ডিএনএ এর খোঁজে: পর্ব-২ ( ডিএনএ এর আকৃতি)

১ম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে

ডিএনএ যে অনু বা মলিকিউলটা ছিল সবার অগোচরে এবং অবহেলার পাত্র। ১৯৫২ সালের Harsehey এবং Chase এর পরীক্ষার মাধ্যমে অর্থাৎ ডিএনএ যে বংশগতির ধারক ও বাহক তা আবিষ্কারের পর , ডিএনএ হয়ে উঠে বিজ্ঞানীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

বিজ্ঞানীরা তখন এর গঠন বা আকৃতি জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন । হবেন নাই বা কেন ,কারন বিগত শতকের  বিজ্ঞানের সেরা আবিষ্কার বলা হয় ডিএনএ এর গঠন বা আকৃতি আবিষ্কারকে।

যদিও বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রেন্সিস ক্রিক ডিএনএ এর গঠন আকৃতির আবিষ্কারক বলা হয় এবং এর জন্য তারা নোবেল ও পেয়েছিলেন , কিন্তু  ডিএনএ এর গঠন আবিষ্কার এবং আবিষ্কারকদের এর পিছনের ভূমিকা নিয়ে কিন্তু আছে নানা মতভেদ এবং তর্ক-বিতর্ক।

ডিএনএ এর গঠনঃ

ডিএনএ এর গঠন আকৃতির আবিষ্কারের ঘটনায় যেতে হলে শুরুতে আমাদের বর্তমানে আবিষ্কৃত ডিএনএ এর গঠন সম্পর্কে জানতে হবে। যেমন ডিএনএ দেখতে কেমন? বা এর ভিতরে কি কি আছে?

ডিএনএ ডাবল হেলিক্স আকৃতির এবং প্রধানত ৩ ধরনের উপাদান দিয়ে তৈরি। একটি হল পেন্টজ শুগার অর্থাৎ ৫ কার্বন বিশিষ্ট শুগার। যার নাম ডিঅক্সিরাইবোজ । এটাকে ডিঅক্সিরাইবোজ বলা হয় কারন এর ২ নং কার্বন থেকে একটি অক্সিজেন অনুর অপসারণ হয়। আর এর কারনেই ডিএনএ কে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড বলা হয়।

দ্বিতীয় উপাদানটি হল ফসফেট গ্রুপ। যা ডিঅক্সিরাইবোজ মলিকিউলস বা অনু এক সাথে ধরে রাখে ৩ নং এবং ৫ নং কার্বনে।

সর্বশেষ আসে নাইট্রজেন বেসেস যা ডিএনএ এর মধ্যাংশ বা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অংশ গঠন করে। তারা হল এডেনিন (A), গুয়ানিন(G), সাইটোসিন(C), ও থায়ামিন(T)।

ওয়াটসন ও ক্রিকঃ

২৫ বছরের ওয়াটসন যখন আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে আসেন তখন সেখানের ক্যামব্রিজের ক্যাভেনডিস ল্যাবে তার সাথে পরিচয় হয় একজন ব্রিটিশ পদার্থবিদের যার নাম ছিল ফ্রন্সিস ক্রিক।

তাঁরা ঠিক করলেন তাঁরা ডিএনএ এর আকৃতির একটি মডেল বানাবেন এবং তখন পর্যন্ত প্রকাশিত নানা তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৫২ সালে  তারা দুজনে মিলে একটি মডেল বানিয়েছিলেনও কিন্তু তা ছিল সম্পূর্ন ভুল যার জন্য তখন তাঁরা অন্য বিজ্ঞানীদের কাছে হাসির পাত্রও হয়েছিলেন। তবুও তাঁরা থেমে যাননি তারা ডিএনএ নিয়েই কাজ করতে চাচ্ছিলেন কিন্তু সে ল্যাবের প্রধান স্যার ল্যরেন্স ব্রেগ তিনি চাচ্ছিলেন না তাঁরা ডিএনএ নিয়ে কাজ করুক। কারন তখন লন্ডনের কিংস কলেজে দুজন নামকরা বিজ্ঞানী তখন এ বিষয়ে কাজ করছিলেন তাঁরা হলেন , রোজালিন ফ্রাংকলিন এবং Mauric wilkins.

ওয়াটসন ও ক্রিকের ডাবল হেলিক্স 

কিন্তু ওয়াটসন ও ক্রীক তখন তাঁর কথা না শুনে এ বিষয়ে কাজ করতে লাগলেন এবং কিংস কলেজে গিয়ে রোজালিন ফ্রাংকলিন এর সাথে কথা বলতে লাগলেন। যদিও ফ্রাংকলিন এমন মডেল বানানোর প্রতি আগ্রহী ছিলেন না বরং তিনি কোন শক্ত প্রমানের মাধ্যমে ডিএনএ এর গঠন প্রমান করতে চাচ্ছিলেন।

রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনঃ

রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন যাকে ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের অনুজ্জ্বল এবং নিগৃহীত জনক বলা হয়ে থাকে।

রোজালিন্ড এলিস ফ্রাঙ্কলিন  ১৯২০ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহন করেন। ছোটবেলা থাকেই তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক ছিল ক্যামব্রিজে ক্যামিস্ট্রি নিয়ে পরার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তখনকার সময়ে মেয়েদের জন্য তা অত্যন্ত কঠিন এবং অনেকটা অবাস্তব ছিল। পরবর্তীতে  তিনি সেখান থেকে ক্যামিস্ট্রিতে পিএইচডি ও অর্জন করেন।

১৯৫১ সালে উইলকিন্সের আমন্ত্রনে  তিনি কিংস কলেজে যোগ দেন। এবং এক্সরে পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ডিএনএ এর গঠন বা আকৃতি জানার চেষ্টা করেন।

ফ্রাঙ্কলিন সেখানে ডিএনএ এর ভগ্নাংশ থেকে এক্সরে এর মাধ্যমে ডিএনএ এর আকৃতির ছবি তুলতে চেষ্টা করেন এবং তিনি সফলও হয়েছিলেন এবং তাঁর তোলা এক্সরে ছবি ৫১ কে ওয়াটসন ক্রিকের ডিএনএ আবিষ্কারের প্রধান উপজীব্য বলা হয় এবং পরবর্তিতে এই ছবির জন্য তাকে নোবেল দেয়ার জন্যও জোর প্রতিবাদ উঠে । কিন্তু তখনকার মেয়েদের জন্য বৈরি পরিবেশ এবং উইলকিন্সের সাথে তার তেমন ভাল সম্পর্ক না থাকার জন্য তিনি তাঁর কাজের কথাগুলো কারো সাথে তেমন বলতেননা।

ফটোগ্রাফ ৫১ 

আর ঠিক সেময়ই ওয়াটসন ও ক্রিক কিংস কলেজে তাঁর ডিএনএ এর আকৃতি নিয়ে কথা বলতে আসতেন।

Chargaff রুলঃ

বিজ্ঞানীদের মধ্যে যখন তর্কবিতর্ক চলছে ডিএনএ এর আকৃতি নিয়ে তখন একজন বিজ্ঞানী প্রকাশ করেন যে ডিএনএ তে যে নাইট্রজেনাস বেসগুলো আছে তা সব গুলো সমান অনুপাতে থাকেনা। এমন কি একটি নির্দিষ্ট পিউরিন একটি নির্দিষ্ট পাইরিমিডিন এর সাথে থাকবে এডিনিন(A) সব সময় থায়ামিনের(T) সাথে এনং গুয়ানিন(G) সব সময় সাইটোসিনের(C) সাথে থাকবে।

এডিনিন যত ভাগ থাকবে থায়ামিন ও ততোটুকু পরিমানই থাকবে এবং গুয়ানিন যতটুকু থাকবে সাইটোসিন ও ততটুকু পরিমাণই থাকবে।

এবং তারা একে অন্যের সাথে হাইড্রজেন বন্ড দ্বারা সম্পৃক্ত থাকবে , এবং এডেনিন থায়ামিনের সাথে ২টি হাইড্রজেন বন্ড দ্বারা গুয়ানিন সাইটোসিনের সাথে ৩টি হাইড্রজেন বন্ড দ্বারা যুক্ত থাকবে।

আর তার এই নিয়ম কে Chargaff রুল বলে।

Chargaff এর তত্ত্ব প্রকাশের পর বিজ্ঞানীদের মধ্যে নতুন করে চিন্তার শুরু হয় ডিএনএ নিয়ে।

এর মধ্যে ওয়াটসন এবং ক্রিক ও ছিল তারা ভাবছিল তারা হয়ত এবার কিছু করতে পারবেন কিন্তু তাদের এই চিন্তার মধ্যে এক নতুন চিন্তার উদ্ভব করলেন আর এক আমেরিকান বিজ্ঞানী লাইনাস পোনিল। কারন তারা ভয় পাচ্ছিলেন লাইনাস পোলিন হয়ত সবার আগে ডিএনএ এর আকৃতি আবিষ্কার করে ফেলবেন।

লাইনাস পোলিনের ত্রিপল হেলিক্সঃ 

লাইনাস পোলিন ছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে নামকরা কেমিস্ট এবং তিনি ডিএনএ নিয়ে কাজ করা শুরু করলেন।

১৯৫২ সালে লাইনাস PNAS এ ডিএনএ আকৃতির উপর তার একটি গবেষণা পত্র জমা দিলেন । যার একটি অনুলিপন  ১৯৫৩ সালের জানুয়ারির ২৮ তারিখে ক্যাম্ব্রিজে তার ছেলে পিটার পোলিনের কাছে আসে এবং সে তা তার বন্ধু ওয়াটসন এবং ক্রিককে তা দেখালেন।

ওয়াটসন এবং ক্রিক তা দেখার পর অনেকটা খুশি হয়েছিলেন কারন তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে পোলিন এর থিয়োরিটা ভুল ছিল। শুধু তারা নয় অন্য যে কেউ দেখলেই তারা বুঝত যে পোলিনের তত্ত্বটা ভুল ছিল।

কারন পোলিন তার ডিএনএ এর আকৃতিটা করেছিলেন ত্রিপল হেলিক্স এবং সেখানে সব নাইট্রজেনাস বেসগুলো বাহিরে ছিল এবং ফসফেট গ্রুপগুলো মধ্যখানে ছিল এবং একটা অন্যটার সাথে হাইড্রজেন বন্ড দ্বারা যুক্ত ছিল।

ত্রিপল হেলিক্স 

যা থাকা অসম্ভব কারন, ফসফেট গ্রুপগুলো হল নেগেটিভ চার্জ যার ফলে তারা কখনোই একসাথে থাকবেনা। যদিও পোলিন বলেছিলেন হাইড্রোজেন বন্ডগুলো তাদের নিউট্রাল রাখবে কিন্তু তা কোনভাবেই দীর্ঘস্থায়ী হবেনা।

যার কারনে তার এই তত্ত্বটি ভুল ছিল।

ওয়াটসন ও ক্রিক পোলিনের সেই রির্সাচ পেপার নিয়ে রোসালিন্ডের কাছে গেলেন নিশ্চিত হয়ার জন্য এবং সেও একই কথা বললেন।

ওয়াটসন ও ক্রিক বুঝতে পারলেন যে পোলিন তার এই ভুল খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন এবং সঠিকটা আবিষ্কার করে ফেলবেন।

তাই তারা আরও দ্রুত ডিএনএ এর গঠন আকৃতি তৈরিতে সচেষ্ট হন।

ঠিক এমন সময় একদিন তারা রোজালিন্ডের সাথে আবার কথা বলতে যান এবং সেখানে রোজালিন্ডকে না পেয়ে চলে আসার সময় তাদের কথা হয় তার সহকর্মী উইলকিন্সের সাথে।

উইলকিন্স তখন রোজালিন্ডের অনুমতি ছাড়াই তাদেরকে তার তোলা সেই বিখ্যাত এক্সরে ছবি ফটোগ্রাফ ৫১ তাদের কে দেখান।

আর তা দেখা মাত্রই ওয়াটসন এবং ক্রিক বুঝতে পারেন যে ডিএনএ হল ডাবল হেলিক্স আকৃতির।

এরপর তারা তাদের ল্যাবে আসার পর চিন্তা করলেন ডিএনএ ডাবল হেলিক্স, কিন্তু কিভাবে এতে ডাবল হেলিক্স আকৃতি হয় ? কিভাবে এটাতে নাইট্রজন বেসগুলো থাকে?

তখন ক্রিক ওয়াটসনকে বলল যে  Chargaff এর নীতি আমাদের এর মধ্যে ব্যবহার করতে হবে।

এটা শোনার পর ওয়াটসন রুম থেকে বের হয়ে যান এবং এর ঠিক এক ঘন্টাপর তিনি আবার ক্রিকের কাছে আসেন এবং বলেন যে তিনি ডিএনএ এর একটা আকৃতি তৈরি করেছেন।

যেখানে  Chargaff এর নীতি অনুযায়ী এডেনিন ,থায়ামিন ২টি হাইড্রজেন বন্ড দ্বারা আবদ্ধ এবং গুয়ানিন ও সাইটোসিন ৩টি হাইড্রোজেন বন্ড দ্বারা আবদ্ধ এবং সবসময় একসাথে।  ফ্রাঙ্কলিনের এক্সরে ছবি অনুযায়ি তা ডাবল হেলিক্সও ছিল।

যদিও ওয়াটসন তাকে এখনই অন্য সবাইকে তদের এই ত্বত্তের কথা  বলতে মানা করেছিলেন কিন্তু সেদিন তারা যখন দুপুরের খাবার খেতে সেখানের ঈগল ক্লাবে যান তখন তিনি সবাই কে চিৎকার করে বলেন যে আমরা জীবনের মলিকিউলের গঠন আবিষ্কার করেছি।

কারন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ওয়াটসন এর ত্বত্তটা সঠিক ছিল।

এরপর তারা তার দিয়ে ডিএনএ এর একটি মডেল আকৃতি তৈরি করেন এবং ১৯৫৩ সালের এপ্রিলের ২৫ তারিখ বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় তারা ২পাতার একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন এবং বর্তমানের ডিএনএ এর গঠন আকৃতির বর্ননা দেন। আর এভাবেই কোন ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই কিছু মানুষের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল দ্বারা তারা ডিএনএ এর আকৃতি আবিষ্কার করেন।

এবং পরবর্তীতে তারা যে সঠিক ছিলেন তা প্রমাণিত হয় এবং তার জন্য এর ১০ বছর পর ১৯৬২ সালে ওয়াটসন ও ক্রিক উইলকিন্সের সাথে নবেল পুরুষ্কারে ভূষিত হন। কিন্তু যার তোলা ছবির জন্য এই আবিষ্কার সম্ভব হয়েছিল সেই রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনই থেকে যান সবার অগোচরে কারণ সে সময় তিনি একজন মেয়ে বিজ্ঞানী ছিলেন তাই কেউ তা তেমন গ্রাহ্য করেননি এবং ক্যান্সারে তার মৃত্যু হয়।

রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন যার তোলা একটি ছবির জন্য ওয়াটসন ও ক্রিক পুরো বিজ্ঞানের জগৎটাকে পরিবর্তন করে ফেলেন তার জন্য তিনি পাননি কোন স্বীকৃতি।

ওয়াটসন ও ক্রিকের এই মডেলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারন এর মাধ্যমে কিভাবে বংগতিয় বৈশিষ্ঠ্য প্রবাহিত হয় অর্থাৎ ডিএনএ এর রেপ্লিকেশন বা অনুলিপন তৈরি এর ধারনা পাওয়া যায় এবং এর সাথে মিউটেশনের ধারনাও পাওয়া যায় ।

এ বৈশিষ্ঠ্যটাই তাদের মডেলটি কে করে তুলেছিল গুরুত্বপূর্ন এবং খুলে দিয়েছিল বিজ্ঞানের অন্য এক সম্ভাবনার দুয়ার।

তথ্য সুত্রঃ

১। http://dosequis.colorado.edu/Courses/MethodsLogic/papers/WatsonCrick1953.pdf

২। Lehninger Principles Of Biochemistry

৩। Nature

৪। Cell and Molecular Biology by Gerald Karp

Comments are closed.