হাবল স্পেস টেলিস্কোপ, নিঃসন্দেহে বর্তমানে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পরিচিত একটি টেলিস্কোপ। ১৯৯০ সালে ডিসকভারি স্পেস শাটলের সাথে জুড়ে এটিকে পৃথিবীর লোয়ার আর্থ অরবিটে স্থাপন করা হয়। সেই থেকে আজ ২৮ বছর ধরে এটি মহাকাশ গবেষণায় নিরন্তন কাজ করে আসছে। মহাকাশের হাজার হাজার ঝলমলে ছবি তুলেছে হাবল। হাবলের জন্য জ্যােতির্বদ্যায় কতখানি অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা বলার মত নয়। সুপারনোভাদের দূরত্ব, গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ,ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের প্রমাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক সাহায্য করেছে হাবল ।
তবে বর্তমানে আমেরিকান স্পেস এজেন্সি (NASA) এমন একটি টেলিস্কোপ তৈরি করছে যা হাবল স্পেস টেলিস্কোপ থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। এই টেলিস্কোপ টির নাম ‘ জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ‘। নাসা ছাড়াও টেলিস্কোপ টি তৈরিতে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ( ESA ) এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (CSA) সাহায্য করছে। এই স্পেস টেলিস্কোপ টি তৈরি করতে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। এই টেলিস্কোপ টিকে হাবলের উত্তরসূরি বলা হচ্ছে।
জেমস এডউইন ওয়েব ( ১৯০৬ – ১৯৯২), যিনি একাধারে ছিলেন ব্যবসায়ী, অ্যাটর্নি, এবং নাসার পরিচালক। ১৯৬১-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি নাসার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নাসার অ্যাপোলো-১ দুর্ঘটনার পর মৃতপ্রায় নাসাকে তিনিই উঠে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। তার সময়কালে নাসা থেকে ৭৫ টির ও বেশি মহাকাশ যান উড্ডয়ন করেছিল। তার নির্দেশিত পথেই নাসা থেকে রিটায়ারমেন্টের কিছুদিন পর ই, অ্যাপোলো-১১ এর চাঁদে পদচিহ্ন একে দেয়ার ঘটনাটি সংঘটিত হয়। এই মহান ব্যক্তিকে ভুলেনি নাসা। তাই তার নামেই নামকরণ করা হয়েছে সর্বকালের সেরা টেলিস্কোপটির।
জেমস ওয়েব-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রটি হলো এর শক্তিশালী ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ। ইনফ্রারেড, মহাকাশ পর্যবেক্ষণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে এর দ্বারা অদৃশ্য জগতেও আবিষ্কার করা সম্ভব হয় অজানা সব উপাদান। এছাড়া যেহেতু ইনফ্রারেড হলো লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শেষ মাত্রা, তাই এর দ্বারা মহাকাশীয় বস্তুসমূহের রেডশিফ্ট, বা দূরে সরে যাওয়া সনাক্ত করা খুব সহজ হবে। আর এর ফলে আমাদের থেকে অনেক অনেক দূরবর্তী বস্তুর দূরে সরে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট রেডশিফ্ট সনাক্ত করার মাধ্যমে সেগুলোকে দেখাও সম্ভব হবে, মহাকাশের আরো গহীনে দৃষ্টি দেয়া সহজ হবে। আর, ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশের ধূলার কৃষ্ণমেঘ বা ডার্ক ক্লাউড অফ ডাস্ট ভেদ করে তাকাতে পারবে বলে জেমস ওয়েবের দৃষ্টি হবে আরো প্রসারিত। ইনফ্রারেড দিয়ে সনাক্ত করা সম্ভব হবে রেডিয়েশন বা বিকীরণ। সুতরাং স্রেফ একটা ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশে আমাদের চোখটা হয়ে উঠবে অনেক অনেক শক্তিশালী।
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ESA) রকেট আরিয়ান-৫ এর সাহায্যে ২০২১ সালের মার্চ মাসে উৎক্ষেপণ করা হবে এই টেলিস্কোপ টি। রকেটের পোলার্ড কম্পার্টমেন্টে টেলিস্কোপ টি আয়নাগুলোকে গুটিয়ে রাখবে। প্রায় ১৮ টি টুকরার সমন্বয়ে তৈরি এর প্রতিফলক আয়না তৈরি হয়েছে বেরিলিয়াম দিয়ে,কারণ প্রচলিত আয়নাগুলোর চেয়ে বেরিলিয়াম ঠাণ্ডায় সংকুচিত হয় কম। আয়নাগুলোর বসাবার স্থানটি ২৪ ক্যারেট সোনা দিয়ে বাঁধানো থাকবে। কারণ ইনফ্রারেড আলো প্রতিফলনে সোনা খুব বেশি উপযোগী— যেখানে সাধারণ আয়না ৮৫% প্রতিফলনক্ষম, সেখানে সোনার ব্যবহারে তা ৯৮% প্রতিফলনক্ষম হয়ে উঠে। ওয়েবের আয়না হবে হাবলের আয়নার ৭ গুণ, আর স্পিৎজার টেলিস্কোপ এর আয়নার ৫০ গুণ বড়। এটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ধারণক্ষমতা ০.৬ – ২৮.৫ মাইক্রোমিটার। এটিকে সূর্যের কিরণ থেকে রক্ষা করার জন্য অ্যালুমিনিয়াম,সিলিকন এবং কেপ্টন দিয়ে তৈরি একটি টেনিস কোর্টের আকারের ৫ স্তরের Sun Shield ব্যবহার করছে। যা ইনফ্রারেড ক্যামেরা এবং এর সেন্সর সমূহ কে প্রোটেক্ট করবে। এই টেলিস্কোপের অপারেটিং তাপমাত্রা শূন্যের নিচে ২২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ( মাইনাস) ।
এই টেলিস্কোপ এর মূল যন্ত্র ৪ টি। সেগুলো হল –
১.প্রায়-অবলোহিত ক্যামেরা (Near Infrared Camera: NIRCam) : ০.৬ – ৫ মাইক্রোমিটার
২.প্রায়-অবলোহিত বর্ণালীবীক্ষণ (Near Infrared Spectrograph: NIRSpec) : ০.৭ – ৫ মাইক্রোমিটার
৩.মাঝারি-অবলোহিত যন্ত্রপাতি (Mid Infrared Instrument: MIRI) : ৫ – ২৮.৫ মাইক্রোমিটার
৪.মসৃণ নির্দেশক সেন্সর/ প্রায়-অবলোহিত ধারক ও ফাঁটলহীন বর্ণালীবীক্ষণ (Fine Guided Sensor/Near-Infrared Imager and Slitless Spectrograph: FGS/NIRISS) : ০.৬ – ৫ মাইক্রোমিটার
হাবল টেলিস্কোপ যেখানে পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ৩৮০ মাইল দূরে আছে, জেমস ওয়েবকে স্থাপন করা হবে এর থেকে আরো অধিক দূরে। পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে এর দূরত্ব হবে ৯ লক্ষ ৪০ হাজার মাইল। এই ঘূর্ণন পথকে ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট বলা হয়ে থাকে। ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট হলো এমন পাঁচটি পয়েন্ট, যেখানে দুটো ঘূর্ণনশীল বস্তুর মাঝখানে তৃতীয় আরেকটি বস্তু তাদের মাধ্যাকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে মাঝামাঝি একটা নিরাপদ এবং স্থায়ী দূরত্ব ধরে চলতে পারে। জেমস ওয়েবকে এই পাঁচটি ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্টের মধ্যে দ্বিতীয় পয়েন্টে রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই জায়গায় স্যাটেলাইট থাকার সুবিধা হল, পৃথিবীর সাথে সমান্তরালে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে এবং সূর্য, পৃথিবী ও L2 point সব সময় একই লাইনে থাকে। যার ফলে, পৃথিবী থেকে সব সময় যোগাযোগ রাখা সম্ভব হবে স্যাটেলাইটের সাথে, যেহেতু সূর্য একপাশে থাকবে তাই সূর্যের আলো (পৃথিবীর তাপও থেকেও রক্ষা হবে যা এলবিডু নামে পরিচিত ) সরাসরি আসবে না স্যাটেলাইটে। এই ধরনের ব্যবস্থা খুব দরকার কারণ এই টেলিস্কোপ অবলোহিত বা ইনফ্রা-রেড রশ্মি পর্যবেক্ষণ করবে। এই টেলিস্কোপটি আসলে সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করবে,অধিকাংশ মহাকাশযান বা কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে যেমন হাবল , টেলিকম স্যাটেলাইট ইত্যাদি। পৃথিবী থেকে অধিক দূরে হওয়ার কারণে এটি একবার নষ্ট হলে আর ঠিক করা সম্ভব হবে না। নাসার বিজ্ঞানী রা তাই এটি তৈরি তে কোনো ত্রুটি রাখছেন না।এই টেলিস্কোপ টি প্রায় ১০ বছর কাজ করবে। এটি লঞ্চ করার ৬ মাস পর থেকে এটি কাজ করা শুরু করবে।
হাবল যেখানে মহাবিস্ফোরণের ৮০০ মিলিয়ন বছর পরের দৃশ্য দেখতে পারে, সেখানে ওয়েব দেখতে পাবে ২০০ মিলিয়ন বছর পরের দৃশ্য। ইনফ্রারেড রে ডিটেক্ট করে ওয়েব এক্সোপ্লেনেট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় সাহায্য করবে। এটি সেসব গ্যালাক্সি নিয়ে অধ্যয়ন করবে যা মহাবিস্ফোরণের পরে সৃষ্টি হয়েছিল। এটি পৃথিবীর মতো গ্রহের অনুসন্ধান করবে।
এছাড়া মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য,নক্ষত্র সৃষ্টির রহস্য নিয়ে হাবল যেমন অনেক তথ্য দিয়েছে, তেমনি জেমস ওয়েব এর থেকে বেশি সাহায্য করবে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ নিয়ে বিজ্ঞানী রা স্বপ্ন দেখছেন। হয়ত হাবলের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে এটি মহাকাশ গবেষণায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে।
তথ্যসূত্র এবং বিস্তারিত জানতে :
১. wikipedia
২. WebbTelescope.org