ওয়ার্মহোল সম্পর্কে শুনেছি আমরা সবাই। টাইম ট্র্যাভেলের জন্য অত্যন্ত চমৎকার একটি মাধ্যম হতে পারে ওয়ার্মহোল। যারা মুভি ফ্রীক আছে বা মুভি বেশি দেখে তারা তো অনেকবারই অনেক মুভিতে ওয়ার্মহোলের সাক্ষী হয়েছেন। “কন্টাক্ট” ছবিতে যডি ফস্টার, আবার “ইন্টারস্টেলার” ছবিতে ম্যাথিউকে আমরা অনেকেই দেখেছি ওয়ার্মহোলের যাত্রা করতে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অনেক বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে এই ওয়ার্মহোল কনসেপ্ট। কিন্তু এটা কি বাস্তবেই বিজ্ঞানে উপস্থিত?? বিজ্ঞানে কি আদৌ এর অস্তিত্ব রয়েছে?
এর উত্তর আমাদের কাছে অজানা। কেউ জানে না সঠিক উত্তর। অনেকগুলো শক্তিশালী তত্ত্ব বা থিওরি ওয়ার্মহোলের উপস্থিতি সম্পর্কে আমাদের কেবল কিছু সংকেত দেয়। তবে যদি বাস্তবেই এর উপস্থিতি থেকে থাকে, তবে মনে হয় না যে এই ওয়ার্মহোল এক্সপ্রেসের জন্য যাত্রীর অভাব হবে। কিন্তু তাই বলে এরকমটা নয় যে ওয়ার্মহোলের যাত্রা কি রকম হবে সেটা আমাদের সম্পূর্ণ অজানা। কিছুটা অন্তত আমরা কল্পনা করতে পারি।
কড়িতে কড়ি মেলানো Connect the Dots
পদার্থবিদ এলবার্ট আইনস্টাইন ও ন্যাথান রোজেন সর্বপ্রথম ওয়ার্মহোলের সম্ভাব্যতা কল্পনা করেছিলেন। সে সময়ে সিঙ্গুল্যারিটি এর ধারণাটা বেশ অস্পষ্ট এবং অগোছালো ছিলো। তাই পদার্থ থেকে সিঙ্গুল্যারিটি টার্ম টা বাদ দিতে গিয়েই তাদের মাথায় আসে ওয়ার্মহোলের কনসেপ্ট।
সিঙ্গুল্যারিটি হচ্ছে এমন এক বিন্দু যাকে নিয়ে গণিত করা অর্থ্যাৎ হিসেব করা শুরু করলে ফলাফল আসবে অসীম বা ইনফিনিটি। এটা এমন এক বিন্দু যেখানে পদার্থের সমস্ত ভর কেন্দ্রীভূত থাকে এবং ঘনত্ব অসীম।
১৯৩৫ সালের একটি রিসার্চ পেপারে আইনস্টাইন ও রোজেন পরস্পরের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বিতর্কের বিষয় ছিলো এই ওয়ার্মহোল। আইনস্টাইল তার যুক্তি দিয়ে সিঙ্গুল্যারিটি কে বাদ দিতে চেয়েছিলেন। যুক্তিটা ছিলো এরকম: “আপনি চাইলে সিঙ্গুল্যারিটি কে সম্প্রসারিত করতে পারেন। ফলে একটি চিকন রাস্তার সৃষ্টির হবে। এবং একটি সেকেন্ড লোকেশন বা দ্বিতীয় অবস্থান পাওয়া যাবে”। এটা হচ্ছে ওয়ার্মহোল। আর এর উপস্থিতি থাকলে সিঙ্গুল্যারিটির আর প্রয়োজন হচ্ছে না।
বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, ধরুণ আপনার কাছে একটি বেলুন রয়েছে। বেলুনের দুই পাশে দুটি বিন্দু রয়েছে। ধরুণ দুটি বিন্দু দুটি সিঙ্গুল্যারিটিকে নির্দেশ করছে। আইনস্টাইন ও রোজেনের মত অনুযায়ী, আপনাকে এবার বিন্দু দুটিকে ভেতরের দিকে চাপ দিতে হবে এবং বিন্দু দুটিকে মিলিয়ে ফেলতে হবে। ফলে নলাকার একটি পথ তৈরী হবে। একেই বলা হয়, আইনস্টাইন-রোজেন ব্রীজ। অধিকাংশের কাছে ওয়ার্মহোল হিসেবেই পরিচিত।
এর গ্রহণযোগ্যতা ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ছিলো না। সেসময় যখন সবাই আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি এর মাধ্যমে ব্ল্যাক হোলের ধারণা পেলো, তখন দেখা গেলো যে ব্ল্যাক হোল নিজেই এক বিশাল বড় সিঙ্গুল্যারিটি। আর সেই একই গণিত এবার হোয়াইট হোলের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা দিলো। তাত্ত্বিকভাবে যা ছিলো ব্ল্যাকহোলের সম্পূর্ণ বিপরীত।
ব্ল্যাকহোলে গ্র্যাভিটি আর ঘনত্বের মান অসীম। সেখানে কোন কিছু প্রবেশ করলে তা আর বের হতে পারে না। অপরদিকে হোয়াইট হোলে কোন কিছু প্রবেশই করতে পারে না। আরেকটি জনপ্রিয় তত্ত্ব হচ্ছে ওয়ার্মহোল একটি ব্ল্যাকহোল ও একটি হোয়াইটহোলের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। যদিও এর যৌক্তিকতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
ওয়ার্মহোলের সবচেয়ে ভালো বিষয় হলো তাত্ত্বিকভাবে এটা যেকোন দুটো স্থানের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। আবারো বলছি যেকোন দুটো স্থান। স্থান দুটো একই গ্যালাক্সির মধ্যে বা দুটো ভিন্ন গ্যালাক্সীর মধ্যেও হতে পারে। অর্থ্যাৎ ওয়ার্মহোল বাস্তব হলে টাইম ট্র্যাভেল সম্ভব হবে। কিন্তু কোন সলিড এভিডেন্স না থাকায় পদার্থে একে অসম্ভাব্যতা বা impossibility দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
দুর্ভাগ্যক্রমে, ওয়ার্মহোল নিজে মোটেও স্থিতিশীল না। এটা এতো দ্রুত খুলে আবার বন্ধ হয় যে একটি সাবএটোমিক পার্টিকেলও এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না।
এই সমস্যার সমাধানের জন্য ওয়ার্মহোলকে অবশ্যই ভেতর থেকে বাইরের কোন পদার্থ দিয়ে বাধা দিতে হবে, যার অবশ্যই থাকতে হবে ঋণাত্মক শক্তি ঘনত্ব ও ঋণাত্মক চাপ। আপনি যদি এটা করতেও পারেন তারপরেও ওয়ার্মহোলের যাত্রা করতে আপনার অনেক বেগ পেতে হবে। ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে যাত্রা করতে হলে অবশ্যই ব্ল্যাকহোল অতিক্রম করতে হবে। আর বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করে এই যাত্রা মানবদেহকে পিষে শেষ করে ফেলবে। বলতে পারেন পিষে সেমাইয়ের মতো পাতলা করে দেবে।
আজকের কল্পনা, আগামীর বাস্তবতা
বলতে গেলে আমরা ধারণা বা কল্পকাহিনীর বিশ্বে বাস করি। তাই আমরা এটা ধারণা করে নিতেই পারি বিজ্ঞানীরা একদিন এমন এক পন্থা আবিষ্কার করবেন যার ফলে হয়তো ওয়ার্মহোল যাত্রা হবে দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ যাত্রার মতো।
হয়তোবা একদিন আসবে, যেদিন টাইম ট্র্যাভেল হবে নিতান্তই ছেলেখেলা। প্রযুক্তির কল্যাণে ব্ল্যাকহোল থেকে মানুষ ঘুরে আসবে সাধারণভাবেই। ভবিষ্যতে অনেক কিছুই হতে পারে। কিন্তু কোন কিছুকেই অবাস্তব বলা যাবে না। কারণ আজকের বিশ্ব ২০০০ বছর পূর্বের মানুষের কাছেও অবাস্তব ছিলো। কল্পকাহিনী সারাজীবন কল্পকাহিনী থাকে না। তা একদিন না একদিন বাস্তবে রূপান্তরিত হয়।
তাই আশা করছি ওয়ার্মহোল যাত্রা একদিন না একদিন বাস্তবায়ন হবেই।
Leave a Reply