতে কখনো কয়েক দশক আবার কখনো কয়েক বছর লাগে। আবার কিছু ক্ষেত্রে এর কোনো ক্ষয় হয়ই না। হাড়ের ক্ষয় হওয়ার নির্ভরতাকে বুঝতে হলে হাড়ের পচনের পেছনের কথাগুলি জানতে হবে।
হাড়ের পচন
পচন সকল জৈবিক অঙ্গের ক্ষেত্রেই হয়। যদিও বিভিন্ন অঙ্গ বিভিন্ন ভাবে পচে যায়, তবে এর মূল ধারণা সবক্ষেত্রেই একই। দেহের দুইভাবে পচন হয়
- রাসায়নিক ভাবে
- ক্ষুদ্র জীবের প্রভাবে
অনেক রকম প্রভাবকের ফলে বস্তুর পচন প্রভাবিত হয় যেমন : তাপমাত্রা, আদ্রতা, কীটপতঙ্গ এর উপস্থিতি, বাতাসের উপস্থিতি, মাটির অম্লতা ইত্যাদি। মানুষের দেহের সকল টিস্যু, অঙ্গ এক সপ্তাহেই পঁচে যেতে পারে আবার হাজার বছরও লাগতে পারে। এটি নির্ভর করে দেহটি কি অবস্থায় রয়েছে, একই ধারণা হাড়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
সব হাড় কোথায় আছে?
অনেকেই মনে করে হাড় কখনো পচে যায় না। কথাটি সত্য নয়,কারণ পৃথিবীতে জীবজন্তুর বিচরণ কোটি কোটি বছর ধরে। এত লম্বা সময়ে অসংখ্য প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। হাড় পচে না গেলে তাদের হাড় গোর ও পাওয়া যেত সব খানে।
ভাগ্য ক্রমে মাংস ও হাড়ের মাঝে কিছু পার্থক্য থাকলেও মিলও আছে। হাড় মোটেও লোহার মত কঠিন পদার্থ দিয়ে তৈরি নয়। মারাত্মক ভাবে আহত হলে এই হাড়ও চকের মত ভেঙে যেতে পারে। অন্যান্য অঙ্গের মত হাড়ও জীবন্ত টিস্যু দিয়ে তৈরি। হাড় কোলাজেনের বিশাল এক সংযুক্তিতে তৈরি বহুরন্ধ্র বিশিষ্ট বস্তু, সম্পূর্ণ কঠিন পদার্থ নয়। সে কারণে টিস্যু যেভাবে পচে যায় হাড়ও ঠিক সেভাবে পচে যাবে।
যদি মৃত দেহ মুক্ত পরিবেশে, জীবাণু, ছত্রাকের নাগালে থাকে তাহলে খুব সহজেই হাড় পচে যাবে। কিন্তু শুষ্ক পরিবেশে ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়ার টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তখন তারা হারের পচন ক্রিয়া ঘটাবে খুব ধীরে। যাই হোক না কেন, বেশিরভাগ হাড়ই পচে মাটির সাথে মিশে গেছে। যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।
হাড় কি সারাজীবন টিকে থাকবে?
কিছু ক্ষেত্রে হাড় অমরত্ব লাভ করেছে। আপনারা হয়ত এমন হাড় দেখেও ফেলেছেন জাদুঘরে। সেগুলোকে আমরা ফসিল বলে থাকি।
ফসিল বা জীবাশ্ম কি?
জীবাশ্ম= জীব+ অশ্ম। জীব কথাটার মানে আমাদের সবারই জানা। অর্থাৎ যার জীবন আছে যার, তাই হল জীব। আর অশ্ম মানে হল পাথর বা পাথুরে জাতীয় কিছু। জীবের যে অংশ নষ্ট না হয়ে শক্ত, প্রস্থরীভূত হয়ে হাজার হাজার, এমনকি লক্ষ বা কোটি বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে সেই অংশটাই হল জীবাশ্ম।
মানে,ফসিল হলো সেই সকল হাড় যেগুলো পলিমাটিতে এমনভাবে আবদ্ধ ছিল যে, একসময় সেগুলো পাথরে পরিণত হয়ে গেছে।আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ও এরকম ভয়ংকর প্রাকৃতিক ঘটনায় ভু অভ্যন্তর থেকে পলি উপরে চলে আসে।
পলিমাটির ভেতর যখন এই হাড়গুলো থাকে তখন এর মধ্যে উপস্থিত তরলে দ্রবীভূতযোগ্য পদার্থ গুলো কালের বিবর্তনে সেখান থেকে বের হয়ে যায়। মনে খনিজ পদার্থে রূপান্তরিত হয়। আর সেই তরলের জায়গাটি প্রতিস্থাপিত হয় পাথরের মত উপাদান দিয়ে। ফলে একসময় জমতে থাকা কঠিন পদার্থের কারনে হাড়টি একটি আস্তরনে ঢাকা পরে এবং টিকে থাকে হাজার হাজার বছর। তবে এটাকে ঠিক প্রকৃত হাড় বলা যায় না, কারন অনেক উপাদানই তো এর মধ্যে আর নেই।
এর থেকেও ভালো অবস্থায় পাওয়া গেছে এমন হাড় ও রয়েছে তবে সেগুলো খুবই দুষ্প্রাপ্য। আর এমন একটি হাড় মানুষ আবিষ্কার করেছে, যা ২.৮ মিলিয়ন পুরনো। এরকম হাড়ের সবথেকে ভালো উদাহরণ হলো মিশরের পিরামিডের ভেতর থেকে আবিষ্কৃত মমি। তাদের শুধু হাড় কেন? শরীর টিস্যু ও মাংসও রয়েছে। মিশরের লোকরা সোডিয়ামের লবণ ব্যাবহার করত মৃতদেহ থেকে জলীয় উপাদান পরিষ্কার করতে। যা ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়াকে পচনপ্রক্রিয়া সৃষ্টি থেকে বাধা দেয়। তাছাড়া মৃতদেহকে লিনেন ও স্ফরাগোসার্কস এর কাপড় দিয়ে ঢাকার কারণেও মৃতদেহ টিকে গেছে।
হাড় অবশ্যই ক্ষয় হয়। কিন্তু অন্যান্য জৈবিক অঙ্গ থেকে ধীরে। কোনোকিছুই সারাজীবন টিকে থাকে না।
ডাইনোসরের ফসিল
এই পুরো প্রক্রিয়াটি ডাইনোসরের ফসিলের সাপেক্ষে উদাহরণ দিচ্ছি। আজ থেকে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসর ছিলো। প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে না পেরে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিলুপ্ত ডাইনোসরের দেহ মাটির সাথে মিশে যায়। সৌভাগ্যকর্মে কিছু ডাইনোসরের দেহ পলিমাটিতে আবদ্ধ ছিল। তাই নরম জৈব অংশ মিশে গেলেও হাড়গুলো শুষ্ক পরিবেশে থেকে ধীরে ধীরে পাথরে পরিণত হয়ে গেছে। তাই এখন যেগুলো ডাইনোসরের হাড় পাওয়া যায় সেগুলি পাথরের খণ্ড ছাড়া আর কিছুই না।
SOURCE :
Leave a Reply