ডিল্যুশন (Delusion) কথাটা খুব বেশি শোনা না গেলেও ইল্যুশন (Illusion) আর হেলুসিনেশন কথাটা আমরা আজকাল প্রায়শই শুনে থাকি। বিশেষ করে ইল্যুশন শব্দটা এদিক সেদিক নেট সার্ফিং করতে গিয়ে চোখে পড়েই যায়। আবার অনেককেই আমরা বলতে শুনি “আমার হেলুসিনেশন হচ্ছে।”
যদিও তাদের অনেকেই জানেনা যেটাকে তারা হেলুসিনেশন বলছে তা আদতেই হেলুসিনেশন কিনা, কারণ যেচে পড়ে কেউ নিজেকে জন্ডিসের (Jaundice) রোগী বা আলসারের রোগী (Ulcer) বানাতে চাইলেও, যেচে পড়ে কেউ নিজেকে মানসিক রোগী বলে ঢোল পেটাতে চাইবে না।
তো যাই হোক, চলুন তাহলে আজ জেনে নেয়া যাক এবিষয়ে।
আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে ইল্যুশন। সাথে থাকছে ডিল্যুশন আর হেলুসিনেশন নিয়ে কিছু কথাও।
প্রথমেই বলে নিই, ইল্যুশন, ডিল্যুশন আর হেলুসিনেশন মোটেও এক জিনিস না। একটা ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ, আরেকটা ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং তৃতীয়টা একেবারেই অলীক প্রত্যক্ষণ, মানে একেবারেই বাস্তব কোনো উদ্দীপক ছাড়াই কিছু অনুভব করা বা প্রত্যক্ষ করা। তো চলুন এবার বাকিটা জানি।
[tie_index]ইল্যুশন[/tie_index]
ইল্যুশন
ইল্যুশন হচ্ছে ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ। মানে কোনো কিছু আসলে যেমন আছে সেটাকে সেটা হিসেবে না দেখে বা সেটা হিসেবে না শুনে বা সেটা হিসেবে না অনুভব করে অন্যকিছু হিসেবে অনুভব করা।
আরো সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে চোখ, নাক, কান, ত্বক প্রভৃতি ইন্দ্রিয় থেকে পাওয়া সংবেদন (Sensation) আমাদের মস্তিষ্কে যখন ঐ বস্তু, প্রাণি বা পদার্থের পাওয়া সংবেদন (চোখে পড়া আলোর প্রতিফলন বা ইমেজ, নির্দিষ্ট ঘ্রাণ, নির্দিষ্ট শব্দ/আওয়াজ, নির্দিষ্ট স্পর্শ) ইত্যাদি সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত বা Process হতে পারেনা তখন আমরা দেখি এক আর আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের বুঝায় আরেক! আমরা ঘ্রাণ নিই এক জিনিসের আর বুঝি আরেক জিনিস। আমরা শুনি এক, বুঝি আরেক। আমরা স্পর্শ পাই এক জিনিসের আর বুঝি আরেক জিনিস। আর এটাই হল ইল্যুশন। লক্ষ্য করুন এদিকে যে কয়টার কথাই বললাম না কেন প্রতিক্ষেত্রেই কিন্তু বাস্তবে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে বা ঘটছে আমরা কেবল সেটাকে ভুলভাবে নিচ্ছি। আর এটাই হল Illusion বা ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের মূল বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ বাস্তবে কোনো উদ্দীপক ( এক্ষেত্রে যা আমাদের মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে) থাকবে। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক সেটা থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত সঠিকভাবে গুছাতে পারেনা বা সেটার সাথে সঠিক তথ্য জুড়ে দিতে পারেনা।
[tie_index]-রকমারি ইল্যুশন[/tie_index]
রকমারি ইল্যুশন
আমরা আসলে পুরোপুরি চোখ দিয়ে দেখিনা, নাক দিয়ে শুঁকি না, কান দিয়ে শুনি না। হাস্যকর তাইনা? কিন্তু হাস্যকর হলেও এটাই সত্যি!
ইন্দ্রিয়গুলোর মাধ্যমে আমরা সংবেদন গ্রহণ করি মাত্র, সেটাকে রুপদান ও আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করে মস্তিষ্ক। যেহেতু মস্তিষ্ক ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্রিয় বা Sense থেকে ভিন্ন ভিন্ন সংবেদন গ্রহণ করে তাই ইল্যুশনও ভিন্ন হয়। এই ভিন্নরকম ইল্যুশনগুলো হচ্ছে, –
১. অপটিকাল ইল্যুশন। (ভুল দেখা)
২. অডিটরি ইল্যুশন (ভুল শোনা)
৩. ট্যাকটাইল ইল্যুশন (স্পর্শের ভ্রান্তি)
৪. টেম্পোরাল ইল্যুশন (সময়ের ব্যাপারে ভ্রান্তি)।
যেহেতু বস্তুজগতের ৭০% সংবেদনই আমরা গ্রহণ করি দর্শন ইন্দ্রিয় বা চোখ থেকে তাই এগুলোর মাঝে অপটিকাল ইল্যুশনই সবচে বেশি প্রভাবশালী।
[tie_index]–দৃষ্টিবিভ্রম[/tie_index]
১. Optical Illusion বা দৃষ্টিবিভ্রম
বস্তুর উপর প্রতিফলিত রশ্নি ফোটনরুপে চোখের মাধ্যমে আমাদের অপটিক নার্ভ দিয়ে সিগন্যালরুপে মস্তিষ্কে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় তা বিচ্ছিন্ন আর অবিন্যস্ত থাকে। মস্তিষ্কের Automated ব্যবস্থা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তা একসাথে গুছিয়ে নিয়ে আসে এবং নিউরনগুলোর মাঝে থাকা তথ্যভাণ্ডার থেকে খুঁজে সেই প্যাটার্ন, প্যাটার্নের রঙ, ধরণ ইত্যাদি শনাক্ত করার পর আমরা সেটাকে বস্তু -> পরিচয় -> নাম -> ধরণ ইত্যাদি রূপে বুঝতে পারি। কিন্তু মস্তিষ্কের এই পুনঃবিন্যাস ও শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া অনেকসময় অনেক কারণে ব্যহত হয়। আর তখনই আমরা দেখি এক জিনিস, কিন্তু আমাদের মনে হয় আমরা বুঝি দেখছি অন্যকিছু।
এই সমস্যা বিপরীত বর্ণের বা রঙের (যেমন সাদা-কালো), প্যাটার্নের আবার অনেকসময় আলোর স্বল্পতা বা পারিপার্শ্বিক কারণেও হয়ে থাকে। মস্তিষ্ক তখন জিনিসগুলোর সঠিক গভীরতা (Depth), মাত্রা বা Dimension (দ্বিমাত্রিক না ত্রিমাত্রিক), পরিমাপ বা Scaling ঠিকঠাক মতো করতে পারেনা। আর মস্তিষ্ক যাই Process করে, আমাদের বুঝায়ও তাই।
আর তাই অনেকসময় আমরা অন্ধকার ঘরে ঘুম ভাঙলে পাশে ঝুলানো কাপড় দেখে মনে করি জীনের বাদশা, সাদাকালো বর্গের মাঝে মনে করি কালচে অংশ, বহু রং ও প্যাটার্নের সমন্বয়ে গঠিত কিছুকে মনে করি উলটাপালটা।
নমুনাস্বরূপ, নীচের ছবিগুলোর প্রথমটাতে চাকাগুলো আসলে স্থির। পরের ছবির সবগুলো লাইন সমান। আর বিশ্বাস করুণ তৃতীয় ছবিটায় আসলে পতাকার মত কিছুই উড়ছে না!
[tie_index]–শব্দবিভ্রম[/tie_index]
২. Auditory Illusion বা শব্দবিভ্রম
হুট করে মাঝরাতে আপনার ঘুম ভাঙলো এবং আপনি কোনোকিছুর খচখচ শব্দ শুনতে পেলেন। এরপর যখন সেই শব্দে আপনার অস্বস্তি বাড়তে শুরু করলো তখনি আপনি অদ্ভুত গড়গড় শব্দ শুনতে পেলেন। যেন এ শব্দ পার্থিব কিছুর না। তবু আপনি সমস্ত সাহস একসাথে করে শব্দে উৎসের দিকে গেলেন, এবং কিছুটা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন! কারণ শব্দটা করছিল বিড়াল, আপনার জানালার পাশে আধপাকা বাড়িটার চালে, ফেলে রাখা পলিথিনের উপর দাঁড়িয়ে। আরেক বিড়ালের সাথে ঝগড়া করছে। অথচ আপনার মস্তিষ্ক আপনাকে প্রথমে বুঝালো শব্দটা অতিপ্রাকৃত কিছু। শব্দের এমন বিভ্রান্তিই হল Auditory Illusion ।
[tie_index]–স্পর্শবিভ্রান্তি[/tie_index]
৩. Tactile Illusion বা স্পর্শবিভ্রান্তি
আপনি বসে আছেন আর হঠাৎ করেই মনে হল আপনার পিঠে একটা তেলাপোকা এসে বসলো। আপনি হুড়মুড়িয়ে উঠলেন! কিন্তু আদতে তা কাগজের টুকরো ছিল! স্পর্শের বা অনুভূতির এমন ভ্রান্ত ধারণাই হচ্ছে Tactile Illusion ।
[tie_index]–কালবিভ্রম[/tie_index]
৪. Temporal Illusion বা কালবিভ্রম
ব্যাকরণ ক্লাস আপনার চরম অপছন্দ। যেখানে আপনার প্রতিটা মিনিট মনে হয় একেকটা ঘণ্টার মত। আবার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার বেলায় সময় কিভাবে চলে যায় টেরই পান না। তখন একেক ঘণ্টা যেন মাত্র কয়েকটা মিনিটের মত। এইযে রুচির উদ্দীপকের প্রভাবে অতিবাহিত সময় সম্পর্কে আপনার এই বিভ্রান্তি, এটাই হল কালবিভ্রম বা Temporal Illusion।
[tie_index]ডিল্যুশন[/tie_index]
ডিল্যুশন
আনিস সাহেব (কাল্পনিক) এর বাবা মারা গেল আজ তিন বছর। তবু তিনি বিশ্বাস করেন রোজ বৃহস্পতিবার তার বাবার বিদেহী আত্মা আসে উনাদের ঘর ঘুরেফিরে দেখার জন্যে। তাই তিনি সেদিন আগরবাতি জ্বালান, মিলাদ করেন, ও অযথাই কান্নাকাটি করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে উনার স্ত্রী একজন মনোবিদের কাছে যাবার পর মনোবিদ পরীক্ষা করে জানান, উনি ডিল্যুশনে ভুগছেন।
আবার আপনার প্রতিবেশি এক মেয়ে (কাল্পনিক) হঠাৎ করেই নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে কেমন ঘরকুনো হয়ে গেল। তার ধারণা সে নাকি বেশিদিন বাঁচবে না। আর সে ধারণা সত্যিই করতেই যেন সে সময়ের সাথে ধীরে ধীরে খুব শুকিয়ে গেল! ডাক্তারের কাছে নেয়ার পর কোনো রোগ ধরা না পড়ার পর তারা বললো কোনো সাইকোলজিস্ট দেখাতে। ভাল সাইকোলজিস্ট দেখানোর পর জানা গেল কিছুদিন আগে তার এক বান্ধবী ক্যান্সারে মারা গেছে। এ থেকে সেও নিশ্চিত হয়ে গেল সে বেশিদিন বাঁচবে না!
ডাক্তার অবশেষে বুঝতে পারলেন মেয়েটা Psychotic Depression এ ভুগছে। যার মাঝে মারা যাবার বিশ্বাসটাই তাকে জেঁকে বসেছে।
এই যে বিভিন্ন উদ্দীপকের প্রভাবে মানুষের মাঝে নানারূপ ভ্রান্ত বিশ্বাস, একদম সমূলে সমূলে বাসা বেধে বসে এগুলোই হল ডিল্যুশন। সব ডিল্যুশন মানসিক রোগের পর্যায়ে না গেলেও বহু ডিল্যুশনই গুরুতর মানসিক সমস্যার আকার ধারণ করে। এতে করে ব্যক্তিবিশেষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা খুবই বাজেভাবে ব্যহত হয়। উল্লেখ্য যে হেলুসিনেশন প্রায়শই ডিল্যুশনাল ডিসঅর্ডারের অংশরূপে থাকে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন ডিল্যুশন So called ইল্যুশনের চাইতে কতটা গুরুতর! ভ্রান্ত বিশ্বাস গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে সেক্ষেত্রে কাল বিলম্ব না করে ভাল কোনো মনঃচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া খুব জরুরী।
তবে তাই বলে হুট করেই কোনো সমস্যাকে ডিল্যুশন ভেবে বসা উচিত নয়।
[tie_index]হেলুসিনেশন[/tie_index]
হেলুসিনেশন
আমরা প্রায়শই ভুলভাল দেখার ঘটনাকে বলি, “হায় হায়, আমার হেলুসিনেশন হচ্ছে।”
কিন্তু না, হেলুসিনেশন (Hallucination) মোটেও ভুলভাল কিছুনা। হেলুসিনেশন হচ্ছে এমন এক ব্যধিগ্রস্থ মানসিক অবস্থা যে অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো উদ্দীপক ছাড়াই বস্তু প্রত্যক্ষণ করে। অর্থাৎ তারা এমন কিছু দেখে যা ভুল দেখা নয় যেখানে আসলে কিছু নেই ই। উদাহরণস্বরূপঃ ইল্যুশনে কেউ দড়িকে সাপ ভেবে বসতে পারে, কিন্তু হেলুসিনেশনে কেউ দড়ি না থাকা সত্বেও সাপ দেখতে পারে, অথবা ঘুমভাঙা রাতে দেখতে পারে তার খাটের পাশে বিকটদর্শী বহু হাত পাওয়ালা কোনো জন্তু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে।
কেউ কেউ আবার Hallucinative অবস্থায় এমন কারো এমন কোনো কথা শুনতে পায় যার কোনো অস্তিত্বই নেই। আবার অনেকে যেমন দেখা গেল কোনো উৎস ছাড়াই ঘরে কোনো নির্দিষ্ট সুঘ্রাণ পাচ্ছে।
এসবই হল হেলুসিনেশন।
হেলুসিনেশন আমাদের মূল পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের যেকোনোটার ক্ষেত্রে হতে পারে। নির্ভর করে মস্তিষ্কের প্রক্রিয়ার তীব্রতার উপর। যেহেতু হেলুসিনেশন বাহ্যিক কোনো উদ্দীপক ছাড়াই ঘটে সেক্ষেত্রে এর কারণ, ঝুঁকি ও মাত্রাও নির্ভর করে দেহের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার উপর।
আর এজন্যেই হেলুসিনেশন হচ্ছে মূলত একধরণের মানসিক রোগ। বা অন্যান্য মানসিক রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তবে কিছু হালকা মাত্রার হেলুসিনেশন আছে যেমন কিছু Simple Visual Hallucination, LSD এর মত মাদকের প্রভাবে হওয়া সাময়িক হেলুসিনেশন, এগুলো কোনো গুরুতর মানসিক রোগ ছাড়াও বিচ্ছিন্ন Symptom হিসেবে দেখা যায়। আর মনে রাখতে হবে কেবল একটা এবং বিচ্ছিন্নভাবে হওয়া Symptom কখনো মানসিক রোগ (Syndrome) হতে পারেনা। এরজন্যে প্রয়োজন পড়ে একাধিক Symptom ও সেগুলোর পুনরাবৃত্তির।
হেলুসিনেশন বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ কারণে হতে পারে।
তার মধ্যে Parkinson Disease , মৃগী বা Epilepsy, প্রচন্ডরকম মানসিক চাপ বা ভয়ের সম্মুখীন হওয়া বা এমন কোনো ঘটনা দ্বারা সৃষ্ট Post Traumatic Disorder বা মস্তিষ্কের স্নায়ুর স্বাভাবিক কার্যবিধি কোনোরূপে ব্যহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও হতে পারে।
স্কিৎসোফ্রেনিয়া (Schizophrenia), Psychosis, নানারকম Depressive Disorder ইত্যাদিতে হেলুসিনেশন হতে পারে।
এমতাবস্থায় দেরী না করে যতদ্রুত সম্ভব ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য…
ভ্রান্তি বিভ্রান্তির কথাবার্তা নিয়ে আজ তাহলে এপর্যন্তই। পরেরবার আবার কথা হবে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে। ততক্ষণ ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিজের খেয়াল রাখুন…
Leave a Reply