বিলুপ্ত হওয়া প্রাণি কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব? কি বলছে বিজ্ঞান?

বিজ্ঞান সর্বদাই নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছে নতুন কিছু করার নেশায়। আজ সেরকমই এক নতুন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি, যা নিয়ে বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা অকাতর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ডি-এক্সটিংকশন ( Di-extinction )। এর অপর নাম রিসারেকশন বায়োলজি। অর্থ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণিকে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা। এখন এটা কি কোন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নাকি সত্যিই তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আজ আলোচনা হবে তাদের নিয়ে।

ডি-এক্সটিংকশন পদ্ধতিতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রানি আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে এই পদ্ধতির বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব এবং এর প্রয়োগ শুরুও হয়েছে। যেসব পদ্ধতিতে এর বাস্তব প্রয়োগ করা হচ্ছে সেগুলোর নাম ইংরেজিতে উল্লেখ করছি, বোঝার সুবিধার্থে, selective breeding, genetics, and reproductive cloning technologies। ক্রিসপার ক্যাস-৯ এর মতো আধুনিক জিন এডিটিং পদ্ধতি আবিষ্কারের মাধ্যমে বিলুপ্ত হওয়া প্রাণি ফিরিয়ে আনা তাত্ত্বিকভাবে সহজতর বলেই মনে হচ্ছে। এখন এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান হচ্ছে জিন। যে প্রাণি ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছি, অবশ্যই সেই প্রাণির জিন। যা আমরা পেতে পারি উক্ত প্রাণির দেহাবশেষ হতে। যেকোন প্রাণির জিন মোটামোটিভাবে ১.৫ মিলিয়ন বছর পর্যন্ত রিডেবল থাকে। অর্থ্যাৎ সেই জিন হতে তথ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তার মানে আমরা বুঝতেই পারছি যে আমরা চাইলেই ডাইনোসরকে ফিরিয়ে আনতে পারবো না, কারণটাও স্পষ্ট। ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে। ডাইনোসরের জিন এখন আনরিডেবল। তাহলে কোন প্রানিদের আমরা ফিরিয়ে আনতে পারবো? উলি ম্যামুথ, সেবার টুথড টাইগার, ডোডো পাখি, শর্ট ফেসড বেয়ার, হেয়ারলেস ডগ, নিয়্যানডারথ্যালস ইত্যাদি।

জিন এডিটিং হবে কিভাবে?

বিষয়টা একটু জটিল। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণির সাথে জিনগত ভাবে মিল আছে এরকম বর্তমানে জীবিত কোন প্রাণির জিনের সাথে ওই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণির জিনের ফিউশন ঘটাতে হবে। ব্যখ্যা করছি। ধরুন আমি উলি ম্যামুথকে ফিরিয়ে আনতে চাই যে ৩৬০০ বছর আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। উলি ম্যামুথের সবচেয়ে কাছাকাছি গোত্রের প্রানি হচ্ছে এশিয়ান হাতি। এশিয়ান হাতির জিনের সাথে এই ম্যামুথের জিন সবচেয়ে বেশি মিলে যায়। এশিয়ান হাতির জিনের সাথে এখন উলি ম্যামুথের জিনের মিশ্রন ঘটাতে হবে যাকে ফিউশন বলা হচ্ছে। এই ফিউশনের ফলে বা কৃত্রিম যৌনতার ফলে একটি হাইব্রিড প্রাণির উৎপত্তি ঘটবে। এই প্রানিটাই কি তবে উলি ম্যামুথ?? উত্তর হচ্ছে, না। খর্বাকার লোমবিশিষ্ট হাতির জন্ম হবে যে ম্যামুথের জিন বহন করে। এরপরের খেলাটা খেলবে বিবর্তন বা ইভোলিউশন। বিষয়টা সময়সাপেক্ষ। প্রতিবার ওই হাইব্রিড হাতির যৌনমিলনের ফলে নতুন যে হাতির জন্ম হবে তার মধ্যে ম্যামুথের জিন রেট ধীরে ধীরে বারতে থাকবে। এভাবে কয়েক হাজার বছরের মধ্যে একটি পরিপূর্ণ ম্যামুথের জন্ম হবে। ঠিক একইভাবে সেবার টুথড টাইগারের সাথে সবচেয়ে বেশি জিনগত মিল রয়েছে বর্তমানের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। যদিও রয়েল বেঙ্গল নিজেই বিলুপ্তির পথে, তাই আগে তাকে বাঁচাতে হবে। শর্ট ফেসড

চিত্রঃ উলি ম্যামুথ, এশিয়ান হাতি এবং এদের মধ্যেকার সম্ভাব্য ডি-এক্সটিংকশন।

চিত্রঃ সেবার টুথড টাইগার যার সাথে মিল রয়েছে আজকের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের।

বেয়ারের জন্য বর্তমানের ভাল্লুক। এভাবে জিন ফিউশন করে আমরা বিলুপ্ত এই প্রানিদের ফিরিয়ে আনতে পারবো।

আর নিয়্যানডারথ্যালস?

হোমো নিয়্যানডারথালেনসিস। এরা আধুনিক মানুষ হোমো সেপিয়েন্সের এক সাবডিভিশন। অনেক বিজ্ঞানী এদের পশু বলে অভিহিত করে থাকেন। কিন্তু আমি এদের এক ধরণের মানুষই বলবো। এরা ৪০,০০০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক মানব প্রজাতি। ইউরোপ আর ইস্ট এশিয়া ছিলো এদের আবাসস্থল। কিন্তু নিয়্যানডারথ্যালরা কি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে আদৌ? উত্তর হচ্ছে, না। বর্তমানের মানুষের জিনোমের মধ্যে এখনও ২% নিয়্যানডারথ্যাল জিন পাওয়া যায় আর সেপিয়েন্সের সাথে তাদের জিনোম সিকুয়েন্স প্রায় ৯৯.৭% মিলে যায়। ইউরোএশিয়ানদের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে কমপক্ষে ১% নিয়্যানডারথ্যাল জিন উপস্থিত। এর কারণ হিসেবে ধারণা করা হয়, ৫০০০ বছর ধরে এই দুই মানবপ্রজাতি একসাথে বাস করেছে তখন তাদের মধ্যে যৌনমিলন বা ইন্টারব্রেড ঘটেছিলো। যদিও মুখের আকৃতির কারণে অনেকে কালো চামড়ার আফ্রিকানদের নিয়ানডারথ্যাল বলে কটাক্ষ করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে আফ্রিকান পূর্বপুরুষদের সাথে তাদের কখনো দেখাই হয়নি।  তাই আমাদের থেকেই বিলুপ্ত হওয়া এই মানব প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানের ডায়েট এবং ভাইরাসের সাথে তারা তাল মিলাতে পারবেনা। তাই তাদের ফিরিয়ে আনলেও তারা খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না।

চিত্রঃ বিলুপ্ত হওইয়া নিয়্যানডারথ্যাল।

ফিরিয়ে আনার চেষ্টা।

আগেই বলেছি বিলুপ্ত হওয়া প্রানিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়েছে। পাইরেনিয়ান আইবেক্স, স্পেনের এক বুনো ছাগল যারা বিলুপ্ত হয়েছে ২০০০ সালের দিকে। ২০০৩ সালে এদের ফিরিয়ে আনার জন্য গবেষণা শুরু হয়। বেশ কয়েকবার ব্যর্থতাকে মেনে নিতে হলেও ২০০৯ সালে গবেষকরা সফলতার মুখ দেখেন। জিন এডিটিং করে জন্ম দেয়া হয় বিলুপ্ত হওয়া একটি মাদী পাইরেনিয়ান আইবেক্সের। ফুসফুসে ডিফেক্ট অর্থ্যাৎ এডিটিংয়ে ভুল থাকার কারণে মাত্র ৭ মিনিট পরেই মারা যায় এই বুনো ছাগল।

চিত্রঃ আইবেক্স

বিলুপ্ত প্রানি ফিরিয়ে এনে লাভ কি?

যেকোন কিছু করার আগে আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ যে আমরা কাজটা কেনো করবো। বিলুপ্ত হওয়া প্রানি আবার ফিরে আসবে, বিচরন করবে এই ধরণীতে। বিষয়টা ভাবতেই একটা কৌতূহল মনের ভেতর কাজ করে। তবে কি আমরা বিলুপ্ত হওয়া প্রানিদের ফিরিয়ে আনবো শুধুই নিজেদের কৌতূহল মেটাতে? যদি কারণ এটাই হয় তবে তাদের ফিরিয়ে না আনাটাই ভালো কারণ তাদের ফিরিয়ে আনার সাথে অনেক অনিশ্চয়তা জড়িয়ে আছে। যেটা এখন পর্যন্ত আপনাদের অনেকেই ভাবেননি। সেগুলো হচ্ছে, তাদের ফিরিয়ে আনলে আমাদের ইকোসিস্টেমে কি ধরণের পরিবর্তন আসবে? এখনকার মতো তখনও কি সেপিয়েন্সরা ফুড চেইনে সবার উপরে থাকবে? ফিরিয়ে আনা প্রানিদের কারণে অন্য কোন প্রানি বিলুপ্তির মুখ দেখবে না তো? দিন দিন মানুষের আচরণে মানবতা বা দয়ামায়া কমে যাচ্ছে।  হতে পারে মানুষ পশু পাখিদের উপর আরো হিংস্র হয়ে উঠলো! শুরু হলো অবাধ শিকার। মানুষ ভাববে শিকারের ফলে অসুবিধা কি, বিলুপ্ত হলে আবার ফিরিয়ে আনা যাবে।

তাই আমাদের উচিৎ শুধুমাত্র সেসব বিলুপ্ত হওয়া প্রাণিকেই ফিরিয়ে আনা যাদের প্রয়োজন আছে। আর বিলুপ্তির পথে থাকা বর্তমানের প্রানিদের রক্ষা করা। তবেই হয়তো পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে পারবো।

References: What If, Big bang to homo sapiens(book), britannica.com, NCBI, Curiosity, National Geography, ThoughtCO

ধন্যবাদ।

Comments are closed.