পৃথিবীতে মানুষের বসবাসের হার যত বাড়ছে ঠিক তেমনি হারে বাড়ছে প্রাণী বিলুপ্তির হার। বর্তমান হিসেবে পৃথিবী থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৫০ টি প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এসব প্রাণীর বিলুপ্তির জন্য দায়ী পুরো জাতি। তবে জীনবিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন বিলুপ্ত ও বিলুপ্ত প্রায় সকল প্রাণীকে ফিরিয়ে আনার।
অনেক প্রাণীই হারিয়ে গেছে পৃথিবীর সভ্যতার উত্তরণের মাধ্যমে। এদের মধ্যে কিছু প্রাণীকে আমরা অনেক সময় বিভিন্ন অ্যানিমেটেড মুভিতে দেখতে পাই। আজ আমরা এমনই এক প্রাণী ম্যামথ নিয়ে আলোচনা করবো।
“Ice Age” এনিমেটেড সিনেমা যারা দেখেছেন তাদের নিশ্চয়ই ম্যামথের সাথে আর পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। বিশাল দেহী, ছোট কান (হাতির তুলনায়), বিশাল দাঁত, লোমে ভরা দেহ আর বিশাল বড় শুঁড়। আকৃতিতে হাতির মত হলেও আকার কিন্তু হাতির তুলনায় অনেক বড়। প্রাগঐতিহাসিক সময়কার এই প্রাণী। বিলুপ্ত ঘটেছে প্রায় ৫ মিলিয়ন বছর আগে। মানে ডাইনোসর এর সময়কার প্রানী এটি। তখন বিশাল দেহী প্রানীর রাজত্ত্ব ছিল এই পৃথিবীতে।
”ম্যামথ” হচ্ছে বিলুপ্ত ম্যামুথুস, গণের যে কোনো প্রজাতি, সাধারণভাবে লম্বা, বাঁকানো শুঁড়বিশিষ্ট, এবং উত্তর গোলার্ধের প্রজাতিগুলো লম্বা চুলবিশিষ্ট। তারা প্লায়োসিন যুগ থেকে হলোসিন যুগের মাঝামাঝি কালে বাস করত যা প্রায় ৫ মিলিয়ন থেকে ৪,৫০০ বছর পূর্বে। এরা আধুনিক হাতির খুব ঘনিষ্ঠ পূর্বসূরী। এই প্রাণীটিকে হাতির আদিরূপ মনে করা হয়।
বিস্তার
এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকায় পাওয়া যেত।
আকার
এটি আকারে হাতির চেয়ে বড় ছিল। এর দাঁত ছিল বিশাল।
নিচের ক্ল্যাডোগ্রামটি ম্যামুথুস গণের অবস্থান দেখাচ্ছে:
Mammut (Mastodon)
Gomphotherium
Stegodon
Loxodonta (African elephant)
Elephas (Asian elephant)
Mammuthus (Mammoth)
ম্যামথের বিলুপ্ত হওয়ার কারণ
বহু বছর আগে উত্তর সাইবেরিয়ার অঞ্চলটিতে বসবাস করত বিলুপ্ত ম্যামথ। আর তাদের এই বিলুপ্ত হবার পিছে মূল কারন ছিল তাপমাত্রা বৃদ্ধি। যার ফলে এলাকাটি ধীরে ধীরে ম্যামথের জন্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়। আর যেহেতু এটি একটা দ্বীপের মত, তাই সহজে স্থান পরিবর্তন করাও সম্ভব ছিল না। আর তাই এই স্থানটি হয়ে ওঠে ম্যামথদের জন্য নরকের সমান গরম। আর এই কারনেই প্রায় ৩,৭০০ বছর আগে এই দ্বীপ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায় ম্যামথ।
ম্যামথের দাঁত
ম্যামথ বিলুপ্ত হলেও তাদের দেহ অবশেষ বিশেষ করে তাদের দাঁত কিন্তু এখনও এই সাইবেরিয়ার বেশ বিপুল সংখ্যায় খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের ধারনা রাশিয়ার এই অঞ্চলে হাজার হাজার টন পরিমানে এই দাঁত রয়েছে। বর্তমানে বছরে ২০ থেকে ৬০ টন দাঁত উদ্ধার করা হয় মাটির নিচ থেকে। এই নম্বর থেকে নিশ্চই বুঝতে পারছেন এই অঞ্চলে কি বিপুল পরিমানে ম্যামথের বসবাস ছিল।
বর্তমান সময়ে সাইবেরিয়া থেকে এই সকল দাঁত উত্তোলন করা সম্পূর্ন ভাবে নিষিদ্ধ। বর্তমানে কালো বাজারে যে দাঁত গুলি পাওয়া যায় তার ৯০% জোগান দাতা হল চীন। তাদের প্রাচীন সভ্যতার একটি অংশ হল বড় বড় দাঁতের উপর বিভিন্ন জিনিষের খোঁদাই করা শিল্প আর এই কারনেই তারা সরকারি বাধা উপেক্ষা করেও এখনও এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বিশেষজ্ঞদের ভয় হল, এভাবে যদি দাঁত উত্তোলন চলতে থাকে তাহলে এই দাঁত গুলি থেকে তারা যে তথ্য সংগ্রহ করে তা আর সম্ভব হবে না। বিশেষ করে বিশ্বের তাপমাত্রা পরিবর্তন সহ তৎকালীন প্রাণীগুলির খাদ্য অভ্যাস সম্পর্কে তারা আর নতুন তথ্য আবিস্কার করতে পারবে না।
অক্ষত ম্যামথের দেহ
২০১০ সালে, রাশিয়ার সাইবেরিয়ার উত্তর পশ্চিম দিকের শহর “ইয়ামাল পেনিনসুলা” (Yamal Peninsula), আর এই শহরেই খুঁজে পাওয়া গেছে প্রায় অক্ষত এক ম্যামথের বাচ্চার দেহ। রাশিয়া শীত প্রধান দেশ হওয়ার কারণেই হয়ত অক্ষত রয়ে গেছে এই ৩৯০০০ বছর পুরাতন ম্যামথের বাচ্চার দেহ। এটি এ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সব থেকে অক্ষত ম্যামথ দেহ।
এই ম্যামথ বাচ্চাটির বয়স ছিল ১০ বছর যখন সে মারা যায়, আর প্রকাণ্ড ঠাণ্ডার কারণে তা প্রায় অক্ষত অবস্থায় বরফের মধ্যে সমাধিত হয়ে থাকে। এটি এতটাই অক্ষত ছিল যে এর লিংগ কি তা বুঝতে কোন পরীক্ষা করা লাগে নি। শুধু মাত্র দেখেই বলা যায় যে এটির লিঙ্গ কি? কি খুব জানতে ইচ্ছা করছে এই ম্যামথ পুরুষ না স্ত্রী। এটি স্ত্রী ম্যামথ। আর এর ওজন ১১০ পাউন্ড। আকার আকৃতিতে একটা বড় কুকুরের সমান।
সম্প্রতি একটা প্রত্নতাত্ত্বিক এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার দুনিয়া জুড়ে মিডিয়াতে বেশ গুরুত্ব নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। ১০,০০০ বছরের পুরানো এক উলি ম্যামথের দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে লায়াখোভস্কি নামক এক সাইবেরিয়ার দ্বীপে। ইয়াকুটস্ক এর নর্থইস্ট ফেডারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিষ্কারক দলটি দাবি করছেন এই ফসিল থেকে তরল রক্ত পাওয়া গিয়েছে! কোন ফসিল থেকে তরল রক্ত পাওয়ার প্রথম দাবি এইটি ! প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বরফে জমে থাকার কাড়নে এইরকম রক্তের মধ্যে জীবিত কোষ পাওয়া যেতে পারে বলেও দাবি করছেন তারা। বলছেন, যখন তারা ফসিলটি খোঁচাখুঁচি করছিলেন তখন সেখান থেকে তরল রক্ত গড়িয়ে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যামথ জাদুঘরের প্রধান সেমন গ্রিগোরিভ লিখেছেন, “ম্যামথের শরীর থেকে যেই পেশী পেয়েছি তার রঙ ছিল প্রাকৃতিক ভাবেই লাল। আমরা এমন একটি আবিষ্কার করতে পেরেছি কারণ ম্যামথটির নিচের অংশ পুরোটাই কঠিন বরফের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল এতকাল ধরে।”
সম্প্রতি বোস্টনে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স (এএএএস) এর আলোচনায় উঠে এসেছে আরও এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ম্যামথ ও হাতির হাইব্রিড এই প্রাণীর জন্ম দিতে জিন এডিটিং টেকনোলজির দ্বারস্থ হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিশেষজ্ঞ দলের দাবি, বিলুপ্ত প্রাগৈতিহাসিক এই প্রাণীকে ফিরিয়ে আনার কাজও প্রায় শেষ। এই মুহূর্তে গবেষণাগারে হাইব্রিড ভ্রূণ তৈরির কাজও চলছে। বিজ্ঞানীদের আশা, আগামী ২ বছরের মধ্যেই ফের জন্ম নেবে তুষার যুগে হারিয়ে যাওয়া এই প্রাণী।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত ম্যামথরা। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায় এই প্রজাতি। সাইবেরিয়ায় বরফের মধ্যে থেকে পাওয়া গিয়েছিল ম্যামথের ‘ফ্রোজেন’ ডিএনএ-র নমুনা। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া সেই প্রাণীর জন্ম দিতে সেই ডিএনএ-র নমুনাই ব্যবহার করা হচ্ছে। সাহায্য নেওয়া হচ্ছে জিন এডিটিং প্রক্রিয়ারও।
পৃথিবীর অন্যতম সেরা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ম্যামথের জিনের মধ্যে ক্লাস্টার্ড রেগুলারলি ইন্টারস্পেসড শর্ট প্যালিন্ড্রমিক রিপিটস (ক্রিসপার/ক্যাস৯) নামক জিনটিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। পরিবর্তিত এই জিন নতুন কোষ তৈরি করতে পারবে। এই নতুন কোষ ম্যামথের মতো লোমশ ও চর্বিযুক্ত ত্বক, প্রবল ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতাযুক্ত রক্ত, শরীরের তুলনায় ছোট কান এবং অন্যান্য শারীরিক বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে পারবে।
প্রকৃতিকে বাঁচাতেই এমন যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন তাঁরা। গবেষক দলের দাবি, তুন্দ্রা অঞ্চলের পরিবেশকে রক্ষা করবে এই প্রাণী। গ্রিন হাউজ গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাবও কমাবে। সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, সাইবেরিয়া অঞ্চলের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত কমাতে পারবে পৃথিবীর নতুন এই সদস্য।