বিচিত্র আমাদের এই মহাকাশে ঘটছে নানা রকমের ঘটনা। কখনো তার সংবাদ আমাদের নাগালে আসে, কখনো তা আসে না। বিভিন্ন মহাজাগতিক ঘটনা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত ঘটনা আমাদের চারপাশে সারা বছরই ঘটে থাকে। কখনো হয় সুপারমুন, কখনো হয় ফুলমুন, কখনো বা হয়ে থাকে Meteor Shower. একবছরে জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত যত ঘটনা ঘটবে তার একটি বর্ষপঞ্জিকা পাওয়া যায়। তার মাধম্যে আমরা অনেকে জেনে থাকি সামনের ইভেন্টের ব্যাপারে। ঠিক এমনি একটি ইভেন্ট সামনে ঘটতে যাচ্ছে। কেউ কি অনুমান করতে পারছেন কোন জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে? আচ্ছা যাকগে আমি বলে দিচ্ছি। আগামি দুই-তিনদিন পর ঘটতে চলেছে Mercury Transit – 2019. অর্থাৎ এটি হচ্ছে আমাদের সূর্য্যিমামার সামনে দিয়ে গমন করবে। এই জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত ঘটনাটি অত্যন্ত বিরল আর এই কারণেই এই ঘটনাটি আমাদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এই ঘটনাটিকে আমরা প্রতিবছর ঘটতে দেখিনা। তাই এই ঘটনাটির স্বাক্ষী হতে পারাটাও খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে কোথায় ঘটবে এই ঘটনাটি? কিংবা আমরা কি পৃথিবী থেকে দেখতে পারবো কিনা? কতক্ষণ স্থায়ী হবে এই ইভেন্টটি? ধৈর্য ধরুন, এসকল প্রশ্নের উত্তর আমি আমার এই আর্টিকেলে আলোচনা করবো। আবার অনেকের মনে এই প্রশ্নেরও উদয় হতে পারে যে এই Transit টা কী আবার? তাহলে চলুন জেনে আসা যাক কী এই Transit.

কী এই Transit?

Transit শব্দটির সাথে আমরা বহুকাল আগে থেকেই পরিচিত কারণ আমরা যখন কেউ বিদেশ গমন করি তখন আমরা এই শব্দটি শুনে থাকি। আমরা যখন কেউ বিদেশ গমন করি তখনও কিন্তু আমাদের বিমান কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশে Transit করে থাকে। যেমন আমরা যদি আমেরিকার জন্য পাড়ি জমাই তবে সেটি কাতার কিংবা হংকঙে ট্রানজিট করে থাকে। কিন্তু সেই ট্রানজিট মানে কিন্তু আমাদের উড়োজাহাজের পরিবর্তন করা ছাড়া আর কিছুই না। আর আমরা যেই ট্রানজিট নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি সেটি হলো জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত ট্রানজিট। এই ট্রানজিটের মানে হলো যখন কোনো একটি celestial body সরাসরি কোনো একটি বৃহৎ বস্তু (গ্রহ, নক্ষত্র) এবং পর্যবেক্ষকের মাঝখানে দিয়ে গমন করে সেটিকে বুঝায়। যেমনঃ আমাদের শুক্র গ্রহ (Venus) পর্যায়কালীনভাবে আমাদের সূর্যকে ট্রানজিট করে। এই Transit ঘটনাটির কারণে কাছের বস্তুটিকে কোনো একটি দূরের বস্তুর চাইতেও ক্ষুদ্র দেখায়। তেমনিভাবে আমাদের এই বুধ গ্রহটির ট্রানজিটও ঘটবে আমাদের সূর্যের একদম সামনে দিয়ে যা দেখতে একদম কালো একটি বিন্দুর ন্যায় মনে হবে।
Mercury Transit এর বিবরণঃ

এই Mercury Transit টি আগে ২০১৬ সালে দেখা গিয়েছিলো এবং তারপরে এই ২০১৯ সালে আবারও তা ঘটতে চলেছে। তবে একটি দুঃখের সংবাদ হচ্ছে এটি আমাদের পৃথিবী থেকে আবার দেখা যাবে ২০৩২ সালে অর্থাৎ ১৩ বছর পরে। Mercury এবং Venus হলো এমন দুটি গ্রহ যারা সূর্যের সামনে দিয়ে গমন করে আর তা আমরা পৃথিবী থেকে দেখতে পাই। তাহলে আমাদের পাঠকের মনে একটি প্রশ্নের উদয় হতে পারে তাহলো আমরা বাকী গ্রহদের Transit কেনো দেখতে পাইনা? কেনো আমরা শুধু Mercury এবং Venus এর Transit ই কেবল দেখতে পাই? আর তার উত্তরে আমি বলবো, Mercury এবং Venus এর কক্ষপথ আমাদের সূর্য এবং পৃথিবীর কক্ষপথের মাঝখানে অবস্থিত। তাই এই দুটি গ্রহের Transit কেই কেবল আমরা পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণ করতে পারি। সূর্য থেকে বুধ গ্রহের (Mercury) গড় দুরত্ব হলো ৩৫৯৮৩০৯৫ মাইল বা ৫৭৯০৯১৭৫ কিলোমিটার যা আমাদের পৃথিবী এবং সূর্যের গড় দূরত্বের ৩০% কে কভার করে। যেহেতু কোনো গ্রহের ট্রানজিট খুবই দুর্লভ ঘটনা তাই আমরা হিসেব করলে দেখবো যে প্রতি ১০০ বছরে আমরা মাত্র ১৩ বার এই Mercury Transit কে আমরা দেখতে পাই। তাহলে একবার ভেবে দেখুন যে এই ট্রানজিট দেখতে পারাটা কতোটাই না ভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের এই নীল গ্রহের বাসিন্দারা কিন্তু প্রতিবছর এই Mercury Transit কে দেখতে পায়না। তাহলে এর পেছনে কারণ কী? এর পেছনে কারণটি হলো পৃথিবী এবং Mercury , প্রত্যেক গ্রহই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে ভিন্ন ভিন্ন সময় লাগে আর তাই বুধ গ্রহ (Mercury) এবং পৃথিবী কখনোই সেই দুটি পথে একই সময়ে মিলিত হয় না যেখানে তাদের কক্ষপথগুলো একে অপরের উপর পড়ে। আর এটিকে বলা হয় “Nodes.” আর Mercury Transit এর এই ঘটনাটি ঘটে থাকে প্রধান চারটি অংশে। টাইম-ল্যাপস ছবি বা ভিডিও এর মাধ্যমে দেখা যাবে যে সূর্যের উপর দিয়ে বুধ গ্রহটি একটি বক্ররেখা দিয়ে যাচ্ছে। আর পৃথিবীতে আপনার অবস্থান অনুযায়ী বুধ গ্রহটিকে দেখা যাবে।
কোথা থেকে দেখা যাবে এই Mercury Transit?

উপরের যে ম্যাপটিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটি জ্যোতির্বিদ Fred Espenak বানিয়েছেন এবং দেখাচ্ছেন যে ১১ই নভেম্বরের Mercury Transit টি কোথায় এবং কখন দেখা যাবে। Mercury Transit টি মূলত উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, (ইউরোপ, এশিয়া, অ্যান্টারটিকার কিছু অংশ) থেকে দেখা যাবে। এই ট্রানজিট টি ঘটতে সময় নিবে মোট ৫ঘন্টা, ২৮মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। NASA থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এই ট্রানজিট টি শুরু হবে ১১ই নভেম্বর EST সময় অনুযায়ী সকাল ৭টা ৩৫ থেকে ( ১২৩৫ GMT) এবং শেষ হবে EST সময় অনুযায়ী দুপুর ১টা ৪মিনিটে (১৮০৪ GMT)। তবে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে আমাদের বাংলাদেশ থেকে হয়তো এই ট্রানজিট টি দেখা সম্ভব হবে না। পৃথিবীতে আপনার অবস্থান অনুযায়ী বুধ গ্রহটিকে দেখা যাবে। আপনি যদি আমেরিকার নিউইয়র্ক শহর থেকে দেখেন তবে আপনি বুধ গ্রহটিকে সূর্যের একদম নীচ থেকে বাম দিকে দেখতে পাবেন। আবার আপনি যদি চিলির সান্তিয়াগো শহর থেকে দেখার চেষ্টা করেন তবে দেখবেন বুধ গ্রহটি ডানদিকে দেখা যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে তা সূর্যের মধ্যভাগে চলে আসবে এবং এভাবে গ্রহটির চলন বক্ররেখাটি নীচের দিকে চলে যাবে।
এই ট্রানজিট টি দেখতে কি কি যন্ত্র প্রয়োজন?

দুর্লভ এই Mercury Transit টি দেখতে হলে দরকার কিছু আকাশ পর্যবেক্ষণ করার যন্ত্রপাতি যেমন টেলিস্কোপ অথবা প্রতিরক্ষামূলক সৌর ফিল্টার লাগানো দূরবীন। এসব ট্রানজিট, গ্রহণ দেখতে হলে এসব যন্ত্র ব্যবাহার করা উচিত। তা নাহলে অনেক সময় তা আমাদের নেত্র দুটির জন্য ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায়। এই যন্ত্রগুলো ছাড়া যদি কেউ সরাসরি সূর্যের দিকে তাকায় তাহলে তার সারাজীবনের জন্য অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই Transit এর সময় বুধ গ্রহটি যখন সূর্যের সামনে দিয়ে অতিক্রম করবে তখন গ্রহটি দেখতে মনে হবে ঠিক আমাদের মুখে হওয়া ব্রণের মতো।
ঠিক এইভাবে প্রতিনিয়তই ঘটে থাকে অসংখ্য জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত মনোমুগ্ধকর ঘটনা যার অধিকাংশই আমাদের কান ঘেঁষে চলে যায়। ঠিকমতো কোনো খোঁজ না রাখার ফলে আমরা তার টেরও পাইনা। জ্যোতির্বিজ্ঞানকে যারা ভালোবাসে তাঁরা কখনোই এইসকল ইভেন্ট গুলো একদমই মিস হতে দেয় না। কারণ সারা বছরে যে যে ঘটনা গুলো ঘটে সেটার বর্ষপঞ্জিকা তাঁরা আগে ভাগেই জোগাড় করে নেয়। তাই আমি সবাইকে জোর গলায় আহ্বান করছি যে আজই ২০২০ সালের “Astronomical Calender – 2020” টি সংগ্রহ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে ভালোবেসে প্রতিটি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করুন এবং অন্যদেরকেও অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করুন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভালোবেসে ছড়িয়ে দিন প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে। আমরা আশা করছি একদিন আমাদের এই দেশে আমাদের নিজস্ব মানমন্দির থাকবে যার সাহায্যে আমরা দেশে বসেই গবেষণা করতে পারবো। একদিন আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে হবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা, এই দেশ থেকে বের হবে অসংখ্য মেধাবী জ্যোতির্বিদ। চারদিকে হবে শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের জয়গান।
Source : NASA, Space.com, National Geographic