আইফোন এবং টাকার বান্ডেল – শব্দ দুটি প্রায় সমর্থক! অনেকের কাছে ওভার প্রাইসড মনে হলেও বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান “এ্যাপল” তাদের ব্রান্ড ভ্যালুতে বেজায় রকম বিশ্বাসী। শুরু থেকেই প্রিমিয়াম কাস্টমারদের কথা মাথায় রেখে গ্যাজেট তৈরী করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। আইফোনও তাদের এই মনোভাবের বাইরে নয়। তবে স্মার্টফোন ম্যানুফ্যাকচারিং এর ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই মিড রেঞ্জের কাস্টমারদের ওপর নজর দেয়া শুরু করেছে তারা। আইফোন এস ই (২০২০) তাদের এই মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে আইফোন তাদের প্রথম স্পেশাল এডিশন রিলিজ করে, যাতে ছিল ১৪ ন্যানোমিটারের এ৯ প্রসেসর এবং আইওএস ১৩ পর্যন্ত আপগ্রেড সুবিধা। এখনো অনেকের হাতে ঘুরতে দেখা যায় এ্যাপলের ৪.৩ ইঞ্চি পর্দার ‘আইফোন এস ই’ নামের সেই লিটল মন্সটারকে!
২০২০ সালে এসে এ্যাপল প্রেমীরা নতুন কিছু প্রত্যাশা করবে এটাই স্বাভাবিক। ভক্তদের চমকে দিয়ে এ্যাপল নিয়ে এলো তাদের দ্বিতীয় স্পেশাল এডিশন আইফোন এস ই (২০২০)। যাতে থাকছে আইফোন ৮ এর কাছাকাছি ডিজাইনের বডিতে লেটেস্ট এ১৩ বায়োনিক চিপসেট! গত বছর আইফোন তাদের ফ্ল্যাগশিপ “আইফোন ১১” তে এই চিপসেট ব্যাবহার করেছিল। তাই অনেকের মতেই নতুন এই ফোনটি হলো ‘আইফোন ৮ এর মোড়কে থাকা আইফোন ১১!’ ৩৯৯ ডলারে শুরু হওয়া এই মিড বাজেটের ডিভাইসটি নিঃসন্দেহে এ্যাপল প্রেমীদের জন্যে অনেক বড় একটি চমক।
ফোনটির বিল্ড কোয়ালিটি একদম প্রিমিয়াম লেভেলের। মেটাল ফ্রেম এবং গ্লাস ব্যাক ডিজাইনের নতুন আইফোন এস ই তে থাকছে দ্বিতীয় প্রজন্মের টাচ আইডি, ওয়্যারলেস চার্জিং সুবিধা এবং আইপি ৬৭ রেটিং। ১ মিটার পানির নিচে ৩০ মিনিট ডুবে ফটোগ্রাফি করতে পারবেন অনায়াসেই!
দাম কম রাখতে পেছনের দিকে একটিই ক্যামেরা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ্যাপল। তবে প্রতিষ্ঠানটির মতে এটি আইফোনে থাকা সবচেয়ে সেরা সিংগেল ক্যামেরা সেট আপ। ১.৮ এপারচার বিশিষ্ট ১২ মেগাপিক্সেলের ওয়াইড এ্যাংগেল ক্যামেরাটিতে অপটিক্যাল ইমেইজ স্ট্যাবিলাইজেশন সহ উন্নত কালার এবং ভালো ডাইনামিক রেঞ্জ ডিটেক্ট করার সক্ষমতা রয়েছে। তবে নাইট মোড ফিচারটি না থাকায় কম আলোতে ফ্ল্যাগশিপ কিলার ছবি পাওয়া না গেলেও সন্তোষজনক ছবি পাওয়া যাবে নিঃসন্দেহে। এছাড়াও পোট্রেইট মোডের জন্য ডেডিকেটেড লেন্স না থাকায় সল্প আলোতে ছবির এজ ডিটেকশনে (Edge Detection) কিছুটা সমস্যা হতে পারে। পেছনের ক্যামেরায় সর্বোচ্চ ৬০ ফ্রেম পার সেকেন্ড রেটে ফোরকে (4K) রেজুলেশনের ভিডিও ধারণ করা যাবে। তবে ভিডিও ধারণের ক্ষেত্রে এক্সটেন্ডেড ডাইনামিক রেঞ্জ সাপোর্ট পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ ৩০ ফ্রেম পার সেকেন্ড রেট পর্যন্ত।
সামনে থাকছে ২.২ এপারচারের ৭ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা। ফ্রন্ট ক্যামেরায় পোট্রেইট মোড এবং ডেপথ কনট্রোল সাপোর্ট থাকলেও থাকছে না ট্রু ডেপথ (True Depth) ক্যামেরা সিস্টেম। তবে এই ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরায় কুইকটেক (QuickTake) সাপোর্ট থাকছে। যা কোনো আইফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরায় এবারই প্রথম যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ফ্রন্ট ক্যামেরায় ৩০ ফ্রেম পার সেকেন্ড রেটে ১০৮০পিক্সেল রেজুলেশনের ভিডিও ধারণ করা যাবে।
নতুন আইফোন এস ই তে ব্যাবহার করা হয়েছে ৪.৭ ইঞ্চির রেটিনা এইচডি এলসিডি ডিসপ্লে। রেজুলেশন ১৩৩৪*৭৫০ পিক্সেলস। ২০২০ সালের একটি আইফোনে নূন্যতম ১০৮০ পিক্সেল রেজুলেশনের ডিসপ্লে আশা করাটাই হয়তো খুব স্বাভাবিক। এ্যাপল সেই প্রত্যাশা পূরণ না করলেও ডিসপ্লেতে দিয়েছে অসাধারণ কিছু ফিচার। এইচডিআর ১০ সাপোর্টেড এই ডিসপ্লেতে রয়েছে ওয়াইড কালার গ্যামেট এবং ডলবি ভিশন। ৩২৬ পিপিআই ডিসপ্লেটির কনট্রাস্ট রেশিও ১৪০০ঃ১। ব্রাইটনেস সর্বোচ্চ ৬২৫ নিটস পর্যন্ত বাড়ানো যায়। ডিসপ্লেতে যুক্ত হয়েছে “ট্রু টোন (True Tone)” ফিচার। এই ফিচারটি বেশ কয়েক বছর যাবত আইফোন এবং আইপ্যাড গুলোতে দেয়া হচ্ছে। এর সাহায্যে এ্যাম্বিয়ান্ট লাইট সেন্সরের মাধ্যমে ঘরের আলো বিশ্লেষণ করা হয়। এবং সে অনুযায়ী ডিসপ্লের কালার টেম্পারেচার ও ইনটেনসিটি নির্ধারণ করা হয়। ফলশ্রুতিতে এই ডিসপ্লে থেকে ব্যাবহারকারীরা কাগজের মতো স্মুথ দেখার অভিজ্ঞতা পাবেন, কোনো রকম আই স্ট্রেইন ছাড়াই। মিড বাজেটে এটি একটি অন্যতম সেরা ডিসপ্লে হতেই পারে!
মাত্র ১৮২১ এমএএইচ এর নন-রিমুভেবল ব্যাটারি ভক্তদের জন্য একটি ভালো রকমের হতাশার কারণ হতে পারে। এক চার্জে অন্তত টানা একদিন চলতে পারে এমন ব্যাটারিই দেয়া হচ্ছে এ সময়ের স্মার্টফোন গুলোতে। হেভি ইউজার হয়ে থাকলে ২০২০ সালের আইফোন এস ই থেকে এমন ব্যাটারি ব্যাকআপ প্রত্যাশা না করাই ভালো। তবে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখিয়েছে ১৮ ওয়াটের ফাস্ট চার্জিং। এছাড়া এর ৭ ন্যানোমিটারের সুপিরিওর চিপসেট কিছুটা হলেও কম ব্যাটারি ড্রেইন করবে। তবে এ্যাপলের দেয়া বিবৃতি অনুসারে নতুন আইফোনে একবার ফুল চার্জ দিলেই আপনি ১৩ ঘন্টা ভিডিও দেখতে পারবেন অথবা ৮ ঘন্টা অনলাইনে ভিডিও স্ট্রিমিং করতে পারবেন অথবা ৪০ ঘন্টা গান শুনতে পারবেন। ব্যাস! তাহলে আর কি লাগে!
৩ গিগাবাইট র্যামের নতুন আইফোনটিতে থাকছে না কোনো হেডফোন জ্যাক! তাই আশে পাশের মানুষকে বিরক্ত না করেই গান শুনতে চাইলে ওয়্যারলেস হেডফোন কিংবা ছোট্ট ইয়ারফোন এ্যাডাপ্টার ব্যাবহার করতে হবে। পুরোনো দিনের হোম বাটনে শ্যাফেয়ার ক্রিস্টালে মোড়ানো দ্বিতীয় প্রজন্মের টাচ আইডি থাকছে। এই টাচ আইডি ব্যাবহার করে ফোন আনলক, আই ক্লাউডের পাসওয়ার্ড প্রদান, এ্যাপল পে ট্রানজেকশন এবং ব্যাক্তিগত এ্যাপস গুলো ওপেন করা যাবে। আইফোন ৮ এর মতো থ্রিডি টাচ না থাকলেও হেপটিক টাচ থাকছে। যা অনেকটা থ্রিডি টাচের মতোই কাজ করে। কিন্তু এটা থ্রিডি টাচের মতো চাপ সংবেদনশীল নয়। থ্রিডি টাচের ক্ষেত্রে আঙুলের চাপের ভিন্নতা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন কাজ করা যায়। হেপটিক টাচের ক্ষেত্রে একজন ব্যাবহারকারী কতক্ষণ ডিসপ্লেতে আঙুল ধরে রাখছেন তার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন কাজ নির্ধারণ করা হয়।
সাদা, কালো এবং লাল – তিনটি কালারে পাওয়া যাবে এই ফোন। ৩ টি ভ্যারিয়েন্ট থাকবে যাদের মূল্য যথাক্রমে ৬৪ জিবি (৩৯৯ ডলার), ১২৮ জিবি (৪৯৯ ডলার), ২৫৬ জিবি (৫৪৯ ডলার)। বেইজ ভ্যারিয়েন্ট টি বাংলাদেশে ভ্যাটসহ ৪০ থেকে ৪৫ হাজারের আশে পাশে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রেড কালারের আইফোন এস ই এর লভ্যাংশের একটি অংশ কোভিড-১৯ এর জন্য গঠিত গ্লোবাল ফান্ডে পৌঁছানো হবে বলে জানিয়েছে এ্যাপল।
২০২০ সালের এই আইফোন অনেকেরই পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকতে পারে। এতোদিন আইফোনের চড়া মূল্যে হতাশ অনেক এ্যাপল প্রেমী হয়তো এবার পকেটে পুরবেন তাদের স্বপ্নের ডিভাইস!