ষ্টিভ জবস আমাদের মাঝে অনেক দিন বেঁচে থাকবেন। মানুষ আরো কয়েক প্রজন্ম ধরে ষ্টিভ জবসের মতো কারো জন্য অপেক্ষা করবে। তিনি একবার বলেছিলেন, আমি জীবনে যে দুই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস করেছি তার একটি হল এলএসডি (LSD – lysergic acid diethylamide) ড্রাগটি নেয়া।
বিশ্বের প্রায় বেশিরভাগ দেশেই এলএসডি অবৈধ। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই শুনে থাকি। তবে অনেকেই আবার বিশ্বাস করেন যে এলএসডি সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এমন লোকের সংখ্যা অবশ্য নেহায়েত কম নয়। এর মধ্যে রয়েছে অনেক নামীদামী তারকা-শিল্পী-আবিষ্কারক।
এলএসডির আবিষ্কার
গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান কাজ শুরু করেন এরগট নামক এক ধরণের প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস নিয়ে। ওষুধ হিসেবে এদের কার্যকারিতা কেমন তা জানার জন্য এদের বৈশিষ্ট্য ও স্থায়িত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। মূলত: তিনি কম রক্তচাপ, মস্তিষ্কের কার্যকারিতার উন্নতি শ্বাসপ্রশ্বাস প্রাণিত করার ওষুধ তৈরির জন্য lysergic acid নিয়ে কাজ করছিলেন হফম্যান। তখন হঠাৎ করেই নিজের অজান্তে LSD নামক আধুনিককালের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়াবহ ড্রাগের প্রভাব আবিষ্কার করে ফেললেন হফম্যান, যার পুরো নাম লিসার্জিক এসিড ডাইথ্যালামাইড। সময়টা তখন ১৯৩৮।
তবে আবিষ্কারের পর এটি বিজ্ঞানী এবং ফিজিশিয়ানদের কাছে কোন গুরুত্ব পায়নি। ৫ বছর পর, হফম্যান আবার এলএসডি-২৫ নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। ২৫ মাইক্রোগ্রাম নিজের জিভে স্পর্শ করালেন। এরপর তিনি চলে গেলেন বিস্ময়কর এক জগতে- অভূতপূর্ব সব ছবি, বৈচিত্র্য দর্শন বর্ণচ্ছটার অবিরল স্রোত খেলা করতে লাগলো তার সামনে। রাস্তায় ধাবমান ট্রাফিকের মত ছোটাছুটি করছে চিন্তা-ভাবনা, স্মৃতি-বিস্মৃতি- যেন কাল্পনিক সিনেমার পর্দা। পরদিন নিলেন ২৫০ মাইক্রোগ্রাম এর প্রায় দশগুণ বেশি। একই রেজাল্ট পেলেন। ভয় পেয়ে প্রথমে ডাক্তার ডেকেছিলেন। ডাক্তার দেখলেন তার ব্লাডপ্রেশার, হার্টরেট, শ্বাসপ্রশ্বাস সবই ঠিক চলছে। সহকর্মীরা সকলেই স্বাদহীন, বর্ণহীন, রংহীন সেই সাইকেডেলিক ড্রাগ টেস্ট করে এক মত হলেন যে, এটি এমন এক নতুন জিনিস যা চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করে অন্য বিজন মুক্ত দুনিয়ার খোঁজ দেয়।
এলএসডির ডোজ
এলএসডি-এর প্রতিটি ডোজ ৪০ ও ৫০০ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে হতে পারে- যা প্রায় এক দশমাংশ বালুকণা ভরের সমান। বিভ্রম তৈরীর জন্য অন্যান্য ড্রাগের যেখানে কয়েকশ’ গ্রাম পর্যন্ত গ্রহণ করতে হয় সেখানে এলএসডি প্রয়োজন হয় সর্বোচ্চ ১৫০ মাইক্রোগ্রামের মতো। এমনকি ২৫ মাইক্রোগ্রাম এলএসডি একটি প্রান্তিক মানের প্রভাব উঃপাদন করতে পারে। এলএসডি ডোজ সাধারণত মাইক্রোগ্রামে (µg) বা এক গ্রামের এক মিলিয়ন ভাগে পরিমাপ করা হয়।
এলএসডি নিয়ে গবেষণা
এলএসডিকে অবৈধ ঘোষণা করার ফলে বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতি বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তবে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থা বেকলি ফাউন্ডেশন সম্প্রতি এলএসডির উপর গবেষণা করেছে।
এই গবেষণার প্রধান গবেষক ডেভিড নাট এই গবেষণাকে পার্টিক্যাল ফিজিক্সে হিগস বোসনের আবিষ্কারের সমতুল্য বলে আখ্যা দিয়েছেন।
শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ২০ জন স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু হয়। আলাদা আলাদা দুইদিন তাদের ওপর ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ও ট্যাবলেট আকারে ৭৫ মাইক্রোগ্রাম এলএসডি প্রয়োগ করা হয়।
এরপর মস্তিষ্কের ছবি তোলার নানা ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ ও মস্তিষ্কের ভেতরে রক্তের চলাচল মাপা হয়। মাদক গ্রহণ করা ও না করা অবস্থায় একই স্বেচ্ছাসেবকের মস্তিষ্কের ছবি তুলে পার্থক্য বের করা হয়।
সাধারণত এলএসডি নেওয়ার পর একজন মানুষ চোখ বন্ধ করেও দেখতে পায়। তার দেখা এইসব দৃশ্য সবসময় বাইরের পৃথিবী বা স্মৃতি থেকে আসে না বরং তাদের কল্পনাশক্তি অনেক বেড়ে যায়।
গবেষণা থেকে জানা যায় এলএসডি নেওয়া একটি মস্তিষ্ককে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি সমন্বিত একটি মস্তিষ্ক। কিন্তু একই সঙ্গে এলএসডির প্রভাবে মস্তিষ্কের অন্যান্য যোগাযোগ ব্যাবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।
বিজ্ঞানীরা জানান, এলএসডি ব্যবহারকারীরা যে হ্যালুসিনেশন দেখেন সে সম্পর্কিত তথ্য মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ থেকে আসে। সে সব তথ্য সবসময় মস্তিষ্কের পেছন দিকে অবস্থিত ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স থেকে আসে না অর্থাৎ মানুষের দৃশ্যমান স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে না। এই মাদকের প্রভাবে মস্তিষ্কের কাজ করার ভিন্ন ভিন্ন অংশ মিলেমিশে যায়।
ছবি থেকে আরও জানা গেছে, একই সঙ্গে এলএসডির কারণে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে ও পৃথকভাবে কাজ করতে থাকে। ফলে ব্যবহারকারী পৃথিবীর সঙ্গে নিজের একক এক সম্পর্ক অনুভব করেন যাকে বলা হয় ‘ইগো ডিসোল্যুশন’।
এলএসডিকে সবাই আমরা ভয়ানক এক ড্রাগস হিসেবেই চিনে থাকি। কি জানি ভবিষ্যতে হয়ত এই ভয়াবহ ড্রাগই চিকিৎসা বিজ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানের অন্য কোথাও নতুন দ্বার খুলে দিবে।
রেফারেন্সঃ