আইজ্যাক নিউটন-বিজ্ঞানের দুনিয়ায় সবচেয়ে সম্মানিত ব্যাক্তি

 

লুকাসিয়ান প্রফেসর অব ম্যাথেমেটিক্স হলো কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এর গণিতের অধ্যাপকের একটি পদ। এটি সারা বিশ্বের অন্যতম এবং বলা যায় সবচাইতে সম্মানজনক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানিক পদ। এই পদে অধ্যাপক হিসেবে যারা অধিষ্ঠিত ছিলেন তারা নিজ নিজ সময়কার অন্যতম প্রভাবশালী পদার্থবিদ এবং গণিতবিদ।চার্লস ব্যাবেজ,জর্জ গ্যাব্রিয়েল স্টোকস এবং স্টিফেন হকিংস এর মত সম্মানিত ব্যক্তিগণ এই পদটিতে আসীন ছিলেন। ১৬৬৯ সালে আইজ্যাক ব্যারোর পরপরই মাত্র ২৫ বছর বয়সে দ্বিতীয় লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসেবে যোগদানের বিরল সম্মান অর্জন করেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। বলবিদ্যা,গণিত ও আলোকবিজ্ঞানের জগতে যিনি স্বমহিমায় বিচরণ করেছেন এবং সমৃদ্ধ করে গেছেন পদার্থবিদ্যা এবং গণিতের শাখাগুলোকে। বিজ্ঞানের জগতে যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানতাপস। যাকে কোন বিশেষণে কোন শব্দ দিয়ে আবদ্ধ করা যায়না।

সর্বশ্রেষ্ঠ কয়েকজন বিজ্ঞানীর নাম বলতে বলা হলে অনেকে যদিও অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের নাম প্রথমে উচ্চারণ করেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের মধ্যে স্যার আইজ্যাক নিউটনের নাম কখনোই দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলোনা এবং আসবেও না। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন নিজে তাকে এতটা শ্রদ্ধা করতেন যে তার স্টাডিরুমে স্যার আইজ্যাক নিউটনের একটি পোট্রেট লাগানো ছিলো। তার জ্ঞান ও পারদর্শিতার প্রতি শ্রদ্ধা করে আইনস্টাইন বলেন, “নিউটনের কাছে প্রকৃতি ছিলো একটি খোলা বইয়ের মত যার প্রতিটি পাতা তিনি খুব সহজে পড়তে পারতেন”। নিউটনের ব্যাপারে অনেকের জ্ঞান বা জানার জায়গাটুকু শুধু আপেলের গল্প পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। আজকের লিখার উদ্দেশ্য পদার্থবিদ্যার এই রাজপুত্রকে আরেকটু নতুন করে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা।

শৈশব

 

(image: woolsthorpe manor,family home of Isaac Newton)

আইজাক নিউটন ১৬৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর (মতান্তরে ১৬৪৩ সালের ৪ জানুয়ারি) ইংল্যান্ডের লিঙ্কনশায়ারের ওল্‌সথর্প ম্যানরে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের কয়েক মাস আগেই তার পিতার মৃত্যু হয়। নিউটনের জন্মের তিন বছর পর তার মা বারনাবাস নামে এক লোককে বিয়ে করেন। নিউটন এই লোককে পিতা হিসেবে গ্রহণ করেননি। নিউটনকে দাদীর কাছে রেখে তার মা স্বামীর সাথে চলে গেলেন। ১২ বয়সের বয়সে তাকে গ্র্যান্থামের একটি স্কুলে ভর্তি করা হয় ব্যাকরণ এবং ভাষা শিক্ষার জন্য।সে সময় থেকে নিউটনের অসাধারণ প্রতিভার কিছু প্রতিফলন দেয়া যায়। তার মেকানিকাল নলেজ কাজে লাগিয়ে স্কুলে অধ্যয়নরত সময়েই তিনি তৈরি করেন উইন্ডমিল,জলঘড়ি ইত্যাদি যন্ত্র।

উচ্চশিক্ষা

১৬৬১ সালে, ১৮ বছর বয়সে স্যার আইজ্যাক নিউটন চলে আসেন ক্যামব্রিজে। ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে তার একাডেমিক ক্যারিয়ারের সূচনা হয় আইন বিষয়ক ডিগ্রী নিয়ে পড়াশোনার মাধ্যমে। তার জীবনের ৩৫ বছরেরও বেশি সময় কেটেছে এই ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।সে সময় গ্রাজুয়েশনের পাশাপাশি তিনি ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে প্রকাশিত হওয়া প্রাকৃতিক দর্শন,গণিত এবং জ্যামিতির বই পুস্তক নিয়ে মগ্ন থাকতেন। কলেজের পড়াশোনায় তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তখন তিনি রবার্ট বয়েল, গ্যালিলিও গ্যালিলি এবং জোহান কেপলারদের মতো তার যুগের আধুনিক বিজ্ঞানীদের বই পড়তে শুরু করেন। নিজের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় অর্থের জন্য তিনি ধনী ছাত্রদের ভৃত্য হিসেবে কাজ করতেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে পদার্থবিদ্যার রাজপুত্র তিনি, যার হাত ধরে পদার্থবিদ্যা আজ এই অবস্থানে, সে সময় আসলে পদার্থবিদ্যা বলতে কোন বিষয় ছিলো না। তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করতে করতে এই তিন বছরের ভেতর নিজ প্রচেষ্টায় তিনি গণিতে বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন।

লুকাসিয়ান প্রফেসরশিপ

১৬৬৫ সালে মহামারি আকারে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ায় দীর্ঘ ১৮ মাস পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। নিউটন ওলসথর্প ম্যানরে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। এই সময়েই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সূত্রপাত ঘটে। পুনরায় ক্যমব্রিজে ফিরে আসার পর তিনি ট্রিনিটি কলেজের ফেলো নির্বাচিত হন এবং পরবর্তীতে ১৬৬৯ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসেবে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।

দ্যা ওয়ান্ডারফুল ইয়ার

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকাকালীন দীর্ঘ দুই বছর আইজ্যাক নিউটন ওলসথর্পে নিজ বাড়িতে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় মত্ত ছিলেন। তিনি এই সময় আলোকবিজ্ঞান, গণিত এবং গতিবিদ্যার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে বসেন। এই সময়টুকুকে নিউটনের জীবনের “অ্যানাস মিরাবলিস” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইংরেজিতে যার মানে দাড়ায় “wonderful year” এবং আইজ্যাক নিউটন পরবর্তীতে এই সময়টিকে তার নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বলে উল্লেখ করেন। এই সময়েই ঘটে যায় লোকমুখে প্রচলিত সেই ঘটনা। নিজের লাইব্রেরি থেকে দাঁড়িয়ে একটি আপেলকে মাটিতে পড়তে দেখে তিনি মহাকর্ষ বল সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা লাভ করেন। এবং এরই সাথে সাথে তিনি গ্রহ উপগ্রহের আবর্তন সম্পর্কিত সকল রহস্যের সমাধান করে ফেলেন। তখনও এই আবিষ্কারগুলো তিনি নিজের মধ্যে রেখে দেন। তার কাছে এসব আবিষ্কার খুব সাধারণ মনে হলেও তিনি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি একের পর এক যে আবিষ্কার তিনি করে যাচ্ছেন তা কতটা গুরুত্ববহ। বর্ণালী বিষয়ক বেশ কিছু গবেষণা এবং ক্যালকুলাস এর কিছু মৌলিক ধারণা তিনি এসময় লিপিবদ্ধ করেন যেগুলো পরবর্তীতে ১৬৬০ থেকে ১৬৭০ এর মাঝামাঝি ক্যামব্রিজে থাকাকালীন সময়ে পুনরায় গবেষণার মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে।

ক্যামব্রিজ ও নিউটনের কর্মজীন

আইজ্যাক নিউটনের জন্য ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো তার কর্মজীবন,তার সফলতা এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের স্বর্গরাজ্য। গণিতের অধ্যাপক হওয়া সত্ত্বেও তার অধ্যাপনার বেশিরভাগ বিষয়বস্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে জমা হতে থাকতো। এর কারণ ক্লাসে ছাত্রছাত্রীর অনুপস্থিতির হার এতটাই বেশি ছিলো গণিত বিষয়ক আলোচনা মাঝে মধ্যে ক্লাসরুমের চার দেয়াল আর তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। বাকি সময়টুকু তিনি নিজের ঘরে বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন।

রয়্যাল সোসাইটি ও আইজ্যাক নিউটন

আইজ্যাক নিউটন তার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং ফলাফল কারো কাছেই প্রকাশ করতেন না এবং কারও সাথে এসব বিষয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করতেন না। তিনি ১৬৬০ এর শেষ দিকে তার নিজের তৈরি করা একটি টেলিস্কোপ লন্ডনে পাঠান। রয়্যাল সোসাইটি তার আবিষ্কারে মুগ্ধ হয়ে তাকে আরও কিছু টেলিস্কোপ পাঠানোর জন্য আহবান জানায়। আইজাক নিউটন টেলিস্কোপের ডিজাইন এবং মেকানিজম লিপিবদ্ধ করে রয়্যাল সোসাইটির কাছে প্রেরণ করেন এবং একটি বিবাদে জড়িয়ে পড়েন যা দীর্ঘ চার বছর ধরে চলতে থাকে। এবং এরপর থেকে তিনি নিজের আবিষ্কার ও গবেষণার পুরোটাই গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেন। সমালোচনা, বিবাদ-বিতর্ক তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না।

১৬৮৪ সালে রয়্যাল সোসাইটির সেক্রেটারি এডমন্ড হ্যালি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন আইজাক নিউটনের সাথে সাক্ষাতের জন্য। তিনি আইজ্যাক নিউটনের সাথে গ্রহ উপগ্রহের গতিপথ, আবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন যা বহু শতাব্দী ধরে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য একটি বিভীষিকা হয়ে আছে, যে রহস্য তখনও পর্যন্ত কেউ পুরোপুরি সমাধান করতে পারেনি। কিন্তু আইজ্যাক নিউটন যে উত্তর দিলেন তার জন্য এডমন্ড হ্যালি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। গত কয়েক বছরে আইজ্যাক নিউটন সৌরজগত, গ্রহ উপগ্রহের গতিপথ এবং আবর্তন সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সমাধান করে নির্ভুল ফলাফল বের করে ফেলেছেন শুনে হ্যালি যারপরনাই বিস্মিত হলেন। বহু ঘেটেঘুটে কিছু কাগজপত্র বের করলেন আইজ্যাক নিউটন। সব দেখেশুনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন তরুণ বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালি।
হ্যালি তখন উক্ত ফলাফলগুলো প্রকাশনার জন্য তাকে উৎসাহিত করতে থাকলেন। নিউটন এতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন না দুটি কারণে। প্রথমত, তিনি পুনরায় লন্ডনের বিজ্ঞানীদের সাথে বিবাদে জড়াতে চান না এবং দ্বিতীয়ত, তার কাছে গবেষণাপত্র প্রকাশ করবার মত পর্যাপ্ত অর্থের সংকট ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইজ্যাক নিউটন নিজের বেশ কিছু গবেষণা এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রকাশ করার ব্যাপারে সম্মত হলেন। এবং এডমন্ড হ্যালি নিজে প্রকাশনার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করলেন।

প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা

অবশেষে ১৬৮৭ সালে রয়্যাল সোসাইটির পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হলো বিজ্ঞানের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং অমূল্য গ্রন্থ ‘ফিলোসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা’।যেখানে তিনি সর্বজনীন মহাকর্ষ এবং গতির তিনটি সূত্র বিবৃত করেন। সারা পৃথিবীজুড়ে সাড়া ফেলে দেয় এই সূত্রগুলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে আজ ৩০০ বছর পর এখনও আমাদের নবম শ্রেণীতে ওঠার পর এমনকি উচ্চমাধ্যমিকের পদার্থবিদ্যা শেখা শুরু হয় গতিবিদ্যার এই সূত্রগুলো দিয়ে। নবম শ্রেণীতে আমাদের পদার্থবিদ্যার হাতেখড়ি হয় যে তিনটি সূত্র দ্বারা এবং আমাদের বলবিদ্যার হাতেখড়ি যে সামান্তরিক সূত্র দ্বারা, ভাবতেই অবাক লাগে এসব সূত্র তিনশ বছর আগে একজন মানুষ হুবহু এভাবেই লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এছাড়া এরোডায়নামিক্স, ফ্লুয়িড ডায়নামিক্স, অপটিক্সের কথা তো বাদই দিলাম। পদার্থবিজ্ঞান,গণিত এমনকি রসায়নের সিংহভাগ সূত্রে ক্যালকুলাসের ব্যাবহার করা হয়। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে দৃশ্যমান জগতের আলো ব্যতীত যেকোনো পদার্থের সকল ধরণের গতি বা স্থিতি নিউটনিয়ান বলবিদ্যা ছাড়া ব্যাখ্যা করা যায়না। দৃশ্যমান জগতে এমন কোন গতি বা স্থিতি নেই যা নিউটনের সূত্র দারা ব্যাখ্যা করা যাবেনা। এই গ্রন্থের প্রকাশনার পরপরই তার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের তালিকায় তিনি অবস্থান করে নিলেন। ১৬৯৬ সালে নিউটন নিজে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে লন্ডনে চলে আসেন। ১৭০৩ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পদে আসীন ছিলেন।

[ বই এর পিডিএফ লিংক ]

নাইট উপাধি

১৭০৫ সালে কেমব্রিজে অনুষ্ঠিত একটি রাজকীয় সভায় কুইন অ্যান কর্তৃক তিনি নাইট উপাধিতে ভূষিত হন আইজ্যাক নিউটন থেকে হয়ে যান স্যার আইজ্যাক নিউটন। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি সর্বপ্রথম নাইট উপাধিতে ভূষিত হবার গৌরব লাভ করেন।

যুগান্তকারী আবিষ্কার

নিউটন তার ৮৪ বছরের জীবদ্দশায় যে পরিমাণ জ্ঞান আহরণ করেছেন যা কিছু আবিষ্কার করে গেছেন তার দশ ভাগ ঠিকভাবে বুঝতে বা আত্মস্থ করতে যে পরিমাণ বই পুস্তক পড়ার প্রয়োজন তাতেই হয়তো একজন মানুষের জীবনের অর্ধেকটা সময় কেটে যাবে। কাজেই তিনি যা কিছু আবিষ্কার করে গেছেন যা কিছু রেখে গেছেন তিন শতক ধরে বিজ্ঞানে যার চর্চা হচ্ছে এবং হবে তার পরিসর কতটা বিশাল তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। তার ভেতর কিছু সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এবং অবদান সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।

– দ্বিপদ রাশির সার্বজনীন সূত্র আবিষ্কার।

– প্রিজমের মাধ্যমে সূর্যরশ্মির বিশ্লেষণ এবং সাতটি আলোর বিভাজন আবিষ্কার।

– প্রতিফলন টেলিস্কোপ আবিষ্কার।

– পরিবর্তনের গাণিতিক রূপ ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন যা ছাড়া ইলেকট্রনের মতো ক্ষুদ্র কিংবা ছায়াপথের মতো বৃহৎ বস্তুর প্রকৃতি বোঝা সম্ভব ছিল না।

– বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা লেখেন।

– মহাকর্ষ এবং সার্বজনীন মহাকর্ষীয় ধ্রুবক আবিষ্কার করেন।

– গতির তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেন।

– মহাকর্ষের কারণে বস্তুর কণিক গতিপথ আলোচনা করেন যেমন বৃত্তাকার, উপবৃত্তাকার বা অধিবৃত্তাকার যা মহাকাশে গ্রহ নক্ষত্রের গতিপথও আলোচনা করে।

– মহাকর্ষের কারণে জোয়ার-ভাটা হওয়া প্রমাণ করেন।

– পৃথিবী সম্পূর্ণ গোল নয় বরং মেরু অঞ্চলে কিছুটা চাপা এই বাণী প্রদান করেন।

ব্যাক্তিগত জীবন

নিউটনকে আমরা যে বিষয়টির জন্য চিনি তা হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞান। কিন্তু তার ল্যাবরেটরির কাগজ পত্র বলে তিনি আলকেমি তথা রসায়নের পেছনে নিজের শেষ জীবনের সময়টুকু ব্যয় করেছেন। কিন্তু আলকেমি বিষয়ক তার কাজকর্মের তেমন কিছুই জানা যায়নি। কোন এক অজানা কারণে আলকেমি বিষয়ক সকল কাগজপত্র তিনি পুড়িয়ে ফেলেন। উল্লেখ্য যে সে সময় আলকেমি চর্চায় আইনত কিছু সীমাবদ্ধতা ছিলো এবং রসায়ন সম্পর্কিত এমন কিছু বিষয় ছিলো যেগুলো চর্চা আইনত নিষিদ্ধ ছিলো।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণই নিউটনের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার ব্যাপারটি লক্ষ করেন। তার বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে তিনি তার কাজের খুব কমই প্রকাশ করতেন। কেননা একবার রবার্ট হুকের সাথে একটি গবেষণাপত্রের ব্যাপারে তিনি বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। এরপর থেকেই তিনি হুকের প্রতি যতদিন বেঁচে ছিলেন বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। তাছাড়া তিনি যখন ক্যালকুলাসে পারদর্শী, তখনও তিনি ক্যালকুলাস বিষয়ক তার কাজের খুব কম অংশই প্রকাশ করেছিলেন। ফলে লেবিনিজ যখন ক্যালকুলাস নিয়ে নিজের কাজ প্রকাশ করতে শুরু করেন, তখন তা একটি বিতর্কের সৃষ্টি করে। এমনকি তিনি লেবিনিজের বিরুদ্ধে তার গবেষণা চুরি করার অভিযোগও করেন!

ব্যক্তিজীবনে নিউটন ছিলেন ভীষণ ধার্মিক। আনঅর্থডক্স প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। জীবনে অনেক সময় নিউটন ব্যয় করেছিলেন ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা করে, লেখালেখি করে এবং বাইবেলের ব্যাখ্যা করে। তিনি অপরাপর পদার্থবিদদের মতো ছিলেন না, বরং পুরো মাত্রায় আস্তিক ছিলেন। তিনি মহাকাশের জটিলতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন- এগুলো ঈশ্বর ছাড়া আর কারো পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।

শেষ কথা

১৭২৭ সালের ৩১ মার্চ নিউটন ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে তাকে সমাহিত করা হয়।

(image: burial of Isaac Newton)

স্ট্রিং থিওরি নিয়ে জানবার জন্যে একবার আমি একবার প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী মিশিও কাকুর একটি বক্তব্য দেখছিলাম। স্ট্রিং থিওরি ব্যাখ্যার এক পর্যায়ে তিনি বললেন, ” মহাকাশে রকেট পাঠাবার জন্য পর্যন্ত আপনি আগে আপেক্ষিকতা নীতির কাছে যাবেন না, আপনাকে আগে যেতে হবে স্যার আইজ্যাক নিউটনের কাছে। বল, গতিবিদ্যা এবং স্থিতিবিদ্যা বোঝার পরই আপনি পদার্থবিদ্যার বাকি ব্যাপারগুলো বুঝতে আসুন”। যিনি সব বিশেষণের ঊর্ধ্বে, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলেও তার পরিচয় শেষ করে দেয়া যায়না, বিজ্ঞানের জগতে এমন একটি নাম যার চর্চা গত তিন শতাব্দী ধরে হয়ে আসছে এবং যতদিন পৃথিবী টিকে থাকবে ততদিন হতে থাকবে।

মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে তিনি বলেছিলেন:

“আমি জানিনা বিশ্বের কাছে আমি কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছি, কিন্তু আমার কাছে আমার নিজেকে মনে হয় এক ছোট বালক যে কেবল সমুদ্র উপত্যকায় খেলা করছে এবং একটি ক্ষুদ্র নুড়ি বা ক্ষুদ্রতর এবং খুব সাধারণ পাথর সন্ধান করছে, অথচ সত্যের মহাসমুদ্র তার সম্মুখে পড়ে রয়েছে যা অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেল। ”

Comments are closed.