বজ্রপাত ও যন্ত্রপাতি

যন্ত্রপাতি বিষয়টা, বিশেষকরে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু মজার বলুন বা দু:খের বলুন বা হরর মুভি দেখার মত আঁৎকে ওঠার ব্যাপারই বলুন না কেনো, ব্যাপার হচ্ছে বজ্রপাত, বিজলী (বাংলা সিনেমা না কিন্তু), ঠাটা (অভিশাপ না ভাই) এগুলো নাম শুনলে যন্ত্রপাতিগুলোর জন্যে কিন্তু মনটা চিন্তায় ধুকপুক ধুকপুক করে ওঠে। বিশেষকরে যাদের বাসায় কম্পিউটার আছে, রাউটার আছে তাদের জন্যে তো এটা মহা আতঙ্ক!

কি? পড়তেে পড়তেই আপনার যন্ত্রপাতির কথা ভাবা শুরু করে দিয়েছেন তাইনা?

ঘাবড়াবার কিছু নেই। আসুন এ বিষয়ে টুকিটাকি কিছু জেনে নেয়া যাক। তবে সে প্রসঙ্গে যাবার আগে অল্প কথায় জেনে নিই বজ্রপাত কেন/কিভাবে হয়।

বজ্রপাত কি ও কেনো? সহজ ভাষায় বজ্রপাত কি?

বজ্রপাত হচ্ছে আমাদের চিরপরিচিত কারেন্ট বা বিদ্যুৎ প্রবাহেরই একটা রূপ। তবে অনেক অনেক উচ্চমাত্রার।

মেঘের নিচের স্তরে থাকা নেগেটিভ চার্জযুক্ত কণা যখন মাত্রাতিরিক্ত ঘনীভূত হয়ে উপরের দিকে হাল্কা বাষ্পে থাকা মাত্রাতিরিক্ত ঘনীভূত পজিটিভ চার্জযুক্ত কণা বা ভূপৃষ্ঠের পজিটিভ চার্জযুক্ত কণার সাথে চার্জের সমতা বিধানে স্রোতের সৃষ্টি করে (+ ইলেকট্রন গ্রহণ ও – ইলেকট্রন ত্যাগ করে)। এই প্রক্রিয়াকে Electrostatic Discharge (ESD) বলে। প্রক্রিয়াটি মেঘের সাথে মেঘের (Intra-Cloud/ IC), মেঘের থেকে মাটির (Cloud to Ground/ CG) বা এমনকি মাটি থেকে মেঘের দিকে (Ground to Cloud /GC) ও হতে পারে। আর এই প্রক্রিয়া এতই শক্তিশালী হয় যে বাতাস বিদ্যুৎ পরিবাহী না হওয়া স্বত্বেও ঘনীভূত চার্জযুক্ত কণাগুলোর কারণে বাতাস প্লাজমায় রূপান্তরিত হয়ে পরিবাহিতার কাজ করে। আর তখনি প্রচন্ডরকম দুর্নিবার শক্তিতে ঘটে বজ্র সঞ্চালন!

তো যাই হোক, এবার জেনে নিই আলোচনার বিষয়গুলো।

১. বজ্রের ক্ষমতা

২. বজ্রপাতে যন্ত্রপাতি ক্ষতির সম্ভাবনা কতটুকু?

৩. বজ্র-বৃষ্টির সময় বৈদ্যুতিক জিনিষ ব্যবহার কতটা নিরাপদ?

৪. বজ্রপাতে কি আপনার পিসি বা রাউটার কেবল মেইন লাইন দিয়েই নষ্ট হতে পারে?

৫. সার্জ প্রটেকশন আর UPS আসলে কতটা সুরক্ষিত?[/box]

১. বজ্রের ক্ষমতা

বজ্রপাত স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। যেখানে আপনার ঘরের এনার্জি সেভিং বাতি ঘণ্টায় ৩২ ওয়াট বা আপনার পিসির 80%+ পাওয়ার সাপ্লাই ঘণ্টায় ৫০০ ওয়াট বিদ্যুৎ ক্ষমতা/শক্তি গ্রহণ করে সেদিকে একটামাত্র বজ্রপাতে উৎপন্ন হয় ১ থেকে ১০ গিগাওয়াট ক্ষমতা/শক্তি (Watt/Joule)! অর্থাৎ একশ কোটি থেকে এক হাজার কোটি ওয়াট! ভাবুন একবার এই ক্ষমতা কত বেশি! জী, এই ক্ষমতা এতোটাই বেশি যে তা ক্ষণিক সময়ে মাঝে বাতাসে এতো বেশি তাপ উৎপন্ন করে যে তা ২০,০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসও হতে পারে। অর্থাৎ সূর্যপৃষ্ঠের চাইতেও প্রায় চারগুণ বেশি! সুতরাং পরেরবার বজ্রপাতের সময় যন্ত্রপাতি তো বটেই, নিজেকে সাবধানে রাখুন।

২. বজ্রপাতে যন্ত্রপাতি ক্ষতির সম্ভাবনা কতটুকু?

বজ্রপাতে আপনার ঘরদোরের যন্ত্রপাতি কতটুকু নিরাপদ তা নির্ভর করে আপনা বিদ্যুৎ সংযোগ ও সেটার মেইন লাইনের উপর। মনে রাখবেন বজ্রের ইলেকট্রনের ভয়ানক স্রোত মাত্রই পথ খুঁজে গ্রাউন্ডিং এর। অর্থাৎ পজিটিভ চার্জে মিলিত হবার। এর মাঝে যেকোনো, স্রেফ যেকোনো পরিবাহী পেলেই পদার্থের নিয়মানুসারে সে সেটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন বজ্রপাতের সময় আপনার ঘরের সংযোগ দেয়া বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশের ক্ষতির সম্ভাবনা ফিফাটি ফিফাটি! এক্ষেত্রে যথাযথ নিরাপদ বর্তনী আর নিরাপদ এক্সটেনশন সকেট ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক।

৩. বজ্রপাতের সময় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করাটা বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ।

আগে যেমন বললাম, বজ্রের ইলেকট্রন মাত্রই তার গ্রাউন্ডিং বা আর্থিং হবার জন্যে পরিবাহী খুঁজে। এখন সেটা মানুষ হোক, গাছপালা হোক বা আপনার ঘরে বিদ্যুৎ প্রদানকারী রাস্তার মুল লাইনের খাম্বা হোক। তবে আশেপাশে বা যে বাসায় থাকেন সে বাসার লাইনিং রড থাকাটা তুলনামূলক নিরপাদ। তবে তাই বলে ভাববেন না যে কোনো লাইনিং রড বজ্রকে আকৃষ্ট করে। সুতরাং বজ্রপাতের সময় যন্ত্রপাতি ব্যবহার যতটা পারুন কম করুন। শুধু সুইচ বন্ধ করে দিলে যদি ভাবেন কাজ সেরেছে। তাহলে সেটাও ভুল।

জ্বী ভুল, বজ্রের ইলেকট্রনের স্রোত এত শক্তিশালী যা তা দুটো পরিবাহী খানিক দূরত্বে বিচ্ছিন্ন থাকা স্বত্বেও জাম্প করে একটা থেকে আরেকটা যেতে পারে। এমনকি এই জাম্প ফিটখানেকের পর্যন্তও হতে পারে। তবে সেটা রেয়ার কেস। কিন্তু হ্যা অসম্ভব নয়।

সুতরাং ভাল হয় যদি বজ্রপাতের সময় সকেট থেকে তার খুলে রাখা হয়।

৪. বজ্রপাতে কি আপনার পিসি বা রাউটার মেইন লাইন দিয়েই নষ্ট হতে পারে?

জ্বী, না। বজ্রপাতে আপনার রাউটার বা পিসি বিদ্যুৎ পরিবাহী যেকোনো জিনিষ দ্বারা ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এটা জরুরী না যে সেই ওভারফ্লো আপনার পাওয়ার কেবল দ্বারাই হবে। প্রচলিত বিদ্যুৎ পরিবাহী ল্যান কেবল থেকেও সামান্য কিছু বিদ্যুৎ বেশি চলে আসলেও আপনার পিসি বা রাউটার ড্যামেজ হতে পারে।
একটা মাদারবোর্ড এর সাধারণ সাপ্লাই ভোল্টেজ হচ্ছে মাত্র +5 ভোল্ট থেকে +12 ভোল্ট।
জ্বী, এতটাই কম। সেক্ষেত্রে পাওয়ার সাপ্লাই থেকে লাইন রেসিস্টর হয়ে পরে বোর্ডের ভোল্টেজ রেগুলেটর মডিউলে যায়। কিন্তু ল্যান কেবল বা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের যে তার, তা থেকে কিন্তু কারেন্ট কোনো রেগুলেশন বা রেসিস্ট্যান্স এর মধ্য দিয়ে যায়না। সুতরাং ঝুঁকি থেকেই যায়। তবে এক্ষেত্রে আপনার ISP যদি মেইন লাইনে বিদ্যুৎ পরিবাহী কেবলের পরিবর্তে অপটিকাল ফাইবার ব্যবহার করে থাকে সেক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেকটাই থাকেনা। অন্তত সরাসরি অপটিকাল ফাইবার থেকে তড়িৎ যাবার তো কথাই না। কারণ তা শুধু আলোর কণাকেই ডেটা ট্রান্সমিশনের মাধ্যম হিসেবে পরিচালনা করে। এটা বিদ্যুৎ পরিবাহীই না। সুতরাং আজই আপনার ISP (Internet Service Provider) এর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হোন। অন্যথা বজ্রপাতের সময় ল্যান কেবল খুলে রাখুন। এমনকি যদি আপনার পিসি বা রাউটার বন্ধ থাকে বা লোডশেডিংও থাকে তো।

৫. বজ্রপাতে সার্জ প্রটেকশন আর UPS কতখানি সুরক্ষিত?

বিষয়টা পুরোদস্তুর আপেক্ষিক।
সার্জ প্রটেক্টেড এক্সটেনশন সকেট বা মাল্টিসকেটগুলো বিদ্যুতের অতিরিক্ত ধাক্কা আটকাতে পারে ঠিকই তবে সেই সার্জ প্রটেকশন বা রেসিস্ট্যান্স তুলনামূলক খুব কম। মাত্র কয়েকশ ওয়াট/জুল পর্যন্ত।
সেক্ষেত্রে আশেপাশে খুব নিকটে বজ্রপাত হলে ঝুঁকিটা থেকেই যায়। তবে সাধারণ ক্ষেত্রে তা আপনাকে মোটামুটি ২০০০-২২০০ ওয়াট ব্যবহারে ভালই সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
অপরদিকে রইলো UPS এর কথা। বিদ্যুতের চরম ওঠানামাতে UPS আমাদের দীর্ঘদিনের আস্থার সঙ্গী। তবে তার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। UPS সাধারণ ভোল্টেজের আপডাউনে আপনার পিসিকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। একটা 650VA’র UPS এক্ষেত্রে যথেষ্ট কাজে দেয়, তবে তা সাধারণ ক্ষেত্রে। কেননা বিদ্যুতের মাত্রাতিরিক্ত প্রবাহ রোধ করা এর কাজ নয়। যেহেতু এর নামই Uninterrupted Power Supply তো বুঝেনই এর মূল কাজই হচ্ছে লোডশেডিংয়ের সময় হুট করে আপনার কম্পিউটার যেন বন্ধ না হয়ে যায় সেটাই এর মুল লক্ষ্য।

সুতরাং পরিশেষে এটাই বলা চলে যে কম বেশি যাই হোক না কেনো, বজ্রপাতের সময় আপনার বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির কোনোরকমের পরিবাহী সংযোগ দিয়ে রাখাটাই ঝুঁকির। এক্ষেত্রে যথাযথা নিরাপদ বর্তনী ও সকেট ব্যবহার করুন ও যথাসম্ভব সরাসরি লাইন দিয়ে চলা যন্ত্রপাতি ব্যবহার থেকে তখন বিরত থাকুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>