ডিএনএ এর খোঁজে: পর্ব-১ (ডিএনএ বংশগতির ধারক ও বাহক)

সাইন্সফিকশন ছবি, বই বা বিজ্ঞানের কোন বইয়ে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা আমরা দেখতে পাই তা হল ডিএনএ । এখন কোন মানুষকে যদি প্রশ্ন  করা হয় ডিএনএ কি? তবে বিজ্ঞানের ন্যূনতম জ্ঞান থাকা মানুষটিও বলবে “ এটি হল বংশগতির ধারক ও বাহক”।

ডিএনএ কে বংশগতির ধারক ও বাহক বলা হলেও, কিভাবে আবিষ্কৃত হল যে, ডিএনএ ই বংশগতির ধারক ও বাহক। সেটা কিন্তু অনেকেরি অজানা । আজ আমরা সে অজানা পৃথিবীতে যাব এবং তা করতে হলে আমাদের যেতে হবে প্রায় একশত বছরেরও বেশি সময় পেছনে। ১৯২৮ সালের একজন ব্রিটিশ হেলথ অফিসারের কাছে যার নাম ফেডেরিক গ্রিফিট ।

১৯১৮ -১৯১৯ সালের দিকে সারা পৃথিবীতে কয়েক লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিলেন স্প্যানিশ  ইনফ্লুয়েঞ্জা বা স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে ।

সারা পৃথিবীতে এত সংখ্যক মানুষ এ ফ্লুতে মারা গিয়েছিলেন কারন, তখন মানুষের শরীর এরোগ প্রতিরোধে সক্ষম ছিলনা এবং এর প্রতিষেধকও মানুষের কাছে ছিলনা ।

মানুষের কাছে এর প্রতিষেধক না থাকলেও তারা জানতেন যে এ রোগের প্রধান কারন ছিল Pneumococcus bacteria. সেখান থেকেই মানুষ এই  Pneumococcus bacteria এর উপর গবেষণা শুরু করলেন । যাদের মধ্যে Griffith ছিলেন অন্যতম।

গ্রিফিট এর পরীক্ষা :

তিনি তাঁর পরীক্ষার জন্য Pneumococcus Strain নিলেন যাকে আমরা Streptococcus Pneumoniae ও বলতে পারি। যা স্প্যানিশ ফ্লু বা Pneumococcal infection এর প্রধান কারন ছিল।

তিনি তাঁর পরীক্ষাতে দু’ধরনের স্ট্রেইন  ব্যাহার করেছিলেন একটি হল “এস” স্ট্রেইন  বা স্মুথ স্ট্রেইন  অন্যটি হল “আর” স্ট্রেইন  বা রাফ স্ট্রেইন ।

স্মুথ স্ট্রেইন  নামকরণ হয়েছে কারন এর বাইরের পৃষ্ঠ একটি সম্পূর্ন মসৃন ক্যাপ্সুল দ্বারা আবৃত থাকে, যা একে নানা দরণের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, কিন্তু এই ক্যাপ্সুলের উপস্থিতি একে ভাইরুলেন্ট বা অত্যন্ত ক্ষতিকারক  করে তোলে কারন এর ফলে খুব সহজেই তা খুব সহজেই সংক্রামিত হতে পারে।

রাফ স্ট্রেইন  বলা হয় কারন এর বাইরের স্তর অমসৃন থাকে যা একে Avirulent বা ক্ষতিকারক বা সংক্রামিত হয়ার থেকে রক্ষা করে এবং এর এই বৈশিষ্ট্য একে গ্রাহক দেহের ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থার নিকট সন্ধেহ প্রবন করে তুলে এবং এটিকে গ্রহন থেকে বিরত থাকে।

গ্রিফিট তাঁর এই পরীক্ষাটি চার ধাপে করেছিলেন।

প্রথম ধাপ :

গ্রিফিট  তাঁর পরীক্ষার প্রথম ধাপে একটি ইঁদুরের দেহে “এস” স্ট্রেইন  ইঞ্জেক্ট করলেন যা কিনা Pneumococcai এর Smooth strain ছিল। আর যেহেতু স্মুথ স্ট্রেইন ইনফেকশিয়াস  তাই ফলাফল সরূপ ইঁদুরটি মারা গেল।

দ্বিতীয় ধাপ :

এ ধাপে তিনি “আর” স্ট্রেইন  ইঁদুরের দেহে ইঞ্জেক্ট করলেন। যেহেতু এটি এভাইরুলেন্ট এবং ইনফেকশিয়াস নয় তাই এর ফলাফল ইঁদুরটি বেঁচে থাকল।

তৃতীয় ধাপ :

যেহেতু প্রথম ধাপে “এস” স্ট্রেইন  ইঞ্জেক্ট করার পর ইঁদুর মারা গিয়েছিল তাই এটি মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল যে এর মধ্যের ব্যাক্টেরিয়া ইঁদুরের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল। তাই তা অনেকটা নিশ্চিত হবার জন্য তিনি এবার “এস” স্ট্রেইন  নিলেন কিন্তু তার আগে তাপ এর মাধ্যমে এর ভিতরের ব্যাক্টেরিয়াকে মেরে নিলেন অর্থাৎ হিট কিল্ড স্মুথ স্ট্রেইন  নিলেন।

ফলাফলটাও আশানুরূপ পেয়েছিলেন অর্থাৎ ইঁদুরটি বেঁচে ছিল। কিন্তু আসলেও কি ব্যাক্টেরিয়াই ইঁদুরগুলোর মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল?

তা নিশ্চিত হতে তিনি চর্তুথ ধাপটি করেন।

চর্তুথ ধাপ :

এধাপে তিনি একটি   হিট কিল্ড স্মুথ স্ট্রেইন  নিলেন এবং একটি রাফ স্ট্রেইন  নিলেন। যেহেতু দুটোই অক্ষতিকারক ও অসংক্রমক  অর্থাৎ ব্যাক্টেরিয়া বিহীন  ছিল তাই তিনি ধরে নিয়েছিলেন এখানেও ইঁদুরটি বেঁচে যাবে। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করলেন যে এবার ইঁদুরটি মারা গেছে। তখন তিনি ভাবলেন যে “এস” স্ট্রেইন  এ এমন কিছু ছিল যা “আর” স্ট্রেইন  এ প্রতিস্থাপিত বা ট্রান্সফার হয়েছে এবং তাকে সংক্রমিত বা ইনফেকটেড করেছে অর্থাৎ একে ভাইরুলেন্ট করেছে। যার ফলস্বরূপ ইঁদুরটি মারা গিয়েছে, কিন্তু অবাক করার বিষয় হল পরবর্তিতে তিনি সে মৃত ইঁদুরের দেহ থেকে জীবিত “এস” স্ট্রেইন  খুঁজে পেয়েছিলেন।

এর থেকে তিনি ফলাফলে আসেন যে এখানে এমন কোন উপাদান আছে যা, নিজে নিজে কোন প্রকার প্রভাবক ছাড়াই তার প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে এবং তার বৈশিষ্ঠ্য এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রতিস্থাপিত করতে পারে।

বিজ্ঞানী গ্রিফিট  বৈশিষ্ঠ্য প্রতিস্থাপনের বিষয়টা জানতে পারলেও কোন উপাদানের জন্য তা হচ্ছে তা তিনি বলতে পারেননি।

গ্রিফিট  না বলতে পারলেও পরবর্তিতে তিনজন বিজ্ঞানী এর উত্তর খুঁজেপান তাঁরা হলেন Avery, Macleod ,McCarty.

চিত্রঃ গ্রিফিট  এক্সপেরিমেন্ট

এভরি, ম্যাক্লিওড ,ম্যাকার্টি এর পরীক্ষা:

গ্রিফিট  এর পরীক্ষার পর বিজ্ঞানী মহলে তক্ষন সবাই এই জেনেটিক ট্রান্সফর্মেশন  মেটেরিয়াল বা বংশগতির ধারক পর্দাথটি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। আর এখান থেকেই পরবর্তিতে ১৯৪৪ বিজ্ঞানী এভরি, ম্যাক্লিওড ,ম্যাকার্টি  একটি পরীক্ষা করেন। তারা গ্রিফিট  এর পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে অন্য সবার মতই অনেক আগ্রহি ছিলেন। আর তাই তারা তাদের পরীক্ষার বিষয় হিসেবে

অনেকটা গ্রিফিট এরই পরীক্ষা অনুসরণ করলেন কিন্তু আরেকটু গোছানো এবং উন্নত।

গ্রিফিট তাঁর পরীক্ষায় বলেছিলেন যে, “এস” স্ট্রেইন  এ হয়ত এমন কোন উপাদান আছে যা “আর” স্ট্রেইন  এ প্রতিস্থাপিত হয়েছিল এবং তাকে ভাইরুলেন্ট করে তুলেছিল।

এভরি, ম্যাক্লিওড ,ম্যাকার্টি তখন ভাবলেন “এস” স্ট্রেইন এ অনেক ধরনের উপাদান বা মলিকিউলস আছে তাহলে কোনটা ট্রান্সফরমেশন মেটারিয়াল তা জানতে হলে তাদের প্রতিটা উপাদান আলাদা ভাবে একটি নির্দিষ্ট উপাদান এর সাথে পরীক্ষা করতে হবে।

বিষয়টা অনেকটা এমন, ধরুন আপনাকে কেউ ৪ টি  পাথর দিল এবং বলল যে এর মধ্যে কোনটা পরশ পাথর তা বের করতে।

আমরা জানি যে পরশ পাথরের সাথে যা স্পর্শ করানো হয় তাই সোনাতে পরিনত হয়।

তাই এখন পরশ পাথর বের করতে হলে আপনাকে প্রথমে একটি নির্দিষ্ট কিছু নিতে হবে এবং তার সাথে সবগুলো পাথরকে স্পর্শ করাতে হবে এবং যার স্পর্শে তা সোনায় রূপান্তরিত হবে তাই পরশ পাথর বলে বিবেচিত হবে তাইনয়কি।

এভরি, ম্যাক্লিওড ,ম্যাকার্টি এর পরীক্ষাটিও অনেকটা এমনি ছিল। তাঁরা ঐ নির্দিষ্ট উপাদান হিসেবে গ্রিফিট এর সেই  হিট কিল্ড স্মুথ স্ট্রেইন  নিলেন কারন চর্তুথ ধাপে এটার জন্যই “আর” স্ট্রেইন  ভাইরুলেন্ট হয়েছিল।

তাই তারা একটি জীবিত “এস” স্ট্রেইন  এর  সব মলিকিউলস এর সাথে সাথে আলাদা আলাদা ভাবে আলাদা আলাদা ইঁদুরের শরীরে ইঞ্জেক্ট করলেন এবং দেখলেন যে সব গুলোতে ইঁদুর বেঁচে গেলেও একটি মাত্র ইঁদুর মারা গিয়েছিল।

তারা সেই মলিকিউলসটি পরীক্ষা করে দেখতে পানযে তা ছিল , Deoxyribonucleic acid বা DNA ।

সেময় কিন্তু মানুষ এই DNA কে গুরুত্ব দেয়নি। তাঁরা ভেবেছিল যে প্রটিন উপস্থিত ছিল তার জন্যই ইঁদুরটি মারা গিয়েছিল।

তাই এবারও কেউ নিশ্চিত হতে পারলনা যে আসলেই বংশগতির ধারক ও বাহক কে ?

আর এর উত্তর দিতেই দুজন বিজ্ঞানী Hershey and Chase একটি পরীক্ষা করেন যা Hershey and Chase Experiment নামে পরিচিত।

চিত্রঃ এভরি, ম্যাক্লিওড ,ম্যাকার্টির  এক্সপেরিমেন্ট

 Hershey এবং Chase এর পরীক্ষা :

১৯৫২ সালের Hershey এবং Chase এর এই পরীক্ষাটিকে জেনেটিকস এর জগতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ  আবিষ্কার বলা হয়।

Hershey এবং Chase এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, তারা জানতে চেয়েছিল আসলেই DNA জেনেটিক মেটেরিয়াল কিনা?

তাঁরা তাদের পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করেছিলেন,  কালচার মিডিয়াম যা হল একধরনের মিডিয়াম বা মাধ্যম যার মাধ্যমে নানা ধরনের মাইক্রঅরগানিজম উৎপাদনের ব্যবহারিত হয়।

দুধরনের রেডিও এক্টিভ আইসোটপ, একটি মিক্সার ব্লেনডার এবং সেন্ট্রিফিউজ টিউব। এই উপাদানগুলোর সাহায্যে তারা Bacteriophage এবং Bacterial strain এর মধ্যে পরীক্ষা চালান।

Bacteriophage এ phage কথাটা ব্যবহারিত হয় ভাইরাস এর জন্য তাই Bacteriophage হল এমন একটি ভাইরাস যা ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করে তার ভিতরে এর জেনেটিক মেটেরিয়াল প্রবেশ করায় এবং এর মাধ্যমে তার ভিতরে এর বংশ বৃদ্ধি করে।

এই Bacteriophage প্রধানত দুটি উপাদানে তৈরি , যার বাহ্যিক আকৃতি শুধু প্রটিন দিয়ে তৈরি এবং এর ভিতরে জেনেটিক মেটেরিয়াল থাকে যা DNA বা RNA উভয়ই হতে পারে।

Bacteriophage এর বাহিরের অংশ যেহেতু শুধু প্রটিন এবং ভিতরের অংশ জেনেটিক মেটেরিয়াল তাই তারা ঠিক করল দুধরনের রেডিও এক্টিভ Bacteriophage তৈরি করবেন।

একটি রেডিও এক্টিভ করবে Bacteriophage এর প্রটিন অংশকে যার জন্য তারা ব্যবহার করেন Sulphur 35 (35S) . কারন সালফার প্রোটিন পাওয়া যায় কিন্তু DNA তে পাওয়া যায়না।

আর ভিতরের জানেটিক মেটেরিয়ালের জন্য তারা ব্যবহার করলেন Phosphorus 32 (32P) কারন ফসফোরাস DNA তে পাওয়া যায় কিন্তু প্রোটিন পাওয়া যায়না।

তাঁরা এবার এই দুধরনের Bacteriophage কে পোশক ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে দিলেন এবং এরপর তা মিক্সার ব্লেন্ডারে দিলেন , কারন এর মাধ্যমে তার থেকে জেনেটিক মেটেরিয়াল ব্যাক্টেরিয়াম এর ভিতরে ঢুকার পর বাহিরে যে সম্পূর্ণ খালি Bacteriophage এর আবরণি থাকে তা আলাদা হয়ে যায়।

এরপর তারা সে মিক্সারকে টেস্টটিউবে নিয়ে  সেন্ট্রিফিউজ করেন। সেন্টিফিউজে যখন তা খুব জোরে ঘুরানো হয় তখন  গ্রভিটেশন বা মধ্যাকর্ষণ বলের ফলে সে বস্তু বা উপাদানের ভারি পদার্থগুলো নিচে পরে যায় । যাকে Pellet বলে এবং যে হালকা পদার্থগুলো উপরে থাকে তাকে Supernatant বলে।

তাহলে এই পরীক্ষার সাথে এই Pellet আর Supernatant এর সম্পর্ক কি?।

এখানেই আসলে সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি লক্ষ করা যায় যা পরবর্তিতে বিজ্ঞানের জগতে এক অভাবনীয় পরিবর্তন আনে।

এখানে Supernatant গুলো আসলে থাকবে সেই খালি Bacteriophage এর আবরণি যার মধ্যে কোন জেনেটিক মেটেরিয়াল নেই। অন্য দিকে Pellet এ থাকবে জেনেটিক মেটেরিয়াল। তাই যদি Sulphur 35 (35S) যুক্ত Pellet পাওয়া যায় তবে জেনাটিক মেটেরিয়াল বা বংশগতির ধারক ও বাহক হবে প্রটিন।

যদি  Phosphorus 32 (32P) হয় তবে বংশগতির ধারক ও বাহক হবে DNA ।

Hershey and Chase লক্ষ করলেন যে, Supernatant হিসেবে যা পাওয়া গিয়েছিল তা হল Sulphur 35 (35S) যুক্ত এবং Pellet হিসেবে যা পাওয়া গিয়েছিল তা  ছিল Phosphorus 32 (32P) যুক্ত ।

তাই এখান থেকেই বিজ্ঞানের নতুন যুগের সুচনা শুরু করে প্রমান হয় যে জানেটিক মেটেরিয়াল বা বংশগতির ধারক ও বাহক হল DNA ।

আর এভাবেই Griffith এর সেই ট্রন্সফরমেশন প্রিশিপাল বা মেটেরিয়াল যে DNA তা প্রমানিত হয় । এরফলে এতদিন যে DNA নিগৃহিত ছিল তা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে এবং তারা গঠন বা আকৃতি জানার জন্য উদগ্রিব হয়ে উঠেন আর তা জানতে হলে আমাদের যেতে হবে অন্য এক মজার রাজ্যে।

তথ্য সুত্রঃ

১। Principles of Genetics by Gardner, Simmons, Snustad .

২। Cell and molecular biology by Gerald Karp

৩। Lehninger Principles of Biochemistry by Nelson and Cox

Comments are closed.