ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ,ম্যালেরিয়া এ নামগুলো শুনলেই আমাদের মাঝে একটা আতংকের সৃষ্টি হয়। আমরা ভাবতে শুরু করি আমাদের পরিবার কি সুরক্ষিত থাকবে এর থেকে?
এর থেকে সুরক্ষিত থাকতে আমরা কি করতে পারি ? আমাদের বাড়িতে কোন বিষয়গুলো খুব ভালভাবে মানা প্রয়োজন?
বাড়িতে এই মশাবাহিত রোগগুলো থেকে বাঁচার জন্য কি করা প্রয়োজন যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তবে অধিকাংশ মানুষ যে উত্তর দিবে তা কিছুটা এমনঃ মশারীর ভিতরে থাকতে হবে, কিন্তু বাচ্চাদের জন্য? তারাতো সারা দিন মশারীর নিচে থাকবে না। তাহলে বিকল্প উপায়? ফুল হাতা জামা বা ফুল প্যান্ট পরতে হবে, নানা ধরনের মশা নিধনের স্প্রে ব্যবহার করতে হবে।
সর্বোপরি যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি শুনবেন তা হল মশার কয়েল ব্যবহার করা।
কারন এটা আপাত দৃষ্টিতে সবচেয়ে উপকারী এবং দামেও সবচেয়ে সাশ্রয়ী হবার জন্য শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়। বিশেষ করে ট্রপিক্যাল অঞ্চলগুলোতে।
মশার কয়েল যা কিনা মানুষের জন্য এত উপকারী ঠিক এর বিপরীত চিত্র অর্থাৎ এর অপকারীতার প্রশ্নও কিন্তু মানুষের মধ্যে প্রবল।
তাহলে আসলেও কি মশার কয়েলের ধোঁয়া মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর? মশার কয়েলের ধোঁয়া কি আসলেও ১৩৬ টা সিগেরেটের ধোঁয়া গ্রহণ করার সমান?
মশার কয়েল সৃষ্টির ইতিহাসঃ
বর্তমানে নানা মোড়কে নানা ধরণের মশার কয়েল পাওয়া গেলেও এর আবিষ্কার কিন্তু হয়েছিল ১৯ শতকে জাপানে।
এক ফুল ব্যাবসায়ী ইশীরো উয়েমা (Eiichiro Ueyama), যিনি আমেরিকা থেকে জাপানে ফুলের বীজ আমদানি করতেন। ঠিক তেমনি ভাবে তার সাথে পরিচয় হল আর এক ব্যাবসায়ীর সাথে। যিনি তাকে একটা ফুলের সাথে পরিচয় করালেন। যার বর্তমান বৈজ্ঞানিক নাম হল Tanacetum cinerariifolium, যা chrysanthemum পরিবারের সদস্য।
এ ফুলগুলো দেখতে দারুন সুন্দর হলেও তিনি জাপানি ব্যবসায়ীকে এই বলে সতর্ক করেছিলেন যে, এ গাছে এমন কোন উপাদান আছে যা পোকামাকড়ের জন্য ধ্বংসাত্মক।
Eiichiro তার কথা শোনার পর সে ফুলগুলোকে শুকিয়ে গুড়ো করে পাউডার বানালেন তখন সেখানে প্রাকৃতিক ভাবেই একধরনের কীটনাশক তৈরি হয় যা pyrethrum নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
এরপর তিনি তা কাঠের গুড়ো বা স্টার্চ জাতীয় পর্দাথের সাথে মিশিয়ে কাঠি আকৃতির মশা নিধনের একধরনের পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। আর এখান থেকেই শুরু হয় মশার কয়েলের যাত্রা। কিন্তু তার এই কাঠি আকৃতির কয়েল খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত।
পরে একদিন ১৮৯৫ সালে তিনি তার স্ত্রীর বুদ্ধি অনুযায়ী পেঁচানো বা বর্তমানের কয়েলের আকৃতির সৃষ্টি করেন। তার এই কয়েল সে সময়ে এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, যার জন্য পরর্বতীতে তিনি জাপানের রাজ সভায় পেয়েছিলেন মর্যাদাপূর্ণ পদ। পরবর্তীতে তার ছেলেও এই ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হন এবং তিনিও রাজসভায় মর্যাদাপূর্ণ পদ লাভ করেছিলেন।
Eiichiro এর কয়েলে প্রাকৃতিক কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের উপাদান থাকলেও বর্তমানে সারা বিশ্বে কয়েলে কিন্তু ব্যবহার হয় Parathyroid বা চিত্রনেল্লা (যা নানা ধরনের গাছের নির্যাস থেকে পাওয়া যায়) নামক কীটনাশক।
মশার কয়েল কি আসলেও আমাদের মশাবাহিত রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়?
মশার কয়েল কিভাবে কাজ করেঃ
মশা নিধন ও দমনের উপর মশার কয়েলের ভূমিকা নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা হয়েছে।
সবগুলোতেই একমত এসেছে যে মশার কয়েল মশাকে সম্পূর্ণ রূপে নিধন বা দমন করতে না পারলেও তা কামড়ানোর মাত্রা কমাতে পারে।
বর্তমানে মশার কয়েল সাধারণত দু’ধরণের হয়।
এক তা মশাকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে ফেলবে যাতে সাধারণত কীটনাশক জাতীয় রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারিত হয়ে থাকে।
অথবা তা এমন এক ধরনের গন্ধের উদ্রেক করবে যা মশাকে মানুষকে কামড়ানো থেকে বিরত রাখবে। আর এটিতে প্রধানত ভেষজ নির্যাস ব্যবহারিত হয়।
যেমনঃ Citronella.
এর পরও এক বিরাট সমস্যা কিন্ত থেকেই যাচ্ছে। তা হলো, মশার একটু আধটু কামড় মানুষ সহ্য করলেও যখন মশা বাহিত রোগের কথা আসে তখন কি হবে?
কারন কয়েল মশাকে কামড়ানো থেকে কিছুটা বিরত রাখলেও তা কিন্তু সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয়না এবং নিরাপত্তার বিষয়টিও ঝুঁকির মধ্যে রয়ে যায়।
মশা বহিত রোগ ও মশার কয়েলঃ
পরিসংখ্যানে আমরা দেখতে পাই যে, প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় এবং অসুস্থ হয়ে পরে কোনো না কোন মশা বাহিত রোগের জন্য।
এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হল ম্যালেরিয়া। ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশানের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, স্বল্প উন্নত বা অনুন্নত দেশগুলোতে এই মহামারী ধরনের রোগের খরচের ভারে অন্যান্য দিকের কাজের এবং উন্নয়নের বাঁধার সৃষ্টি হচ্ছে।
ডেঙ্গু আর একটি ভয়ংকর মহামারি ধরনের রোগ। যা মশার মাধ্যমে ছড়ায় এবং গত বছর আমারদের সারা দেশ তা প্রত্যক্ষ করেছিল। এখন কয়েল ব্যবহারে যদি মশা মারাই যেত তাহলে আমাদের দেশে কিছুদিন আগে ডেঙ্গুতে এত মানুষ মারা গেল কেন?
মশার কয়েল নিয়ে রিসার্চগুলো থেকে একটি কথা দেখা যায় যে, মশার কয়েল মশাকে কিছু সময়ের জন্য অজ্ঞান বা কামড়ানো থেকে বিরত রাখলেও তা দীর্ঘ সময়ের জন্য কার্যকর নয়।
মশার কয়েলের কার্যকারিতা এবং অকার্যকারিতার প্রশ্নের পাশাপাশি আরও একটি প্রশ্ন খুবই জোরালো ভাবে শোনা যায় তাহল, মশার কয়েল কি মানব স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর?.
মানব স্বাস্থ্য ও মশার কয়েলঃ
বাড়ির ভেতরে মশার কয়েল ব্যবহার নিয়ে সম্প্রতি মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং একই সাথে উদ্রেকেরও সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে মশার কয়েল বানানোর জন্য যে কীটনাশক কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় তা অক্ষতিকারক হিসেবেই গণ্য করা করা হয়।
কিন্তু যখন এটি পুড়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করে তখন তা ভিন্ন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যা মানব দেহের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারন হয়ে ওঠে। যাকে স্লো পয়জোনিং ও বলে।
অনেকে বলে থাকেন যে, একটি সম্পূর্ণ মশার কয়েলে যে পরিমাণ ধোঁয়া হয়, তা প্রতিদিন ১০০টা সিগারেট গ্রহন করার সমান। এ ধারণাটা কি ঠিক?
সিগারেট যে স্বাস্থ্যের জন্য কি পরিমাণ ক্ষতিকর তাতো এখন আমরা সবাই জানি।
মশার কয়েলও কি তাহলে ঠিক একই পরিমাণ ক্ষতিকর?
এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, মশার কয়েলে যে কেমিক্যাল উপাদানগুলো ব্যবহার করা হয় তা যখন পুড়ে, সেখান থেকে যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় তা যে পরিমান ক্ষতিকর পদার্থ করে তা ৭৫-১৩৬ টা সিগারেট একদিনে গ্রহণ করার সমান। তাই সহজেই বলা যায় যে, এ পরিমান ধোঁয়া প্রতিদিন গ্রহণ করলে আমারা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরব।
অনেকে এ ফলাফল থেকে বলে থাকেন যে, দীর্ঘদিন এবং প্রতিদিন মশার কয়েল ব্যবহার আমাদের লাঙ ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তবে এর সম্পর্কে এখনও তথ্যের অভাব আছে।
সম্প্রতি ইঁদুরের উপরে মশার কয়েলের ধোঁয়ার প্রভাব নিয়ে গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এটা তাদের, লিভার, লাঙ এর উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতামত হল যথা সম্ভব এর ব্যবহার কমাতে হবে, বিশেষত বদ্ধ ঘরে। কারণ প্রতিরোধই প্রতিকারের সর্বত্তম পন্থা।
তথ্যসূত্রঃ science.gov, mothership,sg, researchgate.net, malariajournal.biomedcentral.com