মানবদেহের যন্ত্রকাহিনীঃ পর্ব ২ (রক্ত)

মানবদেহের যন্ত্রকাহিনী নামক আমাদের এই ধারাবাহিক লেখার প্রথম পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম হৃৎপিন্ড নিয়ে। (প্রথম পর্বের লিঙ্কঃ https://bigganbortika.org/human-heart-part-1/)
আজ আমরা হাজির হয়েছি এর ২য় পর্ব “রক্ত” নিয়ে। রক্ত আমাদের দেহে অতটাই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যতটা একটা যন্ত্রের জন্যে সেটার ভেতরে থাকা বিদ্যুৎ পরিবাহী তার বা মাধ্যমগুলো হয়ে থাকে। এটি ক্রমাগতই আমাদের দেহে ছুটে চলেছে প্রত্যেকটা আনাচে কানাচেতে। ঠিক যেমন করে মেশিনের ভেতরের পুরোটা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তার বিদ্যুৎ সর্বরাহ করে চলে এর আনাচে কানাচে।
মানবদেহের এই বিষ্ময় এর নানা জানা অজানা দিক আমাদের নিয়েই তাই আমরা আমাদের ২য় পর্বের আয়োজন করেছি। চলুন তাহলে কালবিলম্ব না করে চলে যাওয়া যাক আলোচনায়…


একথা অনেকের কাছেই হয়তো বলা বাহুল্য যে রক্ত হচ্ছে তরল যোজক কলা বা Liquid Connective Tissue । অন্যান্য রক্ত সংবহনতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত প্রাণির মত আমাদের বেলাতেও এই রক্ত শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় উপদান সারা শরীরে ঘুরে ঘুরে প্রদান করে থাকে। পাশাপাশি শরীর থেকে অনেক বর্জ্য এবং শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কার্বন ডাই অক্সাইডও বয়ে নিয়ে বের করার কাজ করে। দেহের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যায়ে প্রতিমুহুর্তে প্রয়োজনীয় উপাদান পৌছে দেয়ার জন্যে তরল কোনো বাহকের বিকল্প নেই। কারণ আমাদের দেহ সরাসরি বৈদ্যুতিক আধানে না চলে জৈবিক আর কোষীয় প্রক্রিয়ায় চলে, যেক্ষেত্রে সেগুলো সচল থাকার জন্যে প্রতিনিয়ত প্রয়োজন পড়ে নির্দিষ্ট ধরনের ইন্ধন গ্রহণ করার আর সেই ইন্ধন কাজে লাগানো শেষে দেহ হতে উৎপন্ন বর্জ্য বের করে দেয়ার। আর আমাদের দেহের ক্ষেত্রে সেই ইন্ধনটি হল অক্সিজেন, যাকে আণবিক পর্যায়ে দেহের আনাচে কানাচে পৌছে দেয়ার জন্যে রক্তের মত চমৎকার মাধ্যমের বিকল্প নেই!
বিশেষ করে আমার দেহের চালক, মস্তিষ্কের কাছে তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পৌছে দিতে!
অপরপক্ষে ইঞ্জিন থেকে যেমন বর্জ্যরুপে ধোঁয়া বের হয় তেমনি কার্বন ডাই অক্সাইড আমাদের দেহ থেকে প্রতি মূহুর্তের কাজ শেষে অবশিষ্ট বর্জ্যরুপেই বের হয়ে যায়।
এই দুইমুখী কাজের জন্যে সারাদেহের রক্তসঞ্চালন ব্যবস্থা (Blood Circulatory System) দুই ভাগে বিভক্ত।
১. Systemic Circulation : যাতে রক্ত দেহের একেবারে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যায়ের গিয়ে কোষসমূহে অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌছে দেয়।
২. Pulmonary Circulation : এই ব্যবস্থায় অক্সিজেন ফুসফুস থেকে রক্তে মিশে। এবং বর্জ্যযুক্ত Deoxygenated রক্ত ফুসফুসের সাহায্যে কার্বন ডাই অক্সাইড বাইরে বের করে দেয়।


দুটো ব্যবস্থাই একসাথে সম্পৃক্ত। দুটো ব্যবস্থাতেই রক্ত একই পথ ধরে ঘুরে আসে পার্থক্য হল মাঝে যাবার পথে একবার এটি অক্সিজেন নেয়, আরেকবার তা ছড়ায়। এবং আবারো অক্সিজেন নেবার জন্যে ফুসফুসের কাছেই ফিরে আসে। আমাদের দেহের রক্তের মধ্যে অক্সিজেন সমৃদ্ধগুলোর রঙ উজ্জ্বল লাল আর কার্বন ডাই অক্সাইড সমৃদ্ধ Deoxygenated রক্ত গাড় খয়েরী রঙের দেখায়।

রক্তের এই পুরো সংবহনের কাজটা মূলত পরিচালনা করে থাকে হৃৎপিন্ড। হৃৎপিন্ড তা কিভাবে আর কোন প্রক্রিয়ায় করে তা প্রথম পর্বেই উল্লেখ করা আছে।

রক্তের গঠণ

রক্তের গঠণ উপাদান বলতে সাধারণ অর্থে পাঠ্যপুস্তকগুলোতে রক্তের গঠণ উপাদান হিসেবে তিনধরণের কণা আর রক্তরস বা প্লাজমার কথা বলা হলেও এছাড়া রক্তে দেহনিসৃত আরো বহু উপাদান থাকে। তবে রক্তের মূল গঠণ উপাদান এর কণা আর রক্তরস হওয়াতে প্রাথমিকভাবে তা নিয়েই আলোচনা করা হয়।

রক্তের মূলত দুটিই উপাদান।
১. রক্তকণিকা বা রক্তকোষ (Blood Cells)
২. রক্তরস বা Plasma

১. রক্তকোষ (Blood Cell)

রক্তকোষ হচ্ছে রক্তের পরিচায়ক। অর্থাৎ এটার মাধ্যমেই রক্ত তার রক্ত হিসেবে পরিচয় লাভ করে। এই রক্তকণাগুলোই শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অক্সিজেন নিয়ে যাওয়া, সেসব জায়গা থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ে আসা, শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার মত আবশ্যিক কাজগুলো করে থাকে।
গর্ভকালীন অবস্থায় ভ্রুণের প্রাক্কালে এইসব রক্তকোষ মূল অঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত Yolk Sac এ থাকা Blood Island নামক অংশ থেকে উৎপন্ন হয়। পরিপূর্ণ গঠিত দেহে মেরুরজ্জু বা Bone Marrow মূলত এই কাজটা করে থাকে। এছাড়া লম্বাটে বীজ আকৃতির লিম্ফ নোড (Lymph Node) এবং প্লীহা বা Spleen ও এই কাজের শামিল।


রক্ত উৎপন্নের মূল কাজ মেরুরজ্জু করে থাকে বিধায় এর গুরুত্ব আমাদের দেহে অপরিসীম। আর তাই বোন ম্যারো ক্যান্সার এতটা ভয়ানক!
শরীরের এই রক্তকোষগুলোর পরিমাপ নির্ণয়ের জন্যে প্রায়সময়েই ডাক্তাররা অনেককে একটি টেস্ট দিয়ে থাকে, যাকে আমরা CBC নামে চিনি। যার পূর্ণরুপ Complete Blood Count ।

রক্তকোষ ৩ ধরণের হয় এটা অনেকের কাছে বলা বাহুল্যই।

i. লোহিত রক্তকণিকা বা Red Blood Cell বা RBC বা Erythrocyte

প্রাচীন গ্রীক শব্দ এরিথ্রো (Erythro) মানে হচ্ছে লাল। আর সে থেকেই এই কোষের নাম Erythrocyte । যাকে বাংলায় আমরা লোহিত রক্তকোষ বলে থাকি। রক্তকোষ দেহের মোট রক্তের গড়ে ৪৫% অংশ জুড়ে রয়েছে। আর মোট রক্তকোষের প্রায় পঁচানব্বই ভাগ জুড়েই রয়েছে এই লোহিত রক্তকণিকা। রক্তকোষগুলোর মধ্যে এটি সবচে জরুরী কাজটি করে থাকে। আর তা হল অঙ্গসমুহ (Organs) এবং কোষে কোষে অক্সিজেন পৌছে দেয়া এবং সেখান থেকে কার্বণ ডাই অক্সাইড নিয়ে আসা। RBC এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে Hemoglobin এর সাহায্যে যা মূলত একধরণের লৌহ সমৃদ্ধ আমিষ বা প্রোটিন। আর এ থেকেই এই কণার রঙ লাল আর এ থেকেই এর নাম “লোহিত” রক্ত কণিকা। তাই কোনো কারণে দেহে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে ব্যাপারটা খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আর তাই RBC এর ঘাটতিকেই আমরা এক কথায় রক্তশুন্যতাও বলে থাকি।


অন্য কণাগুলোর মত RBC ও মেরুরজ্জু বা বোনম্যারো’র hematopoietic stem cells থেকেই উৎপন্ন হয় একান্তই erythropoiesis প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
সচরাচর প্রাপ্তবয়স্কে মানুষের দেহ গড়ে প্রতি সেকেন্ডে ২৪ লাখ বা ২.৪ মিলিয়ন RBC উৎপন্ন করে যাদের প্রতিটার আয়ু ১০০-১২০ দিন, অর্থাৎ ৪ মাস। আর তাই রক্তদানের জন্যে সময়সীমার নিরাপদ ব্যবধান ধরা হয় ৪ মাস। আয়ুষ্কাল শেষে এই RBCগুলো প্লীহা দ্বারা নিষ্কাশিত হয়।

ii. শ্বেত রক্তকণিকা বা WBC বা Leukocyte

প্রাচীন গ্রীক শব্দ Leukos মানে উজ্জ্বল বা হাল্কা রঙ বা অনেকক্ষেত্রে সাদা। এই রক্তকোষগুলো শ্বেতবর্ণের হওয়াতে তাই এই নাম।
WBC হল আমাদের দেহের রক্ষাকবচ। এদের বিভিন্ন ধরণ বিভিন্নভাবে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্রিয়া সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে এবং রোগজীবাণুর সাথে লড়াই করে দেহকে সুস্থ রাখে।


দেহের মোট রক্তের পরিমাণে WBC এর হার খুবই কম। মাত্র ১%। কিন্তু এই ১% ই আমাদের দেহের জন্যে অন্তত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঠিকঠাক সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা এই মাত্রা খুব কমে গেলে যেমন সমস্যা, তেমনি খুব বেড়ে গেলেও ঝামেলা। তাই CBC রিপোর্টে WBC এর মাত্রা/ মাইক্রোলিটার ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখাটা খুবই জরুরী হয়ে থাকে।
সচরাচর WBC প্রতি লিটারে ৪০০ কোটি থেকে ১১০০ কোটি এবং প্রতি মাইক্রোলিটারে ৪০০০ থেকে ১১০০০ করে থাকে। এটা রোগজীবাণু ধ্বংসের কাজে নিয়োজিত থাকলেও এর মাত্রা এই সীমার নীচে গেলে বা উপরে গেলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বা বড় সমস্যাও হতে পারে। তবে রোগবালাই এর সাথে লড়াই করার সময় এই মাত্রা খানিক বাড়তে পারে। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া স্বতস্ফূর্তভাবে এই মাত্রা বেড়ে যাওয়াটা বড় কোনো রোগের লক্ষণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এদের কোষদেহে নিউক্লিয়াস থাকে, যা অন্য দুই কোষে পাওয়া যায়না। এছাড়া এদের মধ্যে বৈচিত্রতাও বেশি।
মূলত অতিক্ষুদ্র দানাদার পদার্থ গ্রান্যুল (Granule) এর উপস্থিতি আর অনুপস্থিতির উপর ভিত্তি করে এদের আবার Granulocyte ও Agranulocyte এই দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। এই গ্র‍্যান্যুল হল রক্তের রোগবালাইয়ের ঘাতক, যা Degranulation প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোগ বালাই ধ্বংস করার কাজে যোগদান করে।
গ্র‍্যান্যুল এর উপস্থিতি অনুসারে দুইভাগে বিভক্ত কোষগুলো হলঃ

গ্র‍্যান্যালুসাইট এঃ

(a) Basophil (রোগজীবাণু প্রতিরোধ করে, সেরোটনিন উৎপন্ন করে, কোষভক্ষণ বা phagocytosis করে এবং রক্ত জমাটে সাহায্য করে।)

(b) Eosinophil (বহুকোষী পরজীবীদের সাথে লড়াই করে)

(C) Neutrophil (সংক্রমিত স্থান নির্ণয় করে সেখানে পৌছায় ও প্রতিরোধে কাজ করে)

(d) Mastocyte বা Labrocyte বা Mast Cell (এরা অন্যান্য কোষসহ স্নায়ুকোষকে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে)

এ্যাগ্র‍্যান্যুলোসাইটে রয়েছেঃ
(a) Lymphocyte (রোগজীবণু আর বাহ্যিক বিষাক্ত কিছুর সংক্রমন খুঁজে সেগুলোর বিরুদ্ধে কাজে লাগায় নিজেকে)

(b) Monocyte (এ্যান্টিজেন এর উপস্থাপন, সাইটোকিন উৎপন্ন এবং কোষ ভক্ষণ করে থাকে।)

সকল শ্বেত রক্তকোষই মেরুরজ্জুর hematopoietic stem cells থেকে উৎপন্ন হয়। ধরণের উপর ভিত্তি করে এরা ১২ ঘন্টা (লিম্ফোসাইট) থেকে শুরু করে দুই সপ্তাহ (ব্যাসোফিল) পর্যন্ত বেচে থাকতে পারে।
WBC এর মাত্রা অতিরিক্ত পরিমাণে কমে গেলে তাকে Leukopenia এবং মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে গেলে তাকে Leukocytosis বলে।
WBC এর অস্বাভাবিক বেশি এবং অনিয়ন্ত্রিত উৎপাদনের অবস্থাই পরে ব্লাড ক্যান্সারের রুপ ধারণ করে। আর তাই একে লিউকেমিয়াও বলা হয়।

iii. অণুচক্রিকা বা Platelets বা Thrombocyte

অণুচক্রিকা হল রক্তের তঞ্চক। মানে জমাট বাধানোর কাজে নিয়োজিত কোষ। এরা সুতোর মত তন্তুময় অংশের মত করে রক্তকে জমাট বাধায়।


অণুচক্রিকাদের পরিমাণও দেহের মোট রক্তের পরিমাণে খুবই কম (১%) এবং এটি এই নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকাটাই দেহের জন্যে প্রয়োজনীয়। এদের মাত্রা কমে গেলে দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হওয়া শুরু করে যা আমরা ডেঙ্গ্যুসহ বিভিন্নধরণের ভাইরাসজনিত রোগবালাইয়ে দেখে থাকি। আবার এদের মাত্রা বেড়ে গেলেও রক্ত সংবহনতনন্ত্রের যেকোনো জায়গায় শিরা/উপশিরায় রক্ত জমাট বেধে যে কোনো ধরণের প্রাণঘাতি অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে।
অণুচক্রিকাদের গড় আয়ু ৫-৯ দিন।

২. Plasma বা রক্তরস

এইযে তিন ধরণের রক্তকোষ এরা মূলত এই প্লাজমা বা রক্তরসেই নিমজ্জিত থাকে। আর তাই রক্ত এমন তরল আকার ধারণ করে থাকে। রক্তের গড়ে ৫৫% ই হচ্ছে এই রক্তরস, যা মানবদেহের বায়বীয় বর্জ্য নিষ্কাশন থেকে শুরু করে অক্সিজেনবাহী হিমোগ্লোবিনকে নিয়ে কোষের খাঁজে খাঁজে পৌছানোর মত বহু গুরুত্বপূর্ণ আর অপরিহার্য কাজ সম্পাদন করে থাকে।


রক্তরসের ৯৫% ই হচ্ছে পানি। বাদবাকি ৫% এর মধ্যেই থাকে রক্তের বাকি উপাদান যেমন : সিরাম এ্যালবুমিন (Serum Albumin)(54-55%) , গ্লোবুলিন (Globulin)(37-38%) ও ফাইব্রিনোজেন (Fibrinogen)(7%) নামের দরকারী প্রোটিন। বলা বাহুল্য এইসব প্রোটিনের মধ্যে এ্যালবুমিনের মাত্রাই বেশি। এগুলা বাদে যে সামান্য অংশ অবশিষ্ট থাকে সেগুলোতে থাকে বাদবাকি প্রোটিন আর এনজাইম। এছাড়াও রক্তরসে মিশে থাকে আমাদের দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিসৃত হরমোন। থাকে অক্সিজেন আর কার্বন ডাই অক্সাইড।
রক্তে, প্লাজমা আদর্শ দ্রাবকের মত কাজ করে। এটিই সাথে করে নিয়ে বেড়ায় সমস্ত রক্তকোষ, ভিটামিন, প্রোটিন, এনজাইম, লিপিড, কোলেস্টোরেল, অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড সহ নানা উপাদান। যার কতগুলো শরীরে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে লাগে, তো আবার কতগুলো শরীর থেকে বের করে দেয়ার কাজে লাগে। আবার কতগুলো নির্দিষ্ট ও বিশেষ সময় সময়ে শরীরে মিশে যাবার কাজে লাগে। যেমন বিভিন্ন ধরণের হরমোন।

রক্তের গ্রুপ

রক্তের গ্রুপ বলতে আসলে রক্তের লোহিত রক্তকোষে (RBC) তে বিভিন্ন ধরণের এ্যান্টিজেন এবং এ্যান্টিবডি এর উপস্থিতি/অনুপস্থিতি বুঝায়। রক্তের গ্রুপের ভিন্নতা অনুযায়ী এই এ্যান্টিজেনসমূহ প্রোটিন, গ্লাইকোপ্রোটিন, শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট ও বিভিন্ন ধরণের গ্লাইকোলিপিড সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। এছাড়াও রক্তে RH নামক বিশেষ ধরণের প্রোটিন উপাদান এর উপস্থিতি/অনুপস্থিতির উপর নির্ভর করে গ্রুপের +/- বা পজিটিভ/নেগেটিভ নির্ণয় করা হয়। এই প্রোটিন ফ্যাক্টরটি Rhesus বানরদের শরীরের কমন ফ্যাক্টর বলেই তাদের গণের নামের দুই অদ্যাক্ষরে এদের Rh ফ্যাক্টর বলে।
নির্দিষ্ট কিছু জিন ও এদের নির্দিষ্ট অবস্থানের কারণে উক্ত ফ্যাক্টর ও এ্যান্টিজেনগুলোর মাঝে তারতম্য দেখা দেয়।
এই তারতম্যে লোহিত রক্তকোষে ভিন্ন ভিন্ন ৩৪৬ টি এ্যান্টিজেন এবং অণুচক্রিকায় ৩৩ ভিন্ন ভিন্ন এ্যান্টিজেন দেখা যায়। এগুলোর তারতম্যের উপর নির্ভর করে পৃথিবীতে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের জন্যে ৩৬ টি ব্লাড গ্রুপিং গ্রুপিং সিস্টেম গড়ে তোলা হয়েছে। যার মাঝে ABO এবং Rh সিস্টেম সবচাইতে বেশি প্রচলিত। এই সিস্টেমে কমন এ্যান্টিজেনগুলোকে মূল দুটো গ্রুপে ভাগ করা হয় যার একটি A (A Oligosaccharide সমৃদ্ধ) এবং অপরটি B (B oligosaccharide সমৃদ্ধ)। এবং উভয় এ্যান্টিজেন এর সমন্বিত বৈশিষ্ট্যের রক্তকোষগুলোকে ভাগ করা হয় AB গ্রুপে (A ও B উভয় Oligosaccharide উপস্থিত)। এবং যে গ্রুপে উভয় গ্রুপের কোনো এ্যান্টিজেন থাকেনা, কেবল তাদের Precursor H Oligosaccharide থাকে, তাদের O (মানে শুন্য) এ ফেলা হয়।
A গ্রুপকে টক পানি আর B গ্রুপকে মিষ্টি পানি মনে করলে O কে আমরা বিশুদ্ধ পানি ধরতে পারি। যার ফলে একে অন্য দুটোর কাজেই লাগানো যেতে পারে। তাই O গ্রুপকে স্বার্বজনীন দাতা বা Universal Donor বলা হয়।
দ্বিতীয় গ্রুপিংটা হচ্ছে Rh গ্রুপিং। রক্তের ৪৯ টি এ্যান্টিজেন নিয়ে এই Rh গ্রুপিং সিস্টেম গঠিত যার মাঝে D, C, c, E এবং e সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রক্তে এই এ্যান্টিজেনগুলোর তারতম্যের এবং উপস্থিতি ও ঘাটতির উপর নির্ভর করে রক্তের গ্রুপ Rh এর বিবেচনায় + না – ।
রক্তের এইসব এ্যান্টিজেনসমূহ না মিললে তারা অচিরেই রক্তকে জমাট বাধানো শুরু করে দেয়। যার ফলাফল খুব দ্রুত, খুবই ভয়াবহ হতে পারে।
রক্তের এই এ্যান্টিজেনগুলো নির্দিষ্ট কোনো ইনিফেকশনে বদলে যেতে পারে। আবার কোনো কারণে কারো Bone marrow বা মেরুরজ্জু প্রতিস্থাপন করা হলে তার গ্রুপও বদলে যে গ্রুপের মেরুরজ্জু প্রতিস্থাপন করা হল তাতে চলে আসতে পারে।
রক্তদানের ক্ষেত্রে তাই যতই নিশ্চিত হোন না কেনো, অবশ্যই আগে ক্রসম্যাচিং করিয়ে নেয়া উচিত।

রক্তের বিভিন্ন প্রকার রোগসমুহ

রক্তের রোগসমূহ বা Blood Disorder রক্তকোষ ও রক্তরসের উপর নির্ভর করে ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। কোনোটা আবার ঘাটতিজনিত, তো কোনোটা আবার আধিক্যের কারণে হয়।

RBC বা Erythrocyte এর রোগসমূহ।

1. এনিমিয়া (Anemia):

সহজ ভাষায় রক্তস্বল্পতা। লোহিত রক্তকোষের ঘাটতির জন্যে এ রোগ হয়। খাদ্যপুষ্টির অভাব এর অন্যতম কারণ। এনিমিয়ার মাঝে রয়েছেঃ

i. Iron-deficiency Anemia
লোহিত রক্তকোষে আয়রণ বা লৌহের ঘাটতির জন্যে হয়। সচরাচর মাসিকের সময় অধিক রক্তক্ষরণ ও লৌহখনিজসমৃদ্ধ খাদ্য কম গ্রহণ থেকে এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়।

ii. Anemia of chronic disease
অন্যান্য বিভিন্ন রোগবালাই থেকে এই সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। বিভিন্ন ক্রনিক ডিজিজ থেকে এধরণের এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে।

iii. Pernicious anemia (B12 deficiency)
এধরণের রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় যখন শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে B12 ভিটামিন নিতে বাধাগ্রস্ত হয়। পাকস্থলীর দুর্বলতা বা এমনকি স্নায়ুর সমস্যার জন্যেও এমনটা হতে পারে।

iv. Aplastic anemia
সবচে ভয়ানক ধরণের রক্তস্বল্পতার একটি। এটি তখন হয় যখন মেরুরজ্জু নতুন করে পর্যাপ্ত পরিমাণে RBC উৎপন্ন করতে পারে না। মাদকাসক্তি, ঔষধের অধিক ব্যবহার, গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতা, এইডস, মেরুরজ্জুর সমস্যা ইত্যাদি কারণে এই এনিমিয়া দেখা দেয়।

v. Autoimmune hemolytic anemia
এ আরেক ভয়াবহ এনিমিয়া। এতে শরীরের নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই নিজেই নিজের RBCদের ধ্বংস করা শুরু করে দেয়। এমতাবস্থায় জরুরী চিকিৎসাব্যবস্থা অত্যাবশ্যক।

vi. থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia)

রক্তস্বল্পতার মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ রোগ হল এই থ্যালাসেমিয়া!
এটি একটি জিনগত রোগ। অর্থাৎ এটা অনেকটা ফ্যাক্টরি মেইড ডিজিজের মত মানুষ নিয়েই জন্মায়। কোনো কারণে যদি বাবা বা মা বা উভয়েই বাহক হয়, সেক্ষেত্রে সন্তান্তের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। তবে বাহক যদি শুধুমাত্র যে কেউ একজন হয়, সেক্ষেত্রে তার সন্তানের গুরুতর কোনো থেলাসেমিয়া হবার কোনো সম্ভাবনাই থাকেনা। এক্ষেত্রে সন্তানের Minor Thalassemia হবার সম্ভাবনা থাকে যাতে রক্তস্বল্পতা খুবই কম মাত্রায় দেখা যায় এবং সন্তানকে মূলত থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হিসেবে না ধরে এর বাহক হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বাবা মা উভয়েই এর বাহক হলে সেক্ষেত্রে Alfa বা Beta Thalassemia দেখা দিতে পারে যার মাঝে Thalassemia Major খুবই ভয়াবহ।
থ্যালাসেমিয়া মূলত RBC এর জিনগত ত্রুটির কারণে হিমোগ্লোবিনের অস্বাভাবিক অবস্থা এবং আলফা ও বিটাগ্লোবিন জিনসমুহের অনুপস্থিতির কারণে হয়।

vii. Sickle cell anemia
আফ্রিকা, মধ্য আমেরিকা, ইন্ডিয়া, সৌদি আরব, তুর্কী, গ্রীস, ইতালি প্রভৃতি দেশ থেকে আগত পূর্বপুরুষদের থেকে জীনগত সুত্রে পাওয়া রক্তস্বল্পতা।

2. Polycythemia vera

এই রোগে শরীর কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মাত্রাতিরিক্ত RBC উৎপন্ন করে। যার দরুণ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্ত জমাট বাধার মত ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে।

3. Malaria

বলা বাহুল্য যে ম্যালেরিয়ায় মশা থেকে জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে RBC গুলোকে সংক্রামিত করে। ফলস্বরুপ সংক্রামিত RBC দেহের বিভিন্ন অঙ্গে পৌছে ঔ অঙ্গসমূহেরো ক্ষতি করা শুরু করে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগী অতিদ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থা না নিলে মারা যেতে পারে।

WBC বা শ্বেত রক্তকোষের রোগসমূহ

১. Lymphoma
একধরণের ব্লাড ক্যান্সার যা লসিকাতন্ত্রে (lymph system) উৎপন্ন হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে। বহু ধরণের Lymphoma রয়েছে। যার মধ্যে Hodgkin’s lymphoma এবং non-Hodgkin’s lymphoma প্রধান।

২. লিউকেমিয়া (Leukemia)
ব্লাড ক্যান্সারের মধ্যে এটাই আমাদের কাছে সবচে পরিচিত। লিউকেমিয়া মেরুরজ্জুতে বেড়ে উঠতে থাকে এবং গুণোত্তর হারে এতে WBC এর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে।

৩. Multiple myeloma
আরেকটি ব্লাড ক্যান্সারের জাত, যাতে WBC এর প্লাজমা কোষ বেড়ে অঙ্গগুলোকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে থাকে।

৪. Myelodysplastic syndrome
ব্লাড ক্যান্সারের একটি গোত্র যা মেরুরজ্জুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি খুবই ধীর গতিতে ছড়ায় এবং হঠাৎ করেই লিউকেমিয়ার রুপ ধারণ করতে পারে।

Platelet বা অণুচক্রিকার রোগ

১. Thrombocytopenia
অণুচক্রিকার অভাবে এ রোগ দেখা দেয়। রক্তক্ষরণ এর মূল লক্ষণ।

২. Idiopathic Thrombocytopenic Purpura
এটিও অণুচক্রিকার স্বল্পতাজনিত রোগ, তবে এ রোগে সচরাচর তেমন কোনো বাহ্যিক লক্ষণ প্রকাশ পায়না।

৩. Heparin -induced thrombocytopenia
জমাট বাধা রক্তকে তরল করতে ব্যবহৃত Heparin এর অধিক ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বরুপ এই সমস্যা দেখা দেয়। এটিও একধরণের ঘাটতিজনিত রোগ।

৪. Thrombotic thrombocytopenic purpura
রক্তনালিতে জায়গায় জায়গায় রক্তজমাট বাধাজনিত সমস্যা।

. Essential thrombocytosis (primary thrombocythemia)
অণুচক্রিকার অস্বাভাবিক উৎপাদনের ফলে সৃষ্ট রোগ। এতে রক্ত জমাট ও ক্ষরণের সমস্যা দেখা দেয়।

Plasma বা রক্তরসের রোগসমূহ

১. হিমোফিলিয়া (Hemophilia)
অনেকেই এই রোগের নাম শুনেছি হয়তো। এটি একটি জিনগত প্লাজমার রোগ, যাতে রক্ত ঠিকমত জমাট বাধতে পারেনা।

২. Von Willebrand disease
Von Willebrand একটি প্রোটিন ফ্যাক্টর যা রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে। আর এই রোগে হয় এই প্রোটিন ফ্যাক্টর ঠিকমত উৎপন্নই হতে পারেনা, নাহয় উৎপন্ন হলেও তা কার্যকরী থাকেনা।

৩. Hypercoaguable state
অত্যন্ত বাজে এক রোগ। এই রোগে থেকে থেকেই রোগীর দেহে রক্ত জমাট বেধে যায়। ফলস্বরূপ মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে তাদের নিয়মিত রক্ত লঘুকারক ইঞ্জেকশন নেয়া লাগে।

৪. Deep venous thrombosis
এই রোগে রক্ত দেহের গভীরে থাকা ধমনীগুলোয় জমাট বাধে এবং জমে যাওয়া রক্ত হৃৎপিণ্ড বা অন্যত্র গিয়ে মৃত্যুঝুঁকি বাড়াতে পারে।

৫. Disseminated intravascular coagulation (DIC)
শরীরের বিভিন্ন স্থানে অল্প অল্প পরিমাণে ছোপ ছোপ রক্ত জমাট বাধে এবং রক্তক্ষরণ হয়।

তো এই ছিল আমাদের মানবদেহের যন্ত্রকথার ২য় পর্বের আয়োজন। পরবর্তী পর্ব নিয়ে হয়তো শীঘ্রই হাজির হবো ।
ততক্ষণে ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিজের খেয়াল রাখুন আর বিজ্ঞানবর্তিকার সাথেই থাকুন।

তথ্যসূত্রঃ

webmd.com

health.howstuffworks.com

ncbi.nlm.nih.gov

আগের পর্ব যারা মিস করেছেনঃ

মানবদেহের যন্ত্রকাহিনী : পর্ব ১ (হৃৎপিন্ড)

Comments are closed.