রসায়নে এক নতুন আবর্তন ও বিবর্তন! পর্ব-০২

গত পর্বে আমরা ২০১৮ সালের অর্থাৎ এ বছরের রসায়নে নোবেল পুরষ্কার এবং এই বিভাগে নোবেল প্রাপ্তদের সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু কথা জেনেছি। এবার আমরা তাঁদের কাজ সম্পর্কে জানব। বিশেষ করে এ পর্বে আমরা প্রফেসর ফ্রান্সেস আর্নোল্ডের কাজ নিয়ে জানতে চেষ্টা করব।

মানুষের চিন্তারও একটি সীমা আছে:
১৯৮০ সালের শেষের দিকে অন্যান্য আরও অনেক গবেষকদের মতই ফ্রান্সেস তাঁর কর্মজীবনের শুরুর দিকে কিছু চমক দেখিয়ে দেয়ার কথা ভাবতেন। তিনি তাঁর পছন্দমত ও আকাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এনজাইম তৈরির ক্ষেত্রে নির্দেশিত বিবর্তনের বিপরীত পন্থাকেই বেছে নিতে চেয়েছিলেন। এই পদ্ধতিকে বলা হয় “যৌক্তিক অভিগমন পদ্ধতি” (rational approach)। এটি এমন এক উপায় যার মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষিত ও কার্যকর বৈশিষ্ট্য প্রাপ্তির জন্য সম্পূর্ণ নতুনভাবে একটি প্রোটিন তথা একটি জটিল এনজাইম অণুর নকশা করা হয়। কিন্তু উৎসেচক এত সরল কোনো অণু নয়। সব এনজাইম বা উৎসেচক হল প্রোটিন বা আমিষ। আর সব আমিষ শত শত (এমনকি হাজারও হতে পারে) অ্যামিনো এসিডের পলিমার অর্থাৎ এক বিশাল ও জটিল কাঠামোর শিকল। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত মোট ২০ টি অ্যামিনো এসিডের নানা ও বৈচিত্র্যময় সংগঠন নিয়ে এই একেকটি প্রোটিন তথা উৎসেচক গঠিত। একটি উৎসেচক হাজারটি অ্যামিনো এসিডের অণুর সংগঠনেও তৈরি হতে পারে। এই অ্যামিনো এসিডগুলো একটি লম্বা শিকলের মত করে একটির পর একটি যুক্ত হয়ে পরবর্তীতে কুণ্ডলী পাকিয়ে ত্রিমাত্রিক গঠনবিন্যাস লাভ করে। একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্যে যে উপযোগী পরিবেশ প্রয়োজন তা অণুর উক্ত ত্রিমাত্রিক কাঠামোর মধ্যেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই বিক্রিয়া সংঘটনকারী স্থানটি “সক্রিয় স্থান” (Active site) নামে পরিচিত।
এই ক্ষুদ্র জটিল গঠনের উৎসেচককে নতুন ও আকাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য দানের জন্য পুনরায় নতুন নকশা দ্বারা পুনর্গঠন করার চেষ্টা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এমনকি সমসাময়িক জ্ঞান ও শক্তিশালী কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমেও তার জটিলতা দূর সম্ভব হয় নি।
শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির শ্রেষ্ঠত্বের কাছে মাথানত করে, ১৯৯০ সালের শেষের দিকে তিনি এই পদ্ধতি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তাঁর ভাষায় এটি এক প্রকার উদ্ধত রীতি। এর পরিবর্তে বরং তিনি প্রকৃতির নিজস্ব পদ্ধতি থেকেই তাঁর কাজের অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছেন। আর তা হল – বিবর্তন!

বিবর্তনের সাথে প্রফেসর আর্নল্ডের পথ চলা:

প্রায় কয়েক বছর ধরে প্রফেসর আর্নল্ড সাবটিলিসিন (subtilisin) নামক একটি এনজাইম পরিবর্তনের কাজ করে যাচ্ছিলেন। সাধারণত সাবটিলিসিন এনজাইমটি জলীয় দ্রবণে তার কার্যকারিতা প্রদর্শন করে। কিন্তু আরনল্ড চাইছিলেন এটি যেন ডাই মিথাইল ফরমামাইড (dimethylformamide বা DMF, ডিএমএফ) –এর মত জৈব দ্রাবকের দ্রবণেও কর্মক্ষম থাকে। এজন্য তিনি উক্ত এনজাইমের জন্য নির্দিষ্ট জেনেটিক কোড (genetic code) –এ কিছু দৈব (random) পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটান। পরবর্তীতে এই পরিবর্তিত বা মিউটেটেড (mutated) জিনগুলোকে ব্যাকটেরিয়ার কোষের মধ্যে প্রবেশ করান। ফলে ব্যাকটেরিয়ার জৈব প্রক্রিয়ার অন্তর্গত হয়ে এই জিনগুলো হাজার হাজার ভিন্ন ভিন্ন প্রকরণের সাবটিলিসিন এনজাইম উৎপন্নের মাধ্যমে তাদের প্রকাশ ঘটায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে এদের মধ্যে কোন প্রকরণটি জৈব দ্রাবকে সবচেয়ে ভালো কাজ করবে। এবার সেই যুতসই সাবটলিসিন প্রকরণকে খুঁজে বার করার কঠিন কাজটি করতে হবে।
বিবর্তনে আমরা ‘যোগ্যতমের জয়’ (survival of the fittest) কথাটির সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। নির্দেশিত বিবর্তন (directed evolution) –এর ক্ষেত্রে এই পর্যায়টি ‘নির্বাচন’ (selection) নামে পরিচিত।


সাবটিলিসিন দুগ্ধ প্রোটিন ক্যাসেইনকে ভাঙার কাজটি করে থাকে এবং আর্নল্ড এই তথ্যটিকেই কাজে লাগালেন। তিনি ৩৫ শতাংশ ডিএমএফ –এর দ্রবণে দুগ্ধ প্রোটিন ক্যাসেইন -কে সবচেয়ে কার্যকরভাবে বিশ্লিষ্ট করতে সক্ষম সাবটিলিসিন প্রকরণটি বেছে নেন। তিনি সাবটিলিসিন অণুটিতে ধারাবাহিকভাবে নতুন নতুন কয়েকটি যাদৃচ্ছিক মিউটেশন পরিচালনা করেন মূলত যার মাধ্যমেই তিনি সবচেয়ে কার্যকর প্রকরণটি খুঁজে পান। তাঁর পরিচালিত মিউটেশনের দ্বারা প্রাপ্ত সাবটিলিসিনের তৃতীয় প্রজন্মে তিনি এমন এক প্রকরণ আবিষ্কার করেন যা ডিএমএফ এর জৈব দ্রবণে প্রাথমিক বা আসল সাবটিলিসিনের চেয়ে ২৫৬ গুণ ভালো ফলাফল দিয়েছে।
এনজাইমের এই প্রাপ্ত প্রকরণটি মোট দশটি মিউটেশনের ফলস্বরূপ, যা পূর্বে কেউই এত অগ্রবর্তী কাজ করতে পারেনি। ফ্রান্সেস আর্নল্ড এর মাধ্যমে নতুন কার্যকরী কোনো এনজাইমের বিকাশের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মানুষের একান্ত যৌক্তিকতায় প্রাধান্যের পরিবর্তে সম্ভাব্যতা ও নির্দেশিত নির্বাচনের (directed selection) ক্ষমতাকে চিত্রিত করে তুলে ধরেছেন। এটাই ছিল আমাদের জন্য প্রত্যক্ষ এক বিপ্লবের প্রথম ও এর দিকে চূড়ান্ত পদক্ষেপ।
এর পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হাতে নিয়েছিলেন উইলেম পি. সি. স্টেমার (Willem P. C. Stemmer)। তিনি একাধারে একজন ডাচ গবেষক ও উদ্যোক্তা। দুর্ভাগ্যক্রমে ২০১৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এনজাইমের নির্দেশিত বিবর্তনের ক্ষেত্রে তিনি আরেকটি নতুন মাত্রার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। আর তা হল টেস্টটিউবে প্রজনন (mating)।

প্রজনন – আরও দৃঢ় অভিব্যক্তির জন্য:

বিবর্তনের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে প্রজনন। আরও সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে প্রজননের মাধ্যমে ভিন্ন দুটি জীবের জিনগুলোর মিশ্রণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উদ্ভিদের পরাগায়ন। এর মাধ্যমে উপকারী বৈশিষ্ট্যগুলো একসাথে জোড় বিন্যস্ত হয়ে আরও অধিক সহনশীল জীবের উদ্ভব ঘটাতে সক্ষম। একইসাথে, তুলনামূলক কম কার্যকর জিন এবং এর বিভিন্ন অকার্যকর মিউটেশন পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে অদৃশ্য বা অনুপস্থিত থাকার দরুন একসময় হারিয়ে যেতে পারে।
উইলেম স্টেমার প্রজননের মত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতিকে একেবারে টেস্টটিউবের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। কাজটি তিনি করেছেন ডিএনএ শাফলিং (DNA shufing) –এর মাধ্যমে। ডিএনএ শাফলিং এমন এক পদ্ধতি যার মাধ্যমে উপকারী মিউটেশনগুলোকে নির্দেশিত বিবর্তনের দ্বারা অতিদ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। ১৯৯৪ সালে তিনি দেখান যে, একটি জিনের বিভিন্ন অংশকে ছোট ছোট অংশে বা টুকরোয় বিভক্ত করে সেগুলোকে ডিএনএ প্রযুক্তি সংক্রান্ত আণবিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে নতুনভাবে বিন্যস্ত করে পুনরায় সম্পূর্ণ একটি জিনে পরিণত করা সম্ভব। সেই নতুনভাবে বিন্যস্ত জিনটি মূলত সেই আদি বা আসল জিনটির মোজাইক রূপ।
ডিএনএ শাফলিং –এর কয়েকটি চক্র পরিচালনার মাধ্যমে উইলেম স্টেমার একটি এনজাইমের গাঠনিক বিন্যাসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি এনজাইমটিতে এজন্য উক্ত পরিবর্তন আনেন যাতে করে সহজাত কাঠামোতে প্রদত্ত কর্মক্ষমতার তুলনায় আরও বেশি কার্যকর ক্ষমতা সম্পন্ন হতে পারে।
গবেষকগণ এই পদ্ধতিতে আক্ষরিক অর্থেই পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়া বা রিকম্বিনেশন (recombination) নামে অভিহিত করেন। স্টেমারের ডিএনএ শাফলিং এ ব্যবহৃত পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়া এটাই স্পষ্ট করে যে, একাধিক জিনের মিলনের মাধ্যমে কোনো এনজাইমের তুলনামূলক আরও কার্যকর ও কাঙ্ক্ষিত বিবর্তন সম্ভব।

নতুন এনজাইম দ্বারা উন্নতমানের জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন:

১৯৯০ সালের শুরু থেকেই ডিএনএ প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত নানা যন্ত্রপাতির সংস্কার সাধিত হয়ে আসছে। একই সাথে নির্দেশিত বিবর্তন পদ্ধতিরও নানা সংস্করণ বের হয়েছে যা খুব দ্রুতই বিজ্ঞানীমহলে প্রচলিত হয়ে গেছে। এসব মানোন্নয়নমূলক পরিবর্তনের একদম অগ্রবর্তী পদে ছিলেন ২০১৮ তে রসায়নে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ফ্রান্সেস আর্নোল্ড।
তাঁর পরীক্ষাগারে উৎপন্ন এনজাইম প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সহজাত যেকোনো এনজাইমের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। তাঁর এই এনজাইম বা উৎসেচকগুলো তাদের ভিন্নধর্মী বিক্রিয়ার সাহায্যে একেবারে নতুন পদার্থ উৎপন্ন করতে পারে, যা পূর্বে প্রকৃতিপ্রাপ্ত বা জৈবিক এনজাইমগুলো থেকে পাওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁর এই স্ব- নকশাকৃত এনজাইমসমূহ বর্তমানে ঔষধশিল্পের মত অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বেশ সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তাঁর এই উদ্ভাবনের ফলে রসায়নের কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। সেসব হচ্ছে,
ক) বিক্রিয়ার হার আরও বৃদ্ধি
খ) আরও কম পরিমাণ উপজাত উৎপাদন
গ) কিছু ক্ষেত্রে সহজাত এনজাইমের মত কোনো রকমের ভারী ধাতুর (ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, লোহা, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম ইত্যাদি) সাহায্য ছাড়াই রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পাদন।
শুধু তাই নয়, এই পরিবর্তনগুলো পরিবেশকে নানা ক্ষতিকর প্রভাব থেকে অনেকাংশেই বাঁচিয়ে রাখছে।
এসবের পাশাপাশি প্রফেসর আর্নোল্ড নবায়নযোগ্য জ্বালানীর উৎপাদন নিয়েও কাজ চালিয়ে গেছেন। তাঁর গবেষক দল এমন এক এনজাইমের উদ্ভব ঘটিয়েছে যার দ্বারা সরল চিনি (যেমন – গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ) কে আইসোবিউটানল (isobutanol) –এ রূপান্তর করা সম্ভব। আইসোবিউটানল জ্বালানীর একটি উৎকৃষ্ট উৎস হিসেবে পরিচিত। এর দহনের দ্বারা প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়। আসলে, প্রফেসর আর্নোল্ড এবং তাঁর গবেষকদল আইসোবিউটানলের এহেন উৎপাদনের মাধ্যমে একটি পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। আইসোবিউটানল একই সাথে জৈবজ্বালানী এবং পরিবাশবান্ধব প্লাস্টিক (greener plastics) উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে।
তাঁদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আরও পরিবেশবান্ধব ও সবুজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী পরিবেশবান্ধব জ্বালানীর উৎপাদন। প্রফেসর আর্নোল্ডের নিজের ডিজাইনকৃত উৎসেচক তথা প্রোটিন থেকে উৎপাদিত এই বিকল্প জ্বালানী গাড়িসহ উড্ডয়কযান অর্থাৎ উড়োজাহাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে! ভাবতে পারছেন কতটা চমকপ্রদ উপায়ে তাঁর উদ্ভাবিত এনজাইম একটি সবুজ পৃথিবী গড়ে তোলার জন্যে কাজে লাগছে, যা কিনা আগে শুধুমাত্র জৈবপ্রভাবক (biocatalyst) হিসেবেই পরিচিত ছিল।
প্রফেসর আর্নোল্ড তাঁর এই মেধাবৃত্তিক ও পৃথিবীকে আমূল বদলে দেওয়ার মত কাজের জন্যই এ বছর রসায়নে নোবেল পুরষ্কারের অর্ধেক পরিমাণ অর্জন করে নেন। পরবর্তী পর্বে আমরা এ নোবেল যাত্রার অন্য দুই সারথী – জর্জ পি স্মিথ এবং স্যার গ্রেগরি পি উইন্টার এর কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারব। ধন্যবাদ।

তথ্যসূত্র: নোবেল কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত

গত পর্ব যারা মিস করেছেনঃ

রসায়নে এক নতুন আবর্তন ও বিবর্তন – পর্ব ১

Comments are closed.