ছোটবেলা থেকে পড়ে আসা বলের সংজ্ঞা ছিল অনেকটা এরকম, “যা স্থির বস্তুর ওপর ক্রিয়া করে তাকে গতিশীল করতে চায় বা গতিশীল বস্তুর উপর ক্রিয়া করে তার গতি পরিবর্তন করে বা করতে চায় তাকে বল বলে।”
তবে মৌলিক বল সম্পর্কে বলতে গেলে ধারণাটি একটু বদলাতে হয়। মৌলিক বল (Fundamental Interaction) বিভিন্ন কণার মধ্যকার আন্তঃক্রিয়াসমূহ ব্যাখ্যা করে। দুইটি কণার মধ্যকার আচরণ শুধুমাত্র একটি বল দ্বারাই নির্ধারিত হয়। দুটি কণা নিজেদের আকর্ষণ-বিকর্ষণ যাই করুক না কেন তা নির্ধারিত হয় তাদের মধ্যকার মৌলিক বলের উপর। আবার প্রতিটি মৌলিক বলের নির্দিষ্ট পাল্লা(রেঞ্জ) থাকে, এর বাইরে তারা কাজ করে না, সেই সাথে তাদের শক্তিমত্তাও ভিন্ন ভিন্ন।
আমাদের জানা মতে, প্রকৃতিতে চারটি মৌলিক বলের অস্তিত্ব রয়েছে।
–মহাকর্ষ বল (অসীম রেঞ্জ, সবচাইতে দুর্বল বল)
–তড়িৎ-চৌম্বক বল (অসীম রেঞ্জ, মহাকর্ষের চেয়ে 1039 গুন শক্তিশালী )
–দুর্বল নিউক্লীয় বল (<10-16m রেঞ্জ, মহাকর্ষের চেয়ে গুন 1030 শক্তিশালী)
–সবল নিউক্লীয় বল (10-15m রেঞ্জ, মহাকর্ষের চেয়ে 1041 গুন শক্তিশালী)
পরমাণুর ভেতরে থাকা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন গুলো কিভাবে আরও অন্যান্য মৌলিক কণিকা (ফারমিওন,বোসন) সহ কিভাবে একীভূত থাকে তা ব্যাখ্যায় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে ব্যাখ্যাটি দেওয়া হয় তা হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এই মডেল অনুসারে প্রতিটি মৌলিক বলই কোন না কোন বোসন কণার আদান- প্রদানের ফলে কাজ করে। সবল নিউক্লীয় বলকে বহন করে গ্লুওন কণা, তড়িৎ চৌম্বকে ফোটন কণা, দুর্বল নিউক্লীয় বলকে ডাব্লিউ বোসন এবং জি-বোসন কণা বহন করে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সাহায্যে এই মৌলিক বলগুলোকে একীভূত করেতেই বিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন। তবে এখনও মহাকর্ষ বলকে এই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি । মহাকর্ষ বলের বোসন কণার নাম দেওয়া হয়েছে গ্রাভিটন কণা। তাই বিজ্ঞানীরা এখনো নিজেদের মাথার চুল ছিড়ে যাচ্ছেন এই মহাকর্ষ বলকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অন্তর্ভুক্ত করতে। মহাকর্ষ বলকে এই মডেলের মাঝে আনতে পারলে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে কি মহাবিশ্বে এই চার প্রকার মৌলিকের বলের অস্তিত্বই বিদ্যমান ? আর কোন মৌলিক বল নেই?
মহাবিশ্বের মোট ভরের মাত্র ৩ শতাংশ আমরা দেখতে পাই, বাকি অংশ ডার্ক ম্যাটার। যদিও ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি সম্পর্কিত কোন তথ্যই এখন পর্যন্ত প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি, তবে মহাবিশ্বের গঠন ও সম্প্রসারণশীলতা কে ব্যাখ্যা করার জন্য এর অস্তিত্ব কে স্বীকার করে নেওয়া হয়। কেন এই ডার্ক ম্যাটার ? কোথা থেকে এল এই ডার্ক ম্যাটার? কি দিয়ে তৈরি ডার্ক ম্যাটার? এ নিয়ে প্রশ্ন বিজ্ঞানমহলে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে অনেক দিন ধরেই। এই ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি সম্পর্কিত রহস্য উদ্ঘাটনের জন্যই বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন পঞ্চম মৌলিক বলের অস্তিত্ব। যার বোসন কণার নাম ডার্ক ফোটন। ধারণা করা হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি সংক্রান্ত সকল রহস্য উদঘাটনে সাহায্য করবে পঞ্চম মৌলিক বল।
আগস্ট ২০১৬ তে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে Jonathan L. Feng এর নেতৃত্ব একদল গবেষক PHYSICS REVIEW LETTER এ একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন যাতে দেখানো হয় বেরিলিয়াম নিউক্লিয়াস ডিকে থেকে কিছু আন প্রেডিক্টেবল নিউক্লিয়ার ডিকে লক্ষ করা হয়, ধারণা করা হয় এটি নতুন ধরণের কোন কণা, যার নাম দেওয়া হয় ডার্ক ফোটন। পরবর্তীতে একদল ইউএস-বেসড থিওরিটিক্যাল ফিজিসিস্ট ডাটা বিশ্লেষণ করে তা থেকে প্রকৃতির নতুন মৌলক বল তথা পঞ্চম মৌলিক বল সম্পর্কে ইঙ্গিত দেন। যদিও এই নতুন বল সম্পর্কে Jonathan L. Feng নিশ্চিত ভাবে কিছু বলেনি। তার মতে, এই আন প্রেডিক্টেবল নিউক্লিয়ার ডিকে থেকে এটা বোঝা যায় তা নতুন একধরণের কণা, তবে তারা বল পরিবাহী কণা কিনা তা এখনও তাদের কাছে নিশ্চিত নয়।
এটি আসলেই মৌলিক বলবাহী ডার্ক ফোটন কণা কিনা তার উত্তর খুঁজতেই আর কয়েক সপ্তাহের মাঝেই রোম শহর থেকে আধ কিলোমিটার দূরত্বে Positron Annihilation into Dark Matter Experiment (PADME) থেকে একটি এক্সপেরিমেন্টটি করতে যাচ্ছে। এই ইন্টারন্যাশনাল এক্সপেরিমেন্টের কোলাবরেশনে যুক্ত থাকবে হাঙ্গেরিয়ান রিসার্চ গ্রুপ যারা কিনা প্রথমবারের মত নতুন কণার অস্তিত্ব সম্পর্কে আভাস পেয়েছিলেন।
ফোটন যেমন তড়িৎ-চৌম্বক বলের কোয়ান্টাম কণা তেমনি ডার্ক ফোটনও ডার্ক ম্যাটারের সাথে মিথস্ক্রিয়তায় অংশ নিয়ে পঞ্চম মৌলিক বলকে বহন করে। তবে ফোটনের ভর শূন্য হলেও ডার্ক ফোটনের সামান্য পরিমাণ ভর রয়েছে।প্রথমবারের মত আভাস পাওয়া হাঙ্গেরিয়ান রিসার্চ গ্রুপের মতে কণাটির আকার ইলেকট্রন থেকেও ৩০ গুন বড়। তারা অস্থিতিশীল বেরিলিয়াম পরমাণু ব্যাবহার করে ডার্ক ফোটনের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণ করেছিলেন।
PADME মূলত আন্টম্যাটার ব্যাবহার করে ডার্ক ফোটন খোজার চেষ্টা করবে। এ এক্সপেরিমেন্টে একটি পজিট্রন(এন্টি ইলেকট্রন)বিমকে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা ১০০ মাইক্রন পুরু ডায়মন্ডের চাকতির উপর ফেলা হবে। সাধারণ ভাবে এ প্রক্রিয়ায় ফোটন নির্গত হয়, তবে গবেষকরা ধারণা করছেন ডায়মন্ডের সাথে মিথস্ক্রিয়তার ফলে এখানে ডার্ক ফোটন নির্গত হবার একটি সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানকার অত্যাধুনিক ডিটেক্টর দিয়ে নির্গত ফোটন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। তাদের বৈশিষ্ট্য দেখেই গবেষকগণ সিদ্ধান্ত নেবেন প্রকৃতপক্ষেই ডার্ক ফোটনের অস্তিত্ব রয়েছে কিনা, যদি থেকে থাকে তবে তাদের আচরণ কেমন!
নতুন বলের অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব হলে মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটারের কারণে মহাবিশ্বে সম্প্রসারণ সহ মহাবিশ্বের জন্মের ইতিহাস থেকে অন্যান্য সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পরীক্ষার আশাবাদী ফলাফল নিঃসন্দেহে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। সেই সাথে হয়ত এত দিন ধরে চলে আসা মহাবিশ্বের ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি সংক্রান্ত সমস্যারও সমাধান হবে। সবটাই এখন সময়ের অপেক্ষা।
Reference :
- https://www.iflscience.com/physics/secrets-of-the-dark-photon-might-be-unlocked-in-brandnew-experiment/
- https://journals.aps.org/prl/abstract/1103/PhysRevLett.117.071803