রহস্যময়ী বিবর্তন

বিবর্তন বিষয়টা কি আসলে? বিবর্তন বলতে আমরা বুঝি যে, কোন একটি প্রাণির সময়ের সাথে সাথে শারীরিক যে পরিবর্তন। কিন্তু আমরা জেনে শুনেও এর একটা ভুল ব্যখ্যা সবসময়ই দিই। বিবর্তন (evolution) শব্দটির সাথে আমরা সবসময় প্রগ্রেস বা ইমপ্রুভমেন্ট শব্দটি গুলিয়ে ফেলি। কিন্তু আসলে এগুলো এক নয়। এদের অর্থের মাঝে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য।

কারণ জীববৈজ্ঞানিক বিবর্তন সেভাবে কাজ করে না, যেভাবে কাজ করে বলে আমরা মনে করি। বিবর্তনে যেটা হয় সেটা হচ্ছে জীবদেহের কোন একটি নির্দিষ্ট অঙ্গ বিবর্তিত হয়। হতে পারে নতুন কোন শক্তি বা ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে। আবার কোন বিশেষ শক্তি বা ক্ষমতা হারানো মাধ্যমেও হতে পারে এই বিবর্তন। অনেকে অবশ্য এই বিষয়টাকে devolution বা reverse আবার regressive evolution বলতেই স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করে। কিন্তু আমি মনে করে এটা আমাদের কারোরই বলা উচিৎ না।

Devolution বলে কিছু নেই

আগেই একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিই, সেটা হচ্ছে devolution বা regressive evolution এগুলো হচ্ছে নামের ভুল প্রয়োগ। জীববিজ্ঞানে এধরণের কোন টার্ম নেই। জীববিজ্ঞানী Michael J. Dougherty সাইন্টিফিক আমেরিকাকে দেওয়া তার এক সাক্ষাতকারে বলেন, সময়ের সাথে জীবদেহের জিনগত পরিবর্তনই বিবর্তন। যে অঙ্গের জিনে বিবর্তন ঘটে সেই অঙ্গ একটি বিশেষ রূপ লাভ করে। এই পরিবর্তন পজিটিভ হোক বা নেগেটিভ হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। মূল কথা হল বিবর্তন ঘটেছে।

আমরা সকলেই জানি যে ফুলকার চেয়ে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা, আর থাবার(Paws) চেয়ে সুসজ্জ্বিত হাতের কর্মক্ষমতা বেশি। আমরা এটা জানতে পেরেছি কারণ প্রকৃতিতে বিবর্তন ঘটেছিলো বলে। বর্তমানে বিবর্তনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে মানুষ। মানুষের মাঝে কম বিবর্তন ঘটেনি। অজস্র বিবর্তনের ফলে আজকের মানুষ।

প্রশ্ন আসতেই পারে, মানুষের আবার অজস্র বিবর্তন কোথা থেকে আসলো??

বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষের যেই স্পিশিজ টি রাজ করছে তার নাম হোমো সেপিয়েন্স। আর এই মানুষের এই স্পিশিজটিই টিকে আছে প্রকৃতিতে। কিন্তু তাই বলে সবসময়ই কি মানুষের এই একটি স্পিশিজই ছিলো???

কখনোই না। মানুষের অনেক স্পিশিজই ছিলো। তার মধ্যে প্রধান চারটি হল:

১.হোমো ইরেক্টাস

২.হোমো ফ্লোরোসিয়েন্সিস

৩.হোমো নিয়ানডারথাল

৪.হোমো সেপিয়েন্স

 

 

এদের সবারই বিবর্তন ঘটেছিলো। কিন্তু বিবর্তনের ফলে পরিবেশে টিকে থাকার জন্য যে বৈশিষ্ট্যের দরকার ছিলো তা শুধুমাত্র সেপিয়েন্সরাই অর্জন করে। অর্থ্যাৎ অগণিত বিবর্তনের একটি মাত্র ফল আমরা।

বিবর্তনের পূর্বে

বর্তমানে আমরা যতো প্রাণি দেখি তাদের সবাই বিবর্তনের রূপ। তাদের না দেখা রূপ নিয়ে গবেষণা সবসময়ই চলমান। শুরুর দিকে রিগ্রেসিভ ইভোলিউশনের কথা বলেছিলাম। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধ করি পেঙ্গুইন হবে। পেঙ্গুইনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, তারা একসময় ডানা ঝাপটে আকাশে উড়তে পারতো। পেঙ্গুইনের ফসিলও সেই দিকে ইঙ্গিত দেয়। প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর পূর্বে পেঙ্গুইন তার উড়তে পারার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই পরিবর্তন পেঙ্গুইনকে শিকার ধরার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সাহায্য করে। কিন্তু স্থলভাগের প্রাণি হিসেবে এই পরিবর্তন তাকে করেছে অনেক দুর্বল। বিবর্তন কখনো ফ্রীতে হয় না। বিবর্তন কিছু দিলে কিছু আবার কেড়েও নেয়।

একটি প্রাণি ভালো সাঁতার কাটে, আরেকটি প্রাণি ভালো উড়তে পারে। কিন্তু এরকম প্রাণি সহজে পাওয়া যাবে না, যার মধ্যে দুটি গুণই রয়েছে। বিবর্তন পেঙ্গুইনের কাছে থেকে তার উড়তে পারার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। অপরদিকে এই বিবর্তনই তাকে আকৃতিতে বড় করেছে, হাড়ের ঘনত্ব বাড়িয়েছে, শীতল পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা দিয়েছে। বিবর্তন বোঝে যে, কোন প্রাণির কি প্রয়োজন। তাই একে devolution বলা যাবে না। পেঙ্গুইনের সাথে সেটাই হয়েছে যেটা তার প্রয়োজন ছিলো।

এধরণের আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে। একসময় সাপের পা ছিলো, পাখির দাঁত ছিলো। কিন্তু এখন তার কিছুই নেই।

সবচেয়ে আজগুবি ঘটনাটা ঘটেছে তিমির সাথে। তিমির পূর্বপুরুষের শুরুটা হয় সমুদ্রে। বিবর্তনের ফলে তারা হাঁটার জন্য পা অর্জন করে এবং স্থলভাগের প্রাণিতে পরিণত হয়। তার অনেক সময় পরে তিমি আবার পানিতে ফিরে যায়, আর বিবর্তনের সূত্র ধরে সেই অর্জিত পা আবার হারিয়ে ফেলে।

তিমির পূর্বপুরুষ আর জলহস্তীর যাত্রা প্রায় একই সময়ে। তারা একত্রেই বিচরণ করেছে। তিমি স্থলভাগ ও জলভাগ, দুটো জীবনই দেখেছে। তিমির বোধ হয় জলজীবনটাই বেশি শান্তির মনে হয়েছে। তাই সে আবার সেই জলেই ফিরে গিয়েছে। সে গেলেও জলহস্তী আর যায় নি। জলহস্তী তার জায়গাতেই রয়ে যায়।

বিবর্তন একটি চেইন। যার প্রতিটি ধাপ একটি প্রাণির জীবনধারা পাল্টেছে। বিবর্তন আছে দেখেই আজও পৃথিবীর বুকে প্রাণির অস্তিত্ব রয়েছে। বিবর্তন যতোদিন, জীবকূলও ততোদিন।

4 Comments

  1. Nazmul

    বানর থেকে বিবর্তন হয়ে যদি মানুষ হয় তাহলে এখনও বানর আছে কেন????

    • Abid

      এটা একটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মানুষ কখনোই বানর থেকে আসেনি। আমাদের এক শ্রেণির মানুষ কিছু না জেনে বুঝেই এসব মন্তব্য করেন।
      প্রাইমেট নামের এক প্রাণি পৃথিবীতে বিরাজ করতো। একটি প্রাইমেট দুইবার বিবর্তিত হয়ে দুটি প্রাণির জন্ম দেয়। একটি বানর, অপরটির নাম এপ। বানরের লেজ ছিলো, কিন্তু এপের লেজ ছিলো না।
      এই এপ থেকে আসে মানুষ।
      সুতরাং, মানুষ বানরে থেকে আসেনি। বরং বানর ও মানুষ উভয়ই প্রাইমেট থেকে এসেছে।

      • Nazmul

        আল্লাহু তো কুরআন শরীফে বলেছেন আদম (আঃ) কে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাহলে আপনারা এই বিবর্তন কোথায় পেলেন????

        • abidul99

          আপনি ধর্ম আর বিজ্ঞানকে এক করে ফেলছেন। আপনার ধর্ম আপনার বিশ্বাস। কিন্তু বিজ্ঞান হল লজিক্যাল ফ্যাক্ট। এখন আপনি কোনটায় বিশ্বাস রাখবেন সেটা নিতান্তই আপনার ব্যাক্তিগত বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>