জীববিজ্ঞানের জন্য গাণিতিক জীববিদ্যা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? এটা কী পদার্থবিজ্ঞানে গণিতের ব্যবহারের মতই সমান গুরুত্বের?
১৯২৮ সালে বিজ্ঞানী পল ডিরাক একটি নতুন কণিকার অস্তিত্বের সম্পর্কে সর্বপ্রথম ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও বিশেষ আপেক্ষিকতা – এই দুই বিশেষ তত্ত্বকে ব্যবহার করে প্রমাণ করেন যে, কোথাও না কোথাও এমন কোনো কণার অস্তিত্ব আছে যা ইলেক্ট্রনেরই সমতুল্য তবে ধনাত্মক আধানের। এর মাত্র চার বছর পর ১৯৩২ সালে বিজ্ঞানী কার্ল এন্ডারসন এর অস্তিত্ব অবলোকন করেন। হিগস-বোসন কণার কথা তো আমরা সবাই জানি। ১৯৬৪ সালে এই বিজ্ঞানীদ্বয় পদার্থের ভরের জন্য দায়ী আরেক মৌলিক কণিকার অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। যদিও এর ভর কেমন হতে পারে, সেই সম্পর্কে কারও কোনো ধারণাই ছিল না; যদিও এর থেকে অনেক উচ্চ পরিমাণ ভর উৎপন্ন হত। হাজার হাজার পদার্থবিজ্ঞানীদের এই কণিকাটির অস্তিত্ব বের করতে গিয়ে প্রায় ৫০ বছর লেগে গেছে।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ পৃথক দুটি ক্ষেত্র। পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তিই হচ্ছে গণিত; আর সেখানে জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে … ।
জীববৈজ্ঞানিক সিস্টেমগুলোকে বোঝার জন্য কখন জীববিজ্ঞানীদের গাণিতিক মডেল ব্যবহার করা উচিত? নিঃসন্দেহে বলা যায়, গণিত জীববিজ্ঞানেও একটি আলাদা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। অন্তত, মেন্ডেল, ফিশার এবং আরও অনেকের আবিষ্কার সেই সাক্ষ্যই দেয়। আচ্ছা, ডারউইনেরও কি গণিত শেখার জন্য কিছু সময় অতিবাহিত করা উচিত ছিল? যদি ডারউইন গণিত নিয়ে পড়াশোনা করতেন তাহলে কী তিনি জীববিজ্ঞান ও ভূতত্ত্ববিদ্যার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আবিষ্কার করতে পারতেন? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা কোনো দিনই জানতে পারব না।
বিশিষ্ট গণিতবিদ জন মেইনার্ড স্মিথ (John Maynard-Smith) এর মতে, জীববিজ্ঞানী হেল্ডেন (Haldane) একবার বলেছিলেন,
“…যদি আপনি বিজ্ঞানের পথে কোথাও কোনো জড়তা অথবা বিতর্ক দেখতে পান, তবে একটুখানি গণিত সেখানে আপনার হয়ে অনেক কথা বলে দিবে। “
হেল্ডেন-এর এই বক্তব্যকে অনেক গবেষণাপত্রই সঠিক হিসেবে গণ্য করেছে। কিন্তু অনেক জীববৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রেই গণিতের ক্বদাচিৎ ব্যবহার দেখা যায়, যেখানে নানা রকম পরিসংখ্যান-সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপনের সুযোগ রয়েছে। জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি খুব পরিষ্কারভাবেই লক্ষ্য করা যায়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে,
গণিতের অনুপস্থিতিতে আমরা আসলে কী কী ব্যাপার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি? জীববিজ্ঞানে অনেক প্রকারের গাণিতিক মডেল রয়েছে। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এর প্রায় সবগুলোই দরকারি। শুধুমাত্র কোনো সিস্টেমের গাণিতিক মডেল তৈরি করা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ নয়। আমাদের সজ্ঞাত নয় এমন কিছুর একটি কল্পনাযোগ্য চিত্র তৈরি করার ক্ষেত্রে গাণিতিক মডেল খুব বড় সাহায্য করতে পারে। এমনকি কোনো গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে আরেকটি মডেলের উদ্ভব সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া যায়। কী রকমের পূর্বাভাস? তাত্ত্বীক জীববিজ্ঞানী হ্যানা কোক্কো (Hanna Kokko) তাঁর “Modeling for Field Biologists (and Other Interesting People), Cambridge University Press” বইয়ে বলেছেন, “ ধারণাসঙ্গত মডেলের পূর্বাভাস সাংখ্যিক (quantitative) থেকে বরং গুণগত (qualitative) -ই বেশি হয়ে থাকে।“ প্রকৃতপক্ষেই, জীববিজ্ঞানে অধিকাংশ গাণিতিক মডেলের পূর্ভাবাসই সংখ্যাগত না হয়ে গুণগত ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। যেমন, ফিশারের লিঙ্গানুপাত তত্ত্ব (sex ratio theory) বলে যে পুরুষ এবং স্ত্রী-র অনুপাত একই হওয়া উচিত। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের মত একেবারে সাংখ্যিক কোনো ধারণা দেওয়া জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আসলেই অনেক কঠিন ব্যাপার।
বস্তুতঃ গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে খুব সুন্দরভাবেই দেখানো যায় যে, কোনো মিউটেশন বা জেনেটিক পরিবর্তন যত ভয়াবহই হোক না কেন, তা কোনো নির্দিষ্ট পপুলেশনের মধ্যে স্থায়ীভাবে বহনের সম্ভাবনা ততই কম। এই গুণগত ধারনাটি পপুলেশন জেনেটিক্সের একটি বিখ্যাত গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমেই করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে কী ঘটবে তা আন্দাজ করাটা অসম্ভব। এক্ষেত্রে এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ব্রুস আর লেভিন (Bruce R. Levin) বলেন “পপুলেশন বায়োলজিতে গাণিতিক অথবা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত মডেলের ব্যবহার ছাড়া গবেষণা করাটা নেট বা বাউন্ডারি ছাড়া টেনিস খেলার মত।“
তথ্যসূত্র : DOI: 10.4172/2157-7625.1000e112
Leave a Reply