এমন কি কখনো ভেবেছেন যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আপনার যেতে সময় লাগবে মাত্র কয়েক ঘন্টা? অথবা এক শহর থেকে আরেক শহর যার দূরত্ব কয়েকশো মাইল সেটা আপনি মাত্র ১ ঘন্টায় পাড়ি দিবেন? যদি ভেবে থাকেন তাহলে খুব শীঘ্রই আপনার এ চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে যাচ্ছে হাইপারলুপ প্রযুক্তি। আজ জেনে নিব এই যুগান্তকারী ব্যবস্থার ইতিবৃত্ত।
হাইপারলুপ কী?
হাইপারলুপ হচ্ছে মূলত স্থল ভিত্তিক বিশেষ ভ্রমণ ব্যবস্থা যা একটি ক্যাপসুল/ পোডের মধ্যে যাত্রী নিয়ে ঘন্টায় প্রায় ৭০০ মাইল বেগে যাত্রা করতে সক্ষম। সব থেকে মজার কথা হলো যাত্রীবাহী ক্যাপসুলটি ভূমি স্পর্শ করবেনা, অর্থাৎ একরকম বাতাসে ভেসে থাকবে ও প্রচণ্ড গতিতে চলবে!
হাইপারলুপের স্বার্থকতা কোথায়?
হাইপারলুপ আর সাধারণ রেল ব্যবস্থার মধ্যে প্রধান দুটি পার্থক্য হচ্ছে হাইপার লুপ কোনো রেল লাইন ধরে চলবেনা। যাত্রীবাহী ক্যাপসুল একটি Air Lock বা বাতাসবিহীন ভ্যাকুম টিউবের মধ্য দিয়ে চলবে যার গতি হবে ঘন্টায় প্রায় ৭৫০ মাইল।
দ্বিতীয়ত এটি বাতাসে ভাসবে। কীভাবে? এখানে ব্যবহার করা হবে অত্যাধুনিক Magnetic Levitation প্রযুক্তি৷ অর্থাৎ চুম্বকের মাধ্যমে ভূমি থেকে উপরে রাখা হবে যাতে ঘর্ষণবিহীন ভাবে চলতে পারে।

হাইপারলুপ টিউব কীভাবে কাজ করে?
এই সম্পর্কিত সম্যক ধারণা প্রদান করেন Elon Musk। তাঁর আইডিয়া অনুযায়ী টিউবটি ভূমির উপরে বা নিচে সাবওয়ের মতো স্থাপন করা হবে। তাঁর পর সেখানে ভ্যাকুম টিউব দিয়ে টিউবের সমস্ত বাতাস বের করে নেয়া হবে ফলে তৈরি হবে ভ্যাকুম চেম্বার। এটা করার মূল কারণ হচ্ছে বাতাসের ঘর্ষণ বা বাধা প্রতিরোধ করা৷ বিমানের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই তা অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যাতে বাতাসের ঘনত্ব কম থাকে এবং গতিটাও বেশি থাকে৷ হাইপারলুপের ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রয়োগ করা হবে। কারণ ঘন্টায় ৭০০ মাইলেরও বেশি গতি পেতে হলে অবশ্যই সেখানে বাতাসের কোনো বাধা থাকতে পারবেনা। Musk এর মডেল থেকে আরও দেখা যায় যে টিউবের ভেতরের বায়ুচাপ হবে মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলের চাপের ১/৬।(এখানে কেন মঙ্গলগ্রহের সাথে তুলনা করা হয়েছে তাঁর আলাদা কোনো ব্যাখ্যা নেই বরং Musk এর আগ্রহ সবকিছুতে মঙ্গলগ্রহের সাথে তুলনা করা!)। অর্থাৎ এখানে ১০০ প্যাসকেল চাপ প্রয়োগ করা হলে তা বাতাসের বাঁধাকে ১০০০ গুণ কমিয়ে আনবে এবং সেটা ১৫০,০০০ ফুট উপরে বিমানের উড্ডয়নের সমান!

হাইপারলুপ ক্যাপসুল কীভাবে কাজ করবে?
ক্যাপসুল গুলো টিউবের ভেতর প্রায় ২৮ টি Air Bearing Ski দ্বারা যুক্ত ও ভাসমান থাকবে। এখানে চুম্বক ব্যবহার করে ক্যাপসুলটিকে ভাসমান রাখা হবে অনেকটা বুলেট ট্রেন যে প্রযুক্তিতে চলে সেভাবে। এটা অন্যতম বড় একটা দিক হাইপার লুপের। ক্যাপসুল টি প্রারম্ভিক গতি লাভ করবে একটি মোটর দ্বারা যা বাহিরে সংযুক্ত থাকবে। মোটরটির High Subsonic Velocity তৈরি করার ক্ষমতা থাকবে। অর্থাৎ প্রতি ৭০ মাইল বেগ অর্জন করার পর তা এক প্রকার Boost প্রদান করবে ক্যাপসুলকে ও অতি অল্প সময়ে কাঙ্ক্ষিত গতিতে পৌছাতে সাহায্য করবে। প্রতি ক্যাপসুলের প্রায় ২৮-৩০ জন যাত্রী বহনের প্রাথমিক সক্ষমতা থাকবে। তাছাড়াও এর শক্তি প্রদানে ব্যবহৃত হবে সোলার প্যানেল।

হাইপারলুপ কীভাবে বুলেট ট্রেন থেকে আলাদা?
অনেকেই মনে করেন হাইপারলুপ উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেন গুলো থেকে আলাদা। কারণ এটি তুলনামূলক সস্তা, পরিবেশ বান্ধব। এতে জ্বালানিও কম পরিমাণে ব্যবহার করা যাবে। তাছাড়াও ট্রেন থেকে এর গতি দ্বিগুন বা তিনগুণ বেশি। অর্থাৎ সবদিক থেকেই কার্যকর।
হাইপারলুপ তৈরিতে খরচ কেমন পড়বে?
যুক্তরাষ্ট্রের San Fransisco থেকে Los Angeles যাওয়ার জন্য Musk যে পরিকল্পনা করেন সেখানে হাইপার লুপ স্থাপনে খরচ হবে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের মতো। আধা ঘন্টায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া যাবে৷ টিকেটের মূল্য হতে পারে ২০ ডলার। সবচেয়ে বেশি খরচ হবে টিউব লাইন বসানোর ক্ষেত্রে। তাছাড়া স্ট্যাশন, পিলার, পাম্প তো আছেই৷ খরচটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে যাত্রী সক্ষমতার উপর৷ যাত্রী ধারণ ক্ষমতা যত বাড়ানো হবে তত বেশি খরচ বাড়বে।

কখন প্রথম হাইপারলুপ সার্ভিস চালু হবে?
বিভিন্ন কোম্পানি এই আইডিয়াটির কমার্সিয়াল বাস্তবায়নে কাজ করেই যাচ্ছে। ব্যাপার হলো এই প্রযুক্তির এখনও অনেক উন্নয়ন প্রয়োজন৷ বিভিন্ন ধরনের গবেষণা হচ্ছে সিস্টেম মডিউল নিয়ে৷ অনেকে আশা ব্যক্ত করছেন যে ২০২০ সালের পর আস্তে আস্তে নির্মাণ কাজ শুরু হবে কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যাচ্ছেনা। কোথায় এই রুট চালু হবে সেটাও এখনও স্পষ্ট না তাও বিভিন্ন কোম্পানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ রুট নিয়ে একটি প্রাথমিক স্কেচ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত,অস্ট্রেলিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশ।
হাইপারলুপ প্রজেক্ট কি সফল হবে?
এটা একটা বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। কারণ আমরা এই প্রযুক্তির সফল বাস্তবায়নে অনেক পিছিয়ে আছি এখনও। বিভিন্ন সিস্টেমের টেস্ট রান চলছে ও নতুন নতুন সমস্যা ও সম্ভাবনা উভয়ই তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানি এক যোগে কাজ করেই যাচ্ছে। এটা মোটেও সহজ ব্যাপার নয় যে এক ঘন্টায় প্রায় ৭০০ মাইল গতিবেগে একটা ক্যাপসুলের ভেতর প্যাসেঞ্জার নিয়ে কোনো সমস্যা ছাড়াই যাত্রা করা। যাত্রী ধারণ ক্ষমতা, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপার তো আছেই। তবে সবাই বেশ আশাবাদী। হয়ত খুব শীঘ্রই টেস্ট রান গুলো সফল হবে এবং আমরা দেখতে পাবো স্বপ্নের হাইপারলুপ কে। ভ্রমণ হবে হাতের মুঠোয়।
Source: zdnet.com, hyperloopone.com, spacex.com