কখনো কী আপনাদের মনে এই প্রশ্নটি জেগেছে যে কতটা বিশাল আমাদের এই মহাবিশ্ব? কখনো কি জানতে ইচ্ছে করেছে কতটা বৈচিত্র্যময় এবং রহস্যেঘেরা আমাদের এই মহাবিশ্ব? কখনো কি কোনো এক নিস্তব্ধ রাতে বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছেন যে আমাদের সোলার সিস্টেমের বাইরেও কি কিছু আছে? এই সোলার সিস্টেমের বাইরেও কি কোনো গ্রহ-নক্ষত্র আছে? থাকলেই বা তারা দেখতে কেমন? কেমন হবে তাদের বৈশিষ্ট্য? গ্রহগুলো কি দেখতে আমাদের এই পৃথিবীর মতো? আমাদের এই পৃথিবীর মতোই কি তারাও বসবাসযোগ্য?
যদি এসব প্রশ্ন আপনাদের মনে আসলেই উদয় হয়ে থাকে তবে বলে দেই আপনার মনে সঠিক প্রশ্নেরই উদয় হয়েছে এবং আজ আপনি সেই প্রশ্নেরই উত্তর জানতে চলেছেন। আমাদের এই রহস্যেঘেরা মহাবিশ্বে রয়েছে অসংখ্য অদ্ভুত Exoplanets. আর আজকে আমার এই লেখাটি হলো আমাদের এই মহাবিশ্বের ৫টি রহস্যময় Exoplanets কে নিয়ে। ইতিমধ্যে হয়তো আপনাদের অনেকের মনে প্রশ্ন জেগে উঠেছে যে এই Exoplanet টা কি আবার? চিন্তার কোনো কারণ নেই। লেখাটির শেষে এই Exoplanet কি তার ব্যাপারে কিছু তথ্য আপনাদেরকে দেয়া হবে। তবে চলুন জেনে আসা যাক আমাদের মহাবিশ্বের সেই ৫টি রহস্যময় গ্রহের ব্যাপারে।
১. COROT– 7b:
আকার : পৃথিবী থেকে ১.৫ গুণ বড়
নিজ অক্ষে ঘূর্ণন সময় : ২০ ঘণ্টা অথবা .9 earth days
বয়স : ১.৫ বিলিয়ন বছর
COROT-7b গ্রহটিকে বলা হয় “Two hells in one.” COROT- 7b গ্রহটির পূর্বে নাম দেয়া হয়েছিলো “COROT-Exo-7b”. এই গ্রহটি তাঁর নিজস্ব নক্ষত্র COROT-7 এর চারপাশে ঘুরে যেমন আমাদের পৃথিবী নিজ নক্ষত্র সূর্যের চারপাশে ঘুরে। গ্রহটির তাঁর নিজ নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরতে সময় লাগে ২০ ঘন্টা বা .9 earth days। এই COROT-7 নক্ষত্রটি আমাদের পৃথিবী থেকে ৪৮৯ আলোকবর্ষ দূরে “Constellation Monoceros” এ অবস্থিত। এই COROT-7b গ্রহটি তাঁর নিজ নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরতে সময় লাগে ২০ ঘন্টা। আমাদের পৃথিবী ও সূর্যের চেয়ে এই গ্রহটি তার নক্ষত্রের দিকে ৬০ গুণ কাছে। এই COROT-7 তারাটি ৩৬০ গুণ বড় আকাশে। এই গ্রহটির বয়স ১.৫ বিলিয়ন বছর। দিনের বেলায় গ্রহটির তাপমাত্রা থাকে ৩৩০০-৪৭০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এই তাপমাত্রা ঐ গ্রহের পাহাড় গলতে এবং বাষ্পায়িত করতে যথেষ্ট। এই গ্রহে ফুটন্ত সমুদ্র এবং লাভার সমুদ্র রয়েছে। গ্রহটির একপাশ আগুন এবং গন্ধকে আবৃত আর অন্যপাশে শীতল ঠান্ডার চাদরে মোড়ানো। এই শীতল ঠান্ডা জায়গাটির তাপমাত্রা থাকে -৩৯২ ডিগ্রি ফারেনহাইট। আর এই একই গ্রহে দুই রকমের বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে এই COROT-7b গ্রহটিকে বলা হয় “Two hells in one.” এই গ্রহটি যখন ৩রা ফেব্রুয়ারী,২০০৯ সালে আবিষ্কৃত হয় তখন ধারণা করা হতো এই গ্রহটি পাথুরে গ্রহ। আর এই কারণে এই গ্রহটিকে পৃথিবীর মতো বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা স্বীকৃতি দিয়েছেন যে, এই গ্রহটি বসবাসের জন্য অযোগ্য। এই গ্রহটিতে উত্তপ্ত লাভার সমুদ্র থাকার কারণে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা একটি নতুন নামের প্রস্তাব করেছেন আর তাহলো “Lava-ocean Planet.” এই গ্রহকে নিয়ে “Astronomy and Astrophysics” জার্নালে একটি গবেষণা পত্রও প্রকাশিত হয়েছে।
২. GJ436b:
আকারঃ নেপচুনের মতোই বড়
নিজ অক্ষে ঘূর্ণন সময় : 2.6 earth days
এই গ্রহটির আসল নাম হলো Gliese 436b. এই গ্রহটির আকার অনেকটা আমাদের নেপচুন গ্রহের মতো। এই গ্রহটি আমাদের পৃথিবী থেকে ৩০ আলোকবর্ষ দূরে Constellation Leo তে অবস্থিত। এই গ্রহটি একটি লাল বামন তারকাকে কেন্দ্র করে যার নাম হলো “Gliese 436.” এই গ্রহটি তার নিজ নক্ষত্র থেকে ২.৫ মিলিয়ন মেইল দূরে অবস্থিত ( মার্কারি তার নিজ নক্ষত্র থেকে ৩৬ মিলিয়ন দূরে অবস্থিত)। এই নক্ষত্রের তাপমাত্রা ৮২২ ডিগ্রি ফারেনহাইট যা পানিকে বাষ্পায়িত করতে যথেষ্ট। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও এই গ্রহটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক কারণ এই গ্রহে বিদ্যমান পানিগুলো তরল বা বাষ্পায়িত অবস্থায় না থেকে বরং কঠিন অবস্থায় থাকে। এই গ্রহটিকে “A Planet of burning ice” ও বলা হয়ে থাকে। এই গ্রহের বরফ পৃথিবীর বরফ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই গ্রহের একটি স্পেশাল বরফের নাম হলো “ICE VII.” এই বরফটি আমাদের পৃথিবীর বরফের তুলনায় অত্যন্ত ঘন এবং অনেক বেশি crystalline. বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, শক্তিশালী মহাকর্ষীয় শক্তির কারণে এই বরফটি গ্রহটির কেন্দ্রে গঠিত হয়। এই গ্রহটিকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা এখানেই শেষ নয়। এর বাইরের Hydrogen এবং Helium gas এর স্তরটি মিথেনের উচ্চ মাত্রায় পরিণত হতে পারে। এবং একটি গ্রহে যতটুকু মিথেন গ্যাস থাকা প্রয়োজন তাঁর চেয়ে ৭০০০ গুণ কম মিথেন রয়েছে এই গ্রহে এবং বিজ্ঞানীরা তা পর্যবেক্ষণ করছেন। অন্যদিকে প্রচুর পরিমাণে Carbon MonoOxide রয়েছে এই গ্রহে যা মূলত গ্রহটির কেন্দ্র থেকে উদ্ভব হয় যেখানে তাপমাত্রাও অতিশয় ঘেমে যায়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে NASA এই গ্রহের আবহাওয়াতে মেঘের সন্ধান পায়। এই গ্রহটি ২০০৪ সালের আগষ্ট মাসে Carnegie Institute of Washington এবং University of California, Berkeley এর R. Paul Butler এবং Geoffrey Marcy আবিষ্কার করেন।
৩. 55 Cancri E:
আকারঃ ২টি পৃথিবীর সমান
নিজ অক্ষে ঘূর্ণন সময় : .7 earth days
55 Cancri E গ্রহটি “Janssen” নামেও পরিচিত। এই গ্রহটি তাঁর নিজ নক্ষত্র “55 Cancri A” কে কেন্দ্র করে ঘুরে। এই গ্রহের ভর আমাদের পৃথিবীর ভরের ৮.৬৩ এবং এর ব্যাস আমাদের ২টি পৃথিবীর সমান। গ্রহটির নিজ অক্ষে ঘুরতে ১৮ ঘন্টারও কম সময় লাগে। আমাদের থেকে ৪০ আলোকবর্ষ দূরে “Constellation Cancer” এ অবস্থিত। এই গ্রহটি ১/৩ ডায়মন্ডের জন্যও বিখ্যাত। এর কারণ হলো এই গ্রহের আবহাওয়াতে প্রচুর পরিমাণে কার্বন রয়েছে যা গ্রহটির প্রচণ্ড তাপ এবং চাপে এই গ্রহের ভর ডায়মন্ডে পরিণত হয়। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে ঘোষিত হয় যে এই গ্রহটি “Carbon Planet” ও হতে পারে। এই গ্রহের বর্তমান মূল্য 26.9 nonillian dollars ( 1 nonillian is 1030)। COROT-7b এর মতোই এই গ্রহেও জোয়ার আসে এবং গ্রহের একপাশে থাকে সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপ আর আলো এবং অন্যপাশে রয়েছে চিরস্থায়ী অন্ধকার। এই গ্রহটি তাঁর নক্ষত্রের খুব কাছাকাছি অবস্থিত আর যার কারণে এই গ্রহের পানি তরল অবস্থায় থাকতে পারেনা। বরং এই কারণে এই গ্রহের পানি “Supercritical State.” অবস্থায় থাকে। “Supercritical State” হলো এমন একটি দশা বা অবস্থা যেখানে পানি তরল এবং বাষ্পীয় পর্যায়ের মধ্যবর্তী অবস্থায় অবস্থান করে। এই Supercritical State এ কোনো Surface Tension থাকেনা। এই গ্রহের অন্যপাশে রয়েছে অত্যন্ত উত্তপ্ত অবস্থা যেখানকার তাপমাত্রা ৪০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পৌছায় এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকায় আবৃত থাকে। এই গ্রহে কোনোভাবেই কোনো প্রাণী বেঁচে থাকতে পারবেনা। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে NASA’s Hubble Space Telescope একটি তথ্য প্রদান করে আর তাহলো এই গ্রহের ভূগর্ভে Hydrogen Cyanide এর ক্ষরণ হয় যার কারণে ভূগর্ভস্থ থেকে অত্যধিক বিষাক্ত তরল নির্গত হয়।
৪. WASP-12b:
আকারঃ 1.8 Jupiter
নিজ অক্ষে ঘূর্ণন সময় : 1.1 earth days
এই গ্রহটি অত্যন্ত অদ্ভুত একটি গ্রহ কারণ এই গ্রহটি তার নিজস্ব নক্ষত্রের Gravity এর কারণে দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে এবং একটি প্রশস্ত আকৃতির দিকে এগোচ্ছে। এই গ্রহটি জীবিত থাকার মাত্র ১০ মিলিয়ন বছর বাকি আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে কারণ এটি প্রতিবছর প্রায় ১৮৯ কোয়াড্রিলিয়ান টন হারে পৃথকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এবং সূর্য দ্বারা প্রতিনিয়তই ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা প্রথম যখন এই গ্রহের সন্ধান পান তখন তাঁরা পুরোপুরি অবাক হন কারণ এই গ্রহটি দেখতে পুরো Pitch Black রঙের। এই মহাবিশ্বের সবকিছু যেখানে প্রতিফলন ঘটায় সেখানে এই গ্রহটি প্রতিফলনের পরিবর্তে ৯৪% আলোই শোষণ করে নেয় আর এই জন্য এই গ্রহকে “Black as Asphalt” বলা হয়ে থাকে আর তথ্যটি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিজ্ঞানীরা প্রকাশ করেন। এই গ্রহটির আবিষ্কার হয় ১লা এপ্রিল, ২০০৮ সালে। এটি তাঁর নিজ নক্ষত্র “WASP-12” কে কেন্দ্র করে ঘুরে এবং নিজ নক্ষত্র থেকে এর দূরত্ব ২,১১৫,০০০ মাইল দূরে “Constellation Auriga” তে অবস্থিত। এই দূরত্ব পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের ১/৪৪। ৩রা ডিসেম্বর। ২০১৩ সালে NASA’s Hubble Space Telescope এই গ্রহের আবহাওয়াতে পানির সন্ধান পেয়েছে বলে ঘোষণা দেয়।
৫. Trappist-1b:
আকারঃ পৃথিবীর সমান
নিজ অক্ষে ঘূর্ণন সময় : 1.5 earth days
Trappist-1b গ্রহটি মূলত একটি পাথুরে গ্রহ যা দেখতে শুক্র গ্রহের মতো। এই গ্রহটি “2MASS J23062928-0502285b” নামেও পরিচিত। এই গ্রহটির তাপমাত্রা ২২৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এই গ্রহের ভর পৃথিবীর ভরের চেয়ে ১২% বেশি। এটি সূর্য থেকে ৩৯.৬ আলোকবর্ষ দূরে “Constellation Aquarius” এ অবস্থিত। এটি Trappist-1 নামক অতিশয় ঠান্ডা বামন তারকাকে ঘিরে ঘুরছে। এটি ২০১৬ সালের ২রা মে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। এই গ্রহের আবহাওয়া অত্যন্ত পাতলা এবং গরম। ২০১৮ সালের গবেষণা মতে এই গ্রহের আবহাওয়া পৃথিবী এবং শুক্র গ্রহের চেয়েও গরম।
এবার আসা যাক Exoplanet কি এই ব্যাপারে। Exoplanet মানে হলো ভিনগ্রহ। যেসকল গ্রহ আমাদের সোলার সিস্টেমের বাইরের কোনো নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরে তাদেরকে বলা হয় Exoplanet. অর্থাৎ আমাদের সোলার সিস্টেমের বাইরের গ্রহগুলোকেই বলা হয় Exoplnet। ১৯১৭ সালে সর্বপ্রথম এই exoplanet এর সন্ধান পাওয়া যায়। ১লা ডিসেম্বর, ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই exoplanet এর সংখ্যা হলো ৩৯০৩ টি যা ২৯০৯ টি সিস্টেমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। প্রতিদিন এমন অসংখ্য exoplanet আবিষ্কৃত হচ্ছে যার অধিকাংশই ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত এবং রহস্যে ঘেরা। এই exoplanet গুলোর এমন অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকালেই আমাদেরকে ভাবতে বাধ্য করে যে তাহলে কতটাইনা বৈচিত্র্যময় এবং রহস্যেঘেরা আমাদের এই মহাবিশ্ব যার অধিকাংশই এখনো আবিষ্কার হওয়া বাকি। আর মহাকাশের প্রতিদিন এমনি নতুন নতুন তথ্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। আবারো হাজির হবো আরও ৫টি রহস্যময় গ্রহের তথ্য নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে। ততদিন পর্যন্ত ভাবতে থাকুন এই রহস্যময় গ্রহগুলোকে নিয়ে আর অনুভব করুন রহস্যেঘেরা এই মহাবিশ্বের বিশালতাকে।