একটি গাণিতিক মডেল নিয়ে কাজ করার সময় একজন জীববিজ্ঞানীকে অবশ্যই এর পরিধি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়েও ভাবা উচিত। এবং সব কিছুকেই বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করতে হবে। তবে এর মানে এই নয় যে সবাইকেই একদম খুঁটিনাটি সমস্ত কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে। একবার এক কনফারেন্সে একজন জীববিজ্ঞানী সেরকমই একটি মডেল নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, যেখানে উপস্থিত ছিলেন সমাজবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং আরও জীববিজ্ঞানী। সেসময়, গণিতে অপ্রস্তুত কেউ একজন দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন যে যদি বিষয়টি গাণিতিকভাবে প্রমাণিত হয়েই থাকে তাহলে বাড়তি আলোচনার প্রয়োজন কি। তখন সেই জীববিজ্ঞানীর উত্তর ছিল, ‘মডেলটির অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়’।
এখানে একটি প্রশ্ন উঠে আসতেই পারে যে একটি বিষয়ের কত গভীর পর্যন্ত আমাদের যাওয়া উচিৎ। আমরা কোনো মডেল বা বিষয়ের যত গভীরে যেতে থাকব, ততই এর ফলাফলের দিকে যেতে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে বেশি হিমশিম খেতে হবে। তাই, খুব সাবধানে বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করা উচিত। পরিসংখ্যানবিদ জর্জ ই পি বক্স একবার বলেছিলেন, “ কিছু দরকারি মডেল ছাড়া বাকি সব মডেলই ভুয়া।“ তবে কথা হল, কতটা দরকারি ? ১৯৫৩ সালে কার্ল নর্ডলিং (Carl Nordling) দেখেন যে, ক্যান্সারের সম্ভাবনা বয়সের সাথে সমঘাতে বৃদ্ধি পায়। তাঁর এই অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার (ডারউইনের মতে) দ্বারা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ক্যান্সারের পাকাপোক্ত হওয়ার জন্য সাতটি (ছয় যোগ এক)ধারাবাহিক মিউটেশন প্রয়োজন। হতে পারে, এই মিউটেশনগুলো সাতটি ভিন্ন ভিন্ন জিনে ঘটছে অথবা একই জিনে একাধিকবার ঘটছে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে নুডসন (Knudson) পৃথিবীবাসীকে সর্বপ্রথম এই গাণিতিক যুক্তির বাস্তবসম্মত রূপ উপস্থাপন করেন।
আমাদের রেটিনায় ঘটিত টিউমার, যা রেটিনোব্লাস্টোমা নামে পরিচিত, তা দুই শ্রেণির মানুষকে বিভিন্ন বয়সে আক্রমণ করে। এই দুই শ্রেণির এক শ্রেণি হচ্ছে যাদের বংশে পূর্বে এই রোগের ইতিহাস রয়েছে এবং আরেক শ্রেণি হচ্ছে যাদের সেই ইতিহাস নেই। টিউমার ক্যান্সারেরই ফলাফল। ক্যান্সারের ফলে অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন হয়ে থাকে, যা পরবর্তীতে একটি অর্বুদ সৃষ্টি করে, এবং এটিই টিউমার নামে পরিচিত। যাদের পারিবারিক ইতিহাসে রেটিনোব্লাস্টোমার কোনো উপস্থিতি ছিল না তাদের চেয়ে যারা বংশানুক্রমে রেটিনোব্লাস্টোমা বয়ে চলেছেন তাদেরই এই রোগ পরবর্তীতে হওয়ার প্রবণতা বেশি। নুডসন এই তথ্যকে ব্যবহার করে ধারণা করেন যে এই ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দুইবার মিউটেশনের প্রয়োজন। এখন তাঁর এই ধারণা অনুসারে, অধিকাংশের ক্ষেত্রেই ক্যান্সার সংক্রমণের জন্য দুইবার মিউটেশন অবশ্যই ঘটতে হবে। অবশ্য, যাদের বংশে রেটিনোব্লাস্টোমার ইতিহাস রয়েছে তাদের একটি মিউটেশন ইতোমধ্যেই ধারণ করার সম্ভাবনা অনেক বেশি। রোগ সৃষ্টির জন্য তাদের আর একটি মিউটেশনই যথেষ্ট। এই গবেষণা থেকেই বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন, কোষ বিভাজন নিয়ন্ত্রণের জন্য অধিভুক্ত জিনগুলোর কার্যক্ষমতা বন্ধ এবং অনিয়ন্ত্রিত কোষ বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করার জন্য কোনো জিনের সক্রিয়করণই ক্যান্সারের সাথে সম্পর্কিত।
নুডসনের এই গবেষণাটি ‘Two-hit Hypothesis’ অথবা ‘Multiple-hit Hypothesis’ নামে পরিচিত। আর এই কাজের জন্য তিনি ১৯৯৮ সালে ‘আলবার্ট ল্যাস্কার ক্লিনিকাল মেডিকাল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’ (Albert Lasker Clinical Medical Research Award) লাভ করেন।
প্রকৃতিতে জীবজগতে আমরা গণিতের অহরহ উদাহরণ দেখতে পাই। শামুকের খোলসের বিন্যাসে ‘সোনালী অনুপাত’ –এর উপস্থিতি, আনারসের মুকুটের বিন্যাস ও গাছের ডালের বিন্যাসসহ অন্যান্য নানা গঠনে, এমনকি আমাদের ডিএনএ-তেও ফিবোনাক্কি সিরিজের জ্বলজ্বলে প্রমাণ প্রকৃতিতে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে – এসব আমরা সকলেই জানি। এমনকি মানব জরায়ুর সুস্থ গঠনেও দেখা যায় সোনালী অনুপাত। দেখা যাচ্ছে, জীবজগতের সাথে গণিতের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক সেই সৃষ্টির সূচনা থেকেই গড়ে উঠেছে। আমাদের উচিত এই সম্পর্কগুলো নিয়া চিন্তা করা।
প্রকৃতি সব জায়গায়ই আমাদের জন্য রেখে দিয়েছে অজস্র রহস্য। আপাতদৃষ্টিতে রহস্যগুলো যত জটিলই দেখা যাক না কেন, আসলে এর সমাধান করতে পারে কেবল একটিই মাধ্যম। আর তা হল গণিত। প্রখ্যাত মনীষী গ্যালিলিও গ্যালিলি (Galileo Galilei) বলেছিলেন, ‘গণিত হচ্ছে ঈশ্বরের ভাষা যা দিয়ে তিনি এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড রচনা করেছেন।’ আর এই মহাবিশ্বের অংশই হচ্ছি আমরা। তাই যদি এই প্রকৃতিকে জানতে হয়, এর রহস্য উদ্ঘাটন করতে হয়, তবে অবশ্যই গণিতকে প্রাধান্য দিতে হবে।
Leave a Reply