এ নশ্বর পৃথিবী থেকে সবাইকে একদিন বিদায় নিতে হবে। এ পৃথিবীতে কেউই চিরস্থায়ী নয়। সময়ের সাথে সাথে সবাই চলে যায় । আবার কিছু কিছু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায় বিরূপ পরিবেশ ও প্রতিকূলতার কারণে। যেমনটা একসময় এ পৃথিবীতে ছিল অসংখ্য ‘ডাইনোসরের’ উপস্থিতি । কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এ সুন্দর পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। আজকে আমরা জানব প্রায় অমর এক প্রাণী সম্পর্কে যার নাম ‘টার্ডিগ্রেড’। চলুন তাহলে আমরা প্রাণীটির সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসি।
‘টার্ডিগ্রেড’ দেখতে অদ্ভুত চেহারার। টার্ডিগ্রেডের আটটি পা আছে। এ আটটি পায়ে আবার চার থেকে আটটি নখওয়ালা থাবা আছে। টার্ডিগ্রেডকে প্রায় সময় ‘জলভল্লুক’ বা ‘মস পিগলেট’ বলা হয়। টার্ডিগ্রেডকে আপাত চোখে সাধারণ বৈশিষ্ট্যের প্রাণী বলে মনে হয়। ক্ষুদ্রাকার হওয়ায় এদের খালি চোখে দেখা যায় না। টার্ডিগ্রেড এর মাথা কিছুটা ‘ক্যাটারপিলার’ বা শুয়োপোকার মতো। টার্ডিগ্রেড প্রায় অমর এক প্রাণী, এরা যেকোনো পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।
টার্ডিগ্রেড একটি পর্ব , এটি প্রাণীদের উচ্চতর লেভেলের একটি বৈজ্ঞানিক ক্যাটাগরি ( মানুষ কর্ডেট পর্বের অন্তর্ভুক্ত – এ পর্বের প্রাণীদের স্পাইনাল কর্ড থাকে) Integrated Taxonomic Information System ( ITIS) অনুসারে টার্ডিগ্রেড পর্বের মধ্যে ১,০০০ টি প্রজাতি রয়েছে।
আকার
এ প্রাণীরা দেখতে “Alice Adventure in Wonderlands” এর hookah-smoking ক্যাটারপিলার এর মত। এরা লম্বায় প্রায় .০০২ থেকে .০৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু এরা সাধারণত .০৪ ইঞ্চির চেয়ে লম্বা হয় না।
বাসস্থান
জলভল্লুক বা টার্ডিগ্রেডরা যেকোনো জায়গায় বাস করতে পারে। এরা সাধারণত হৃদের তলদেশে বাস করতে পছন্দ করে, বিশেষ করে মসের আদ্র অংশে অথবা অন্য যেকোনো আদ্র পরিবেশে। এরা যেকোনো তাপমাত্রায় বা প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।
Smithsonian ম্যাগাজিন অনুসারে গবেষণায় দেখা গেছে যে, টার্ডিগ্রেড ঠাণ্ডা পরিবেশে বা – ৩২৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট ( – ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) অথবা ৩০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট ( ১৪৮.৯ ডিগ্রি) এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রা এরা সহ্য করতে পারে । এমনকি এরা রেডিয়েশনে , ফুটন্ত পানিতে , সাগরের গভীরতম অংশের চাপের চেয়ে ছয়গুণ বেশি চাপে এবং মহাশূন্যে কোনে সুরক্ষা ছাড়াই টিকে থাকতে পারে।
২০০৮ সালে প্রকাশিত হওয়া একটি গবেষণা জার্নাল Current Biology প্রকাশ করে, টার্ডিগ্রেড এর কিছু প্রজাতি পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে ১০ দিন পর্যন্ত বেচেঁ থাকতে পারে।
গবেষকরা বলেছেন,
মানুষ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হওয়ার অনেক সময় পরেও টার্ডিগ্রেডরা পৃথিবীতে টিকে থাকবে। ২৪ জুলাই , ২০১৭ এ Scientific Reports প্রকাশিত জার্নালে হার্ভাড এবং অক্সফোর্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ভবিষ্যতের কিছু সম্ভাব্য এস্ট্রোনমিক্যাল ঘটনা যেমন- পৃথিবী ধ্বংসকারী এস্টেরয়েড , সুপারনোভা ব্লাস্ট, গামা রশ্মি বিস্ফোরণে পুরো মানবজাতি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে , কিন্তু তখনও টার্ডিগ্রেড এর কিছু প্রজাতি এসব ঘটনা উপেক্ষা করে পৃথিবীতে টিকে থাকবে।
প্রকৃতি
১৭৭৩ সালে জার্মান যাজক, Johann August Ephraim Goeze টার্ডিগ্রেড আবিষ্কার করেন। তিনি এদের নাম রাখেন ‘টার্ডিগ্রাডা’ যার অর্থ ‘ ছোট পদক্ষেপ ‘ । ১৭৭৬ সালে একজন পাদ্রী এবং জীববিজ্ঞানী লাজারো স্পালানজানী আবিষ্কার করেন এ জলভল্লুকটি প্রতিকূল পরিবেশে নিজের রূপান্তের মাধ্যমে টিকে থাকে।
বিভিন্ন সময়ে মৃত প্রায় প্রাণীর মত পড়ে থাকে এবং বিরূপ পরিবেশে বেচেঁ থাকে। এ অবস্থাকে “ক্রিপ্টোবায়োসিস” বলে। ক্রিপ্টোবায়োসিসে টার্ডিগ্রেড পা এবং মাথা গুটিয়ে নিজেকে পানিশূন্য গোলাকার বলে রূপান্তর করে, যেটিকে টুন বলা হয়। পানির সংস্পর্শে আসলে কয়েক ঘন্টা পর আবার পুনরায় জীবিত হয়ে উঠে।
ক্রিপ্টোবায়োসিসের সময় টার্ডিগ্রেডের মেটাবলিক অ্যাক্টিভিটি সাধারণ মাত্রার চেয়ে শতকরা . ০১ কম থাকে এবং তাদের অঙ্গাণুগুলো sugary gel ট্রেহালোজ (trehalose) দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। এরা প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট তৈরি করে, যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাুণুগুলোকে রক্ষা করে। University of Tokyo এর গবেষণা অনুসারে টার্ডিগ্রেড এমন এক প্রোটিন তৈরি করে যা তাদের ডিএনএ কে রেডিয়েশন থেকে রক্ষা করে।
নিম্ন তাপমাত্রা এরা নিজেকে বিশেষ এক টুন এ রূপান্তর করে, যেটি আইস ক্রিস্টাল তৈরিতে বাধা প্রদান করে।
পানিতে থাকার সময় এদের আরেকটি প্রতিরক্ষা পদ্ধতি রয়েছে। যে পানিতে এরা থাকে সে পানিতে অক্সিজেন কম থাকলে এরা নিজেকে টানটান করে ফেলে মেটাবলিক অ্যাক্টিভিটি কমানোর জন্য। এ অবস্থায় টিকে থাকর জন্য তাদের পেশিগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন এবং পানি শোষণ করে ।
২০১৬ সালে বিজ্ঞানীরা ২টি টুন এবং একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু কে পুনরায় জীবিত করে তোলে যেগুলো কিনা ৩০ বছরেরও অধিক সময় ধরে ক্রিপ্টোবায়োসিসে ছিল। এ গবেষণাটি journal Cryobiology এ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে হওয়া গবেষণার প্রতিবেদন অনুসারে ১২০ বছর বয়সের একটি টুন পুনরায় জীবিত হয়ে ওঠে।
খাবার
টার্ডিগ্রেড বেচেঁ থাকার জন্য তরল জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে। এরা শৈবাল, শেওলা ,মস থেকে রস শোষণ করে। এদের কিছু প্রজাতি মাংসাশী, আবার কিছু প্রজাতি স্ব-জাতি ভোজী। বিবিসির তথ্যমতে, এরা অন্য টার্ডিগ্রেডদের খাবার হিসেবে গ্রহণ করে।
প্রজনন
প্রজাতি ভেদে টার্ডিগ্রেড যৌন এবং অযৌন দুই উপায়েই বংশবিস্তার করে। একবারে এরা ১ থেকে ৩০ টি ডিম পাড়ে। যৌন উপায়ে বংশবিস্তারের সময় মেয়ে টার্ডিগ্রেড ডিম পাড়ে এবং পুরুষ টার্ডিগ্রেড ডিমগুলোকে নিষিক্ত করে। অযৌন উপায়ে বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে মেয়ে টার্ডিগ্রেড ডিম পাড়ে এরপর ডিমগুলো নিষিক্ত না হয়েই বেড়ে ওঠে।
শ্রেণিবিন্যাস
ITIS অনুসারে টার্ডিগ্রেড এর শ্রেণিবিন্যাস করা হলঃ
রাজ্য ঃ Animalia
উপরাজ্য ঃ Bilateria
ইনফ্রারাজ্য ঃ Protostomia
মহাপর্ব ঃ Ecdysozoa
পর্ব ঃ Tardigrada
টার্ডিগ্রেড এর পর্বকে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত করা হয় –
৩ টি শ্রেণী
৫ টি বর্গ
২০ টি পরিবার
১৫ টি উপপরিবার
১০৫ টি গণ
৪ টি উপগণ
১,০১৮ টি প্রজাতি
৬৭ টি উপপ্রজাতি
সংরক্ষণ অবস্থা
এখনো আইইউসিএন ( Internatioal Union for Conservation of Nature) দ্বারা টার্ডিগ্রেডকে মূল্যায়ন করা হয়নি। এরা বিপন্ন প্রাণীদের তালিকার অন্তর্ভুক্ত নয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর তথ্যানুসারে পঞ্চাশ হাজার কোটিবর্ষ সময়ে ঘটে যাওয়া ৫ টি বৃহৎ ধ্বংস করে উপেক্ষা করে এরা আজো পৃথিবীতে টিকে আছে।