জিনোমের ভাষা

জীবের জীবন রহস্য লুকিয়ে আছে ডিএনএ-এর ভেতরে, জিনােমের পরতে পরতে।

জীবন রহস্যের সেই ভাষা উদঘাটনের লক্ষ্যেই বিজ্ঞানীরা একের পর এক উদ্ভিদ ও প্রাণীর জিনােম সিকোয়েন্স করে চলেছেন। এই যজ্ঞে শামিল হয়েছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরাও। পাট, ইলিশের পর সম্প্রতি উদঘাটিত হয়েছে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জীবন রহস্য কিন্তু বিজ্ঞানীরা কেন আদাজল খেয়ে জিনােম সিকোয়েন্সিং নিয়ে মেতেছেন?

আমাদের প্রত্যেকের জীবনের একটা গল্প আছে। জীববিজ্ঞানের ভাষায় সে গল্পটা মাত্র চারটি অক্ষরে লেখা। কিন্তু চার অক্ষরে লেখা গল্পটার আকার বিশাল। সহজে পড়াও যায় না। অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ও থায়ামিন—এই চারটি ক্ষারক জোড়ায় জোড়ায় থেকে তৈরি করে প্রতিটি ডিএনএ অণু। ডিএনএ অণুর সেটকে বলে জিনােম। এই জিনােমই নির্ধারণ করে—আমাদের চোখের বা চুলের রং কেমন হবে, আমরা খাটো হব না লম্বা হব, এমনকি ভবিষ্যতে আমাদের কোন জেনেটিক রােগ হবে কি না। যেহেতু জিনােমে এই তথ্য থাকে, তাই জীববিজ্ঞানীদের আপ্রাণ চেষ্টা থাকে জিনােমের লুকায়িত তথ্য উদ্ধার করার।

জিনােমিক তথ্য আসলে কী?

ডিএনএতে চারটি ক্ষারকের ক্রম সব জীবের জন্য নির্দিষ্ট। অ্যাডেনিনের পর গুয়ানিন আসবে, সাইটোসিন আসবে, থায়ামিন আসবে নাকি আবার অ্যাডেনিনই আসবে, সেই ক্রম বা সিকোয়েন্স বের করাই ছিল গত শতাব্দীর জীববিজ্ঞানীদের মূল লক্ষ্য। এরপর ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত মানুষের পূর্ণাঙ্গ জিনােম সিকোয়েন্স উন্মোচন হয় ২০০৩ সালে। মানুষের ডিএনএর সমস্ত তথ্য বের করেই মানুষ বসে নেই বরং সিকোয়েন্সিং হচ্ছে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গাছ বা প্রাণীর।

১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের দিকে ডিএনএ সিকোয়েন্স করতে ব্যবহার করা হতাে ম্যাক্সাম গিলবার্ট বা স্যাঙ্গার সিকোয়েন্সিং পদ্ধতি। পদ্ধতিটি ছিল অনেক জটিল, ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এ ছাড়া তখন আর কোনো উপায়ও জানা ছিল না। মানুষের জিনােম সিকোয়েন্স কিন্তু এই জটিল সংখ্যার সিকোয়েন্সিং টেকনিক ব্যবহার করে বের করা হয়েছে। প্রতিটি বিক্রিয়ার মাত্র ২৫০ থেকে ৫০০ ক্ষারক জোড় পর্যন্ত বের করার সক্ষমতা ছিল! এবার চিন্তা করুন, ৩ বিলিয়ন ক্ষারক জোড়ের ক্রম, জানতে কী পরিমাণ  পরিশ্রম, সময় আর অর্থের ব্যয় হয়েছে? এখন অবশ্য নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিংয়ের (এনজিএস) যুগ। সহজে এবং অল্প সময়ে অনেক বড়  অংশ সিকোয়েন্স করে ফেলা যায়। প্রকৃতপক্ষে গ্যাঙ্গার সিকোয়েন্সিংয়ের অনেকগুলাে বিক্রিয়া এনজিএসে সমান্তরালভাবে সংঘটিত হয়, তাই কম সময় লাগে।

জিনােম সিকোয়েন্সিংয়ে খরচও এখন বেশ কম। ২০০১ সালে মানুষের জিনােম সিকোয়েন্স করতে খরচ লাগত ১০০ মিলিয়ন ডলার, ২০১৫ সালে খরচ এসে ঠেকেছে মাত্র ১ হাজার ২৪৫ ডলারে। যত দিন যাবে খরচ অনেক কমবে। এখন অনেক ধরনের এনজিএস পদ্ধতি আছে। যেমন : ইলুমিনা, আয়ন টরেন্ট পিজিএস, ওয়ান মাইসেক, হাইসেক ২০০০ এমন আরও অনেক নাম। একেকটা একেক দৈর্ঘ্যের বা একেক ধরনের কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। আজকাল ট্রান্সক্রিপটোম লেভেল আরএমএ সিকোয়েন্সও হচ্ছে।

তবে যে পদ্ধতিই ব্যবহার করা হােক না কেন, কয়েক মিটার দৈর্ঘ্যের ডিএনএ বা আরএনএ একটানেই সিকোয়েন্স করে ফেলা সম্ভব নয়। অনেক ছােট ছােট দৈর্ঘ্য সিকোয়েন্স  করে কম্পিউটার সফটওয়্যারের সাহায্যে সেগুলােকে মিলিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ দৈর্ঘ্যের সিকোয়েন্স পাওয়া যায়। তাই সংবেদনশীল যন্ত্রের সঙ্গে এখন বায়ােইনফরমেটিকসের জ্ঞান থাকাও খুব জরুরি।

একবার কোন প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ জিনােম সিকোয়েন্স করে ফেললে আমাদের হাতে অনেক তথ্য চলে আসে। প্রজাতির অন্য সদস্যদের জন্য বারবার পূর্ণাঙ্গ সিকোয়েন্স করতে হয় না।

যেমন মানুষের কথাই ধরা যাক। একজন থেকে আরেকজনের জিনোম সিকোয়েন্স পার্থক্য মাত্র ০.১% এর মতাে। কিন্তু সামান্য এই ভিন্নতার কারণেই আমরা একেকজন অন্যজন থেকে কত আলাদা। আবার এই ০.১% এর মাঝেই লুকিয়ে থাকতে পারে কোন জেনেটিক রোগ। তা আপনার ঠিক কোন জিনের সমস্যার কারণে রােগটি হয়েছে, তা জানার জন্য পুরাে জিনােম সিকোয়েন্স করার প্রয়ােজন নেই। শুধু সম্ভাব্য ভিন্নতা আছে এমন টার্গেটেট অংশের সিকোয়েন্স করে ডেটাবেইসে থাকা কোনাে স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে মিলিয়ে নিলেই হবে। এতে খরচও অনেক কম হয় এমনকি আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মে জিনগত সমস্যাটি কেমন হতে পারে, সেটাও আঁচ করা সম্ভব।

নির্দিষ্ট জিনের ত্রুটি খুঁজে পেলে সহজেই সঠিক চিকিৎসা করা যায়। যে ওষুধ হয়তাে অন্যের কাজ করেছে, জিনগত সমস্যার কারণে আপনার ক্ষেত্রে কাজ না-ও করতে পারে। তখন সমস্যা বুঝে আপনার জন্য ওষুধ পরিবর্তন করে বা ডােজ বাড়িয়ে-কমিয়ে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন মানব জিনােম সিকোয়েন্সের কী ভূমিকা।

অনেকেই হয়ত জানেন, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে পাট, ইলিশ ও ছাগলের জিনােম সিকোয়েন্স করে ফেলেছেন। কিন্তু এদের জিনােম সিকোয়েন্স করে লাভ কি? প্রশ্নটি খুবই যুক্তিযুক্ত, অন্তত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে। জীবপ্রযুক্তির যে বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে এই পৃথিবীতে, তার এক ছোঁয়া আমাদের দেশেও লেগেছে। যার ফল সাফল্যের মত আমাদের দেশীয় সম্পদের পূর্ণাঙ্গ জিনােম সিকোয়েন্স। পাটের নতুন মিউটেটেড জাত খোঁজা হচ্ছে, যার আঁশ থেকে কাপড় বােনার মিহি সুতা পাওয়া যাবে। কাজটির জন্য প্রথমে পাৰে জিনে ইচ্ছাকৃত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। পরবর্তীতে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে কার আঁশ বেশি ভালাে। ভালো মানের আঁশ দিচ্ছে এমন পাটগুলাে আলাদা করে তার পূর্ণাঙ্গ জিনােম সিকোয়েন্সের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে যে ঠিক কোন জিনের জন্য আঁশ ভালাে হচ্ছে। এরপর কাচ্চি, কোনাে উচ্চফলনশীল পাটে ঢুকিয়ে দিলেই হল, এতে আমরা পেয়ে যাব আমাদের কাঙ্ক্ষিত ট্রান্সজেনিক লাইন। এভাবে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানাে সম্ভব আর উন্নত করা সম্ভব ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মাংসের মান বা উৎপাদন। তবে ব্যাপারটা যত সহজে বললাম কাজগুলাে বাস্তবায়ন করা ততটাই কঠিন।

এর জন্য প্রয়ােজন সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা, অর্থায়ন আর গবেষণামুখী শিক্ষাব্যবস্থা। | আশার কথা হল অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েও আমাদের দেশে বেশ কিছু ভালাে কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারগুলাে ধান, পাট বা মৎস্যসম্পদ নিয়ে জিনােম পর্যায়ে কাজ করছে। ফরেনসিক বিভাগেও কাজে লাগছে সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য। কয়েকটি দেশ তাদের সব মানুষের জিনােমের সিকোয়েন্স তথ্য নিয়ে বিশাল ডেটাবেইস তৈরি করার কথা পরিকল্পনা করছে। এতে অপরাধী শনাক্ত করা খুব সহজ হবে। তবে নিজের মােবাইলের তথ্যের নিরাপত্তার জন্য যেখানে আমরা জটিল প্যাটার্ন বা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করি, সেখানে নিজের জীবনের মূল্যবান তথ্য অন্যের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া কতখানি নিরাপদ, তা আসলেই ভাবার বিষয়। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে বা চলতেই থাকবে। তবে চার অক্ষরের জীবনের গল্প পড়তে পারা যে মানব ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায় হয়ে থাকবে—এ নিয়ে কোনাে দ্বিমত নেই।

One Comment

Comments are closed.