ভারত-পাকিস্তানের সম্ভাব্য নিউক্লিয়ার যুদ্ধ ও সম্ভাব্য পরিণতি

আপনি হয়তো আন্তজার্তিক রাজনীতি নিয়ে খুব একটা খোঁজ খবর রাখেন না। কিন্তু তারপরেও বর্তমানে ভারত পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা নিশ্চয়ই শুনেছেন। তাদের মধ্যে এরই মাঝে বিমান যুদ্ধ হয়ে গেছে একবার। তার উপর এদের উভয়য়েরই আছে নিউক্লিয়ার অস্ত্র।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ

যদি এখন ভারত-পাকিস্তান নিউক্লিয়ার যুদ্ধে লিপ্ত হয় তবে সেই ধ্বংসলীলায় প্রাণ হারাবে বহু মানুষ। নতুন এক গবেষণা অনুযায়ী ৭ দিনেরও কম সময়েরও যুদ্ধে প্রাণ হারাবে ৫০-১২৫ মিলিয়ন মানুষ। ৬ বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতের চেয়েও বেশি মানুষ মারা যেতে পারে এই যুদ্ধে।

ভারত-পাকিস্তান জিওগ্রাফিক্যাল লোকেশন

কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় ও রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা নতুন একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। গবেষণাটি ছিলো ভারত পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার ফলে সম্ভাব্য নিউক্লিয়ার যুদ্ধ নিয়ে। আধুনিক যুগের এই নিউক্লিয়ার যুদ্ধ নিঃসন্দেহে পুরো পৃথিবীতে এক ঢেউয়ের সৃষ্টি করবে। বর্তমানে ভারত পাকিস্তান উভয়েরই ১৫০টির মতো আক্রমণ সক্ষম নিউক্লিয়ার মিসাইল রয়েছে। যেটা ২০২৫ সালের মধ্যে ২০০ ছাড়াবে বলে অনুমান করা যায়।

এই গবেষণা পত্রটি সাইন্স এডভান্স নামক জার্নালে গত ২রা অক্টোবর প্রকাশিত হয়। এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন কলোরাডো বোউল্ডার বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ব্রায়ান টুন। তার মতে,

এই যুদ্ধের ফলাফল হবে খুবই ভয়ানক। শুধুমাত্র লোকাল মানুষদের জীবন কেঁড়ে নিয়েই শান্ত হবে না এই যুদ্ধ। খুব সম্ভবত এই যুদ্ধ সমগ্র বিশ্বকে এক অদৃশ্য শীতলতায় নিমজ্জিত করে রাখবে।

ভারত পাকিস্তান উভয়ই বিভিন্ন উষ্কানিমূলক কাজ করে যাচ্ছে এই সম্ভাব্য যুদ্ধের পক্ষে। গেলো আগষ্টে ভারত সরকার তাদের সংবিধান পরিবর্তন করে সার্বক্ষণিক চড়াই-উতরাইয়ের মাঝে থাকা কাশ্মীরের মানুষদের সকল মৌলিক অধিকার কেঁড়ে নেয়। আর তারপরই সরকার কর্তৃক কাশ্মীরে সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। আর এঘটনার চরমতর নিন্দা করতে পাকিস্তান এতোটুকুও সময় নষ্ট করেনি।

গবেষক টুন এই যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে আরো বলেন,

ভারত পাকিস্তান নিউক্লিয়ার যুদ্ধ পৃথিবীর স্বাভাবিক মৃত্যুর হারকে দ্বিগুণ করবে। আর এই নিউক্লিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহতা মানব ইতিহাসের সকল ভয়াবহ ঘটনার তীব্রতাকে ছাড়িয়ে যাবে।

নিউক্লিয়ার যুদ্ধের ফলাফল বহুকাল ধরে বহু গবেষকদের নিকট পছন্দের একটি বিষয়। গবেষক টুন এবং তার ডিপার্টমেন্ট অব এটমোস্ফেরিক এন্ড ওশান সাইন্সেস কয়েক দশক ধরে এই বিষয়ের উপর গবেষণা করে যাচ্ছে। ভারত-পাকিস্তান রাজনৈতিক অবস্থার কারণে নিউক্লিয়ার যুদ্ধ সংক্রান্ত সকল বিষয় সামনে আসছে।

যদিও দুপক্ষের কেউই এখন পর্যন্ত তাদের নিউক্লিয়ার শক্তি প্রয়োগ করেনি। তারপরেও আনডিসকভারড এসব নিউক্লিয়ার অস্ত্র সুরক্ষিত অবস্থাতেও কম বিপজ্জনক নয়। আর এটা শুধুমাত্র গবেষক টুন নয় বরং পুরো পৃথিবী বিশ্বাস করে।

টুন আরো বলেন,

দুটো দেশই প্রতিনিয়ত তাদের অস্ত্র-শস্ত্রের উপর কাজ করে চলেছে। নিজেকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে। যেহেতু দুটো দেশেরই জনসংখ্যা অনেক বেশি। ফলে এসব অস্ত্রের ব্যবহারে বহু মানুষের প্রাণ যাবে। আর তার সাথে অমীমাংসিত কাশ্মীর দ্বন্দ্ব আছেই।

যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি

টুন ও তার সহকারী গবেষকেরা এই গবেষণায় শুধু একটি জিনিসই খুঁজেছেন। আর সেটা হল একটি যুদ্ধের ভয়াবহতা সর্বোচ্চ কি পরিমাণ হতে পারে। সর্বোচ্চ ভয়বহতার প্রমাণে তারা বিশাল পরিসরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কম্পিউটার সিম্যুলেশন তৈরি করেন। আর সেখানে ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোসিমা-নাগাসাকিতে নিউক্লিয়ার বম্বিং এপ্লাই করে বর্তমান যুগের সাথে তুলনামূলক ক্ষয়ক্ষতির একটি চিত্র নির্মাণ করেন।

বিশ্লেষণ অনুযায়ী এই বিধ্বংসী ঘটনার ফলাফল কয়েকটি ধাপে সবার সামনে আসবে। প্রথম সপ্তাতেই ভারত পাকিস্তান দুই পক্ষ মিলে একে অপরের বিভিন্ন শহরকে লক্ষ্য করে সম্মিলিতভাবে প্রায় ২৫০টি নিউক্লিয়ার মিসাইল ছাড়তে পারে।

নিউক্লিয়ার মিসাইল মডেল

অস্ত্রের তীব্রতা সম্পর্কে আন্দাজ করা খুবই কঠিন। তার উপর কোন পক্ষই প্রায় এক দশকের উপর হল নিউক্লিয়ার টেস্ট করেনি। তাও গবেষদের ধারণা প্রতিটি নিউক্লিয়ার এটাকে ৭০০,০০০ মানুষ মারা যেতে পারে।

তাৎক্ষণিকভাবে ব্লাস্টের কারণে বেশি মানুষ মারা যাবে না। ব্লাস্টের ফলে তৈরি হওয়া অনিয়ন্ত্রিত আগুনের কারণেই বেশি মানুষ মারা যাবে। এব্যাপারে টুন বলেন,

হিরোসিমার ব্লাস্টিং ঘটনায় উৎপন্ন হওয়া আগুনের প্রশস্ততা ছিলো ১ মাইল। হিরোসিমার বিপুল পরিমাণ ক্ষতির কারন ব্লাস্টিং ছিলো না, ছিলো অনিয়ন্ত্রিত আগুন।

আর সম্ভাব্য যুদ্ধ বাস্তবেই যদি হয় তবে পুরো বিশ্ব এবার সেই অনিয়ন্ত্রিত আগুনের তাণ্ডবলীলা দেখবে। আর প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের বাংলাদেশের ভোগান্তি যে কম হবে না সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

গবেষকদের হিসেব মতে ভারত-পাকিস্তান নিউক্লিয়ার যুদ্ধের কারণে প্রায় ৮০ বিলিয়ন পাউন্ড কালো ধোঁয়া পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করবে। সেই ধোঁয়া সূর্যের আলোকে মাটি পর্যন্ত পৌঁছাতে বাঁধা দেবে। পুরো পৃথিবীর তাপমাত্রা কয়েক বছরের জন্য গড়ে ৩.৫-৯ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। আর খুব দ্রুতই বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাব দেখা দেবে।

এই গবেষণার সহকারী লেখক নিকোলে লোভেনডাস্কি জানান,

আমাদের গবেষণায় পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের সিস্টেম মডেল নিয়ে আমরা কাজ করেছি। আর ফলাফল অনুযায়ী সব অঞ্চলেই প্রোডাকটিভিটি ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। মাটিস্থ উদ্ভিদ ও জলজ উদ্ভিদ উভয়ই হুমকির সম্মুখে পড়বে। ফলে মানুষসহ ফুড চেইনে উপরের দিকের প্রাণীগুলো মারাত্মকভাবে খাদ্য সংকটে পড়বে।

টুনের এই গবেষণাটি সকলের সামনে আনার পেছনে একটি উদ্দেশ্য আছে। আর সেটা হল নিউক্লিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে সকলকে অবগত করা। কারণ এরকম একটা যুদ্ধ হলে তার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে আলাদা করে রাখা সম্ভব নয়। আর ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ থেমে গেলেও গ্লোবাল নিউক্লিয়ার ওয়ারের সম্ভাবনা কিন্তু বিলুপ্ত হচ্ছে না। যেহেতু এই দুটো দেশই একমাত্র নয় যাদের নিউক্লিয়ার বোমা রয়েছে।

গবেষক টুন আরো বলেন,

আশা করি ভারত পাকিস্তান উভয় দেশই এই গবেষণা পত্রটির দিকে একটু খেয়াল করবে। কিন্তু আমেরিকানদের হয়তো নিউক্লিয়ার যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে এখনো জানানো হয়নি। এটা নিয়ে আমি একটু বেশি চিন্তিত।

হয়তো কথাটি টুন সাহেব বিদ্রূপ করেই বলেছেন। তবে শুধু টুন কেনো আমরা সকলেই চাই কোন যুদ্ধ যেনো না হয়। যেকোন যুদ্ধই কখনো কাম্য নয় সেটা নিউক্লিয়ার হোক বাঁশ-লাঠির।

তথ্যসূত্রঃ science daily

জার্নাল রেফারেন্সঃ Owen B. Toon, Charles G. Bardeen, Alan Robock, Lili Xia, Hans Kristensen, Matthew Mckinzie, R. J. Peterson, Cheryl S. Harrison, Nicole S. Lovenduski and Richard P. Turco. Rapidly expanding nuclear arsenals in Pakistan and India portend regional and global catastrophe. Science Advances, 2019   

Comments are closed.