এর আগের পর্বে আমরা জেনেছিলাম মায়ানদের ভৌগলিক অবস্থান, মায়া সভ্যতার যুগসমূহ,কোডেক্স,মায়ানদের পোশাক,খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে। আরও জেনেছিলাম তাদের তৈরি বর্ষপঞ্জিকা সম্পর্কে। সেই সাথে জেনেছি মায়ানদের নিয়ে কিছু অদ্ভুত তবে মজার তথ্য।
চলুন তাহলে আজকে জেনে নেওয়া যাক মায়ানদের ধর্ম বিশ্বাস, দেবতাদের পরিচিতি, নরবলি ও পিরামিড সম্পর্কে । আরও জানবো কিভাবে এই সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যায় ! যদিও মেসো আমেরিকায় এখনো মায়ানদের কিছু অংশ রয়েছে যারা তাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি বহন করে আসছে।
মায়ানদের ধর্ম বিশ্বাস :
মায়ানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার দিক দিয়ে যতটা উন্নত ছিল ঠিক ততটাই নিষ্ঠুর ও হিংস্র ছিল। এদের ধর্ম বিশ্বাস ছিলো অত্যন্ত প্রবল। এতোটাই প্রবল ছিলো যে তাদেরকে ধর্মান্ধও বলা চলে। তারা বহু দেবতায় বিশ্বস্ত ছিল। চন্দ্র,সূর্য,বৃষ্টি,শস্য ইত্যাদি সবই ছিল তাদের উপাসনার অংশ।
মায়া সাম্রাজ্যর প্রধান অর্থাৎ রাজা বা “কুহুল আযা” পারিবারিক ভাবে নির্বাচন করা হতো। তারা দেবতা ও পৃথিবীর মানুষদের মধ্যে মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। ধর্ম পালন করতে গিয়ে সভ্যতার কোন এক সময় তারা হিংস্র জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন। ধর্মীয় উৎসব গুলোতে ঈশ্বরকে রক্ত উৎসর্গ করার মাধ্যমে পালন করতেন। তারা মনে করতেন রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করে তার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠা যায়। বিশেষ ধর্মীয় উৎসবগুলোয় রাজা স্বয়ং রক্তদান করতেন। এসব উৎসবগুলো খুবই গোপনে পালন করা হতো।
তাদের মতে পৃথিবী চতুর্ভুজ আকৃতির ও সমতল ধরনের। আর এই চতুর্ভুজের চার কোণাকে চারজন শক্তিশালী “বাকাব” দেবতা ধরে রেখেছেন। চারটি কোণা লাল,কালো,সাদা, হলুদ এবং কেন্দ্র সবুজ রঙের।
তাদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী স্বর্গ ১৩স্তর বিশিষ্ট আর নরক ৯স্তর বিশিষ্ট।
মায়ান দেবতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেবতারা হলেন চিয়াক,আহপুছ, কিনিস আহাউ,বি,এল। মৃত্যুর দেবতা “আহপুছ”, দেবতা “বি” জন্ম-মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করেন।দেবতা “চিয়াক” হচ্ছেন উর্বরতার দেবতা, সূর্য দেবতা “কিনিস আহাউ” এবং “এল” হচ্ছেন নরকের দেবতা। তবে প্রধান দুই অমর দেবতা হলে ইতজামনা বা ইটজামনা ও কুকুলকান।
ইতজামনা :
মায়ান শব্দ ইতজামনা বা ইটজামনা শব্দের অর্থ “টিকটিকির বাড়ি”।তাদের মতে স্বর্গের দেবতা ইতজামনা মহাবিশ্বের স্রষ্টা এবং সৃষ্টির দেবতা।
কুকুলকান :
কুকুলকান শব্দের অর্থ পালক দ্বারা আবৃত সাপ। শক্তিশালী দেবতা কুকুলকানের সাথে সনাতন ধর্মের দেবী মনসার মিল রয়েছে। মায়ান জাতির রাষ্ট্রধর্ম ছিল এই দেবতার উপাসনা করা। কথিত আছে দেবতা কুকুলকানের বাবা সাপদের রাজা। কুকুলকানের দৈহিক আকৃতি সম্পর্কে বলা থাকে ডানাওয়ালা সরীসৃপ।দেবতা কুকুলকানের উপাসনা করার জন্য নবম দশম শতকের মাঝামাঝিতে মায়ানরা তৈরি করেছিল ১০০ ফুট উচ্চতার একটি পিরামিডসদৃশ উপাসনালয়। চারদিকে ৯১টি করে সিঁড়ির ধাপ, আর একেবারে ওপরে উঠার জন্যে একটি ধাপ। সর্বমোট ৩৬৫টি ধাপ নিয়ে তৈরি হয়েছিলো এই উপাসনালয়টি।
নরবলি :
এই উন্নত জাতি মূলত ঈশ্বরের তুষ্টি লাভের জন্য মানুষকে নরবলি দিতেন। আর এই নরবলি সম্পূর্ণ হতো অনেকটা অ্যাজটেক রীতি অনুসারে। নরবলির জন্য যেই ব্যক্তিকে নির্বাচন করা হতো তার বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বের করে দেবতাদের উদ্দেশ্য উৎসর্গ করা হতো। তারা বিশ্বাস করতেন পৃথিবীতে যেহেতু পাপীর সংখ্যা বেশি সেহেতু যাদেরকে বলি দেওয়া হয় শুধুমাত্র তারাই স্বর্গে যাবে।
মায়ানদের অন্যতম সৃষ্টি পিরামিড :
একবিংশ শতাব্দীতে সবকিছুতে বিজ্ঞানের ছোঁয়া থাকার পরও অধিকাংশ মানুষই বিজ্ঞানচর্চা থেকে বিমুখ। এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে শিক্ষার আলো আলাদীনের জাদুর চেরাগের মতো। কিন্তু সেখানে আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগেই এই জাতি নিজেদের অজান্তেই বিজ্ঞানচর্চা শুরু করছিলো। তাদের তৈরি স্থাপত্য,পিরামিড,ক্যালেন্ডার,কোডেক্স ইত্যাদিই তার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। ব্যাপারটা রহস্যময় না ?রহস্যময় তো বটেই!
মায়ানদেরকে কেউ কেউ “গ্রেট আর্টিস্ট” হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। দেবতা কুকুলকানের জন্য তৈরি উপাসনালয় তথা পিরামিডটির কিছু বিস্ময়কর বিশেষত্ব ছিল। পিরামিডটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে বিষুবরেখা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার সময় সূর্যের আলো পিরামিডের উপর এমন ভাবে পড়ে যাতে পিরামিডের ছায়া দেখে মনে হয় এর গা বেয়ে ডানাওয়ালা সরীসৃপ মাটিতে নেমে আসছে। শুধুমাত্র সাম্রাজ্যের রাজার জন্মদিনের দিন সাধারণ প্রজারা পিরামিডে উঠার অনুমতি পেতো।
একটি গবেষণায় গবেষক এসত্রাদা-বেল্লি আবিষ্কার করেন, একটি পিরামিডের ভেতর ২৬ ফুট দৈর্ঘ্যর একটি ছাদ যা “স্নেক” রাজবংশের নিদর্শন। ছাদটির কেন্দ্রীয় ছবিটি ছিল হলমুল রাজার। ধারণা করা হয়,রাজা সম্ভবত ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
স্থাপত্য :
মায়ানরা একটি মন্দিরকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বড় গ্রাম গড়ে তুলত। বড় গ্রামগুলোর ঠিক মাঝখানে বড় শহর নির্মাণ করা হতো। মায়াসভ্যতা ছিলো মূলত নগর রাষ্ট্র। এই নগর রাষ্ট্র চলত প্রজাদের খাজনায়। মায়ান রীতি অনুযায়ী, নগরাষ্ট্র গুলোর একেবারে মাঝখানে সূর্য মন্দির বানানো হতো। মায়া সভ্যতার উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যগুলো হলো চিচেন ইটজা, নর্থ আ্যাক্রপলিস, টিকাল, গুয়াতেমালা এবং বলকোর্ট আ্যাট টিকাল, এল মিরাডর। টাইকাল, কোপায়েন, টেওটিহুয়াকান এবং চিচেন ইটজায় সূর্য মন্দিরের অসাধারণ নমুনা দেখা যায়। সূর্য মন্দিরগুলো ছিল অনেকটা পিরামিড আকৃতির। “চিচেন ইতজা” যাকে আবার “নরবলির শহর” নামেও অভিহিত করা হয় মূলত সেই শহরটি ছিল মায়া সভ্যতার অন্যতম এক শহর। এই শহরের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো হলো পিরামিড, মঠ, টেম্পল অব দি ওয়ারিয়র্স, কারাকোল বা গোল স্তম্ভ ইত্যাদি। শহরটি দুটো কুয়ার মধ্যবর্তী স্থানে গড়ে উঠে।
মায়া সভ্যতা ধ্বংসের কারণ :
বহুবছর পর্যন্ত মায়া সভ্যতা ধ্বংসের কারণ নিয়ে অনেক মতবিরোধ ছিল। গবেষকদের মতে,৯ম শতকের দিকে ভয়াবহ এমন কিছু ঘটেছিল যা এই বিকশিত সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। খরার সময় যেসব জায়গায় পানি জমিয়ে রাখা হতো দীর্ঘকালীন খরার কারণে সেসব জায়গা দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিণতিতে নিঃশেষ হয়ে যায় মায়ান সাম্রাজ্য। সম্প্রতি ভিয়েনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মডেল হিসাব নিকাশ থেকে দেখা গেছে, যে কৃষি প্রযুক্তি খরার সময় মায়া সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হয়েছিল সে কৃষি প্রযুক্তিই প্রধান কোনো বিপর্যয়ের সময় তাদের সভ্যতাকে ধ্বংসে দিকে ঠেলে দিয়েছে। তৎকালীন ইউকাতান নির্মিত ভবনগুলোকে আর পুনরায় নির্মাণ করা সম্ভব হয় নি।
সম্প্রতি মেক্সিকোর প্রত্নতাত্ত্বিকবিদরা এমন একটু গুহা আবিষ্কার করেছেন যা থেকে মায়ানদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র সম্পর্কে আরো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় । প্রায় এক হাজার বছর ধরে পরিত্যক্ত এই বদ্ধ গুহাটি বালামকু বা জাগুয়ার ঈশ্বরের নামে পরিচালিত। এতে প্রায় ১৫০ ধরনের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এগুলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০টি ধূপ বার্নার, পানির দেবতার বাহন, নকশাকৃত ফুলদানির মতো পাত্র, প্লেট ইত্যাদি। এই দ্রব্যাদি মূলত সিরামিকের তৈরি।