মানুষের মস্তিষ্ক যেরকম অদ্ভুত তার কর্মকান্ডও বেশ অদ্ভুত। মস্তিষ্ক যে কখন তার মালিককে নিয়ে ছেলেখেলা করে তার হিসেব রাখা দায়। শৈশবের অনেক কাছের কোন বন্ধুর নাম নিতে বা ছেলেবেলায় মায়ের কোলে শেখা কোন ছড়া গড়গড় করে বলে দিতে আমাদের কোন বেগ পেতে হয় না। অথচ এইতো ৫ মিনিট আগে পরিচয় হওয়া মানুষটার নাম মনে থাকছে না। আবার পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে পড়ে যাওয়া পড়াটাই যেন আর মনে পড়তে চায় না। কেন এরকম হয়? আজ জানবো সে ব্যাপারেই কিছু কথা।
ক্যালটেকের কিছু গবেষক মাউস মডেলের মাধ্যমে পরীক্ষা করে এটা নিশ্চিত হন যে, মস্তিষ্কের কিছু নিউরন স্থায়ী স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য একসাথে দীর্ঘসময়ের জন্য উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। এই নিউরনগুলো মস্তিষ্কের মধ্যে ঐ একই তথ্যের রিডানডেন্সি বা পুনরাবৃত্তি ঘটায়। অর্থ্যাৎ একই তথ্য বারবার মনে করার চেষ্টা করে। এভাবেই স্থায়ী স্মৃতি তৈরি হয়। এটি একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এই স্মৃতিগুলো স্বাভাবিকভাবে সারাজীবনই অক্ষত থাকে। ব্রেইন ডেমেজ, স্ট্রোক, আলজাইমার ইত্যাদি রোগের কারণে এই স্মৃতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
সামনে যাওয়ার আগে একটি বিষয় সকলের জানা দরকার। সেটি হল মাউস মডেলের বিষয়ে।
মাউস মডেল
অনেকের মনে হতে পারে স্মৃতি বিষয়ক উপরে উল্লেখিত পরীক্ষার নাম মাউস মডেল। আসলে তা নয়। মানুষ সম্পর্কিত অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা সবার আগে ইঁদুরের উপরে প্রয়োগ করা হয়।

পরীক্ষার ফলাফল সাপেক্ষে তা পরবর্তীতে মানুষের উপরে প্রয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইঁদুরের উপরে ঘটানো এসকল পরীক্ষাকে সাধারণ নামকরণ হিসেবে মাউস মডেল বলা হয়। মাউস মডেল কোন নির্দিষ্ট গবেষণা বা পরীক্ষার নাম নয়।
তো এই মাউস মডেলের সাহায্যে ক্যালটেকের গবেষকেরা বেশ জোড়ালো ভাবেই তাদের যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। মানুষের স্থায়ী স্মৃতিগুলো একগুচ্ছ নিউরন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর এই নিউরনগুলো সর্বদা একত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মস্তিষককে নাড়া দেয়। নিউরনগুলো একটি নির্দিষ্ট তথ্যের পুনরাবৃত্তি বারংবার মস্তিষ্কে ঘটায়। ফলে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে সেই তহ্য স্থায়ীভাবে মস্তিষ্কে গেঁথে থাকে। এখন কিভাবে ব্রেইন ডেমেজের মাধ্যমে এই স্থায়ী স্মৃতিও নষ্ট হয়ে যায় তারও উত্তর খুঁজে বের করেছে গবেষকেরা। মূলত স্ট্রোক, আলজাইমার ইত্যাদি রোগের কারণেই ব্রেইন ডেমেজ হয়ে থাকে।
এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন ওয়াল্টার গনজালেজ। তিনি ও তার দল ইঁদুরের একটি নতুন জায়গা ভুলে যাওয়া বা মনে রাখার উপর ভিত্তি করে ইঁদুরের নিউরাল একটিভিটি পর্যবেক্ষণ করেন। এ গবেষণাটি ক্যালটেকের বায়োলজির প্রফেসর কার্লোস লোইসের ল্যাবরেটরিতে সম্পন্ন করা হয়।
গবেষণার জন্য করা পরীক্ষা
এই পরীক্ষায় একটি ইঁদুরকে ৫ফিট দৈর্ঘ্যের একটি সরু-সোজা নল বা রাস্তায় রাখা হয়। যার দুই প্রান্তই বদ্ধ এবং সাদা দেয়ালে ঘেরা। রাস্তার বিভিন্ন স্থানসহ দেয়ালে কিছু চিহ্ন বা চিত্র অঙ্কন করা। উদাহরণসরূপ বলা যায় যে, শুরুর ডানদিকের শেষ প্রান্তে একটি বোল্ড করা যোগ চিহ্ন, মাঝামাঝি স্থানে একটি স্ল্যাশ চিহ্ন আবার অপর প্রান্তে শরবত রাখা ছিলো। ইদুঁরের অভিযান শেষে গবেষকেরা তার নিউরনের চলাচল পর্যবেক্ষণ করেন। এবং মস্তিষ্কের যে স্থানে নতুন স্মৃতি সৃষ্টি হয় সে স্থানটিও পর্যবেক্ষণ করেন।
যেকোন নতুন কোন প্রানিকে এরকম একটি ট্র্যাকে দাঁড়া করালে সে স্বভাবতই হতভম্ব হয়ে থাকবে। প্রাথমিক ভাবে সে কিছুই বুঝবে না যে এখন তার কি করা উচিৎ। এমতবস্থায় যেকোন প্রানিরই একটি মাত্র নিউরন সক্রিয়ভাবে কাজ করে।
কিন্তু যখন একই প্রাণীকে বারবার ওই ট্র্যাকে স্থাপন করা হবে ততোই সে ওই ট্র্যাকের সাথে পরিচিত হতে থাকবে। তখন সে যানে যে কোথায় তার জন্য শরবত রাখা আছে। সে পথের চিহ্নগুলোর একটি অর্থ নিজে নিজেই খুঁজে নেবে। চিহ্নগুলো তার জন্য খাদ্য নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে। সে যতো ওই পথের সাথে পরিচিত হবে তার ততো বেশি নিউরন কাজ করবে। নিউরনের কার্যকলাপ ততোবেশি সক্রিয় ও স্বতস্ফূর্ত হবে।
এভাবে একটা সময় ইঁদুরের অনেকগুলো নিউরন সেই ট্র্যাকের সাথে পরিচিত হয়ে গেলো। স্থায়ী স্মৃতির মুছে যাওয়ার কারণ বের করতে গবেষকেরা ইঁদুরকে ২০ দিনের জন্য সেই ট্র্যাকে উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকে।
২০ দিন পর পুনরায় যখন ইঁদুরকে ওই ট্র্যাকে আনা হয়, তখন দেখা যায় সাড়া দানকৃত পূর্বের নিউরনগুলোর অধিকাংশই দ্রুত সাড়া প্রদান করছে। আর অল্পকিছু ভিন্ন আচরণ করছে। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে ইঁদুরটি সেই ট্র্যাকটি আইডেন্টিফাই করতে পেরেছিলো। একই জায়গার পুনরাবৃত্তি হওয়ার কারণেই অধিক সংখ্যাক নিউরন সাড়া প্রদান করেছিলো আর অল্পকিছু পারেনি।
গনজালেজ গল্পের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছেন,
মস্তিষ্ক একই ঘটনা বা তথ্যের পুনরাবৃত্তি বেশি ভালো মনে রাখতে পারে। মস্তিষ্কের স্মৃতি সংরক্ষনকারী অংশও এক্ষেত্রে দ্রুত সাড়া প্রদান করে। যখনই একটি তথ্যকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে তখন মস্তিষ্ক সেই তথ্যের পুনরাবৃত্তি নিজে নিজেই ঘটায়। আর দীর্ঘসময়ের পুনরাবৃত্তি ঘটলে মস্তিষ্ক সেই তথ্যকে স্থায়ীভাবে গ্রহণ করে।

স্মৃতি মানবজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। স্মৃতি ক্ষয় বা ভুলে যাওয়ার কারণে প্রায়সই অনেক মানুষকে বিপদে পড়তে হয়। স্বাভাবিকভাবে একটি বয়সের পর প্রায় সব মানুষেরই এই সমস্যাটা হয়। আবার রোগব্যাধির কারণেও হতে পারে। বিশেষ আলজাইমার রোগের কারণে এটি বেশি হয়। এই রোগের কারণে অনেক সময় রোগী তার আত্মীয় স্বজন এমনকি তার বাসার ঠিকানাও ভুলে যেতে পারে। স্মৃতি যত দ্রুত তৈরি হয় তার চেয়েও দ্রুত তা মুছে যেতে পারে। স্মৃতি মস্তিষ্কের অল্প কিছু নিউরন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই এর যেকোন একটি নিউরন একেবারে অকেজো হয়ে পড়লে মানুষ যেকোন সময়ে তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। গবেষকরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে এমন এক উপায়ের খোঁজে যা স্মৃতির সাথে জড়িত নিউরনের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে।
বহু আগে থেকেই একটি কথা প্রচলিত যে, একটি বিষয়ে যত বেশি অনুশীলন করা হবে ততোবেশি মনে থাকবে। কথাটি সম্পূর্ণ সত্যই। কারণ যতোবেশি অনুশীলন করা হবে ততো বেশি নিউরনের সম্পৃক্তি ঘটবে।
গবেষণার ফলাফল
স্মৃতি সম্পর্কিত সকল তত্ত্ব একথাই বলে যে, কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে যতো বেশি নিউরন এনগেজ হবে সেই তথ্যের স্থায়িত্ত্ব ততোবেশি হবে। এই গবেষণার ফলাফলও এই কথা বলে যে, অধিক সংখ্যাক নিউরনের সম্পৃক্ততাই একটি স্মৃতিকে স্থায়িত্ত্ব দেয়। আর কম অনুশীলন বা কম পুনরাবৃত্তির কারণে নিউরনের যোগসংযোগ ভালো হয় না। ফলে দ্রুত সময়েই সেই স্মৃতি আমাদের জীবন থেকে মুছে যায়।
এই গবেষণা পত্রটির নাম Persistence of neuronal representations through time and damage in the hippocampus। গনজালেজ এবং লোইস এর দ্বৈত পরিচালনায় এই গবেষণাটি সম্পন্ন হয়। এর গবেষণার পেছনে ফান্ডিং করেছে, American Heart Association, Della Martin Foundation, Burroughs Wellcome Fund, এবং BRAIN Initiative grant from the National Institute of Neurological Disorders and Stroke.
তথ্যসূত্রঃ Science Daily, The Jackson laboratory
জার্নাল রেফারেন্সঃ Walter G. Gonzalez, Hanwen Zhang, Anna Harutyunyan, Carlos Lois. Persistence of neuronal representations through time and damage in the hippocampus. Science, 2019: Vol. 365, Issue 6455, pp. 821-825 DOI: 10.1126/science.aav9199
যদি কোন প্রশ্ন থাকে সাইটের কমেন্ট সেকশনে জানাবেন। অন্য কোন আর্টিকেলে তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা অবশ্যই করবো। ধন্যবাদ।