চাঁদের রহস্য! পর্ব-১

আয় আয় চাঁদ মামা।

টিপ দিায় যা

চাঁদের কপালে চাঁদ

টিপ দিয়ে যা

আয় আয় চাঁদ মামা-ছেলেবেলায় ঘুমপাড়ানাে সেই বিখ্যাত পংক্তি। যে চিরচেনা পংক্তি শুনে কেটেছে আমাদের শৈশব। এই সেই চাঁদ যেখানে বসে অক্লান্তভাবে সুতা কেটে যাচ্ছে এক বুড়ি। যদিও এখন আমরা জানি চাঁদের বুড়ি সুতা বানিয়ে যতই স্তুপ করুক, সেই সুতা দিয়ে জামা পড়ার জন্য চাঁদে যে কেউ নেই! চাঁদের সাথে মানুষের এই যে এক মায়াময় সম্পর্ক গড়ার প্রচেষ্টা তা সভ্যতার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই। চাঁদকে ঘিরে মানুষ তৈরি করেছে পুরাণ, লােকগাথা ও মজার মজার সব কাহিনী।

প্রাচীন সভ্যতার মানুষরা চাঁদকে দেবতা হিসেবে উপাসনা করত। ইউরােপের মানুষরা সেই চাঁদকে দিয়েছিল দেবীর মর্যাদা (চন্দ্রদেবী ডায়না)। বিভিন্ন শিলালিপি থেকেও চাঁদ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা গেছে। তবে আজও আমাদের নিকটতম পড়শি চাঁদ রহস্যের আরেক নাম। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব হচ্ছে ৩,৮৪,৩৯৯ কিলােমিটার। এই দূরত্ব আঁচ করতে হলে চলুন এক অভিযানে নামি। একটি দ্রুতগতির গাড়িতে করে প্রতি ঘন্টায় ৬০ মাইল বেগে পৃথিবী থেকে রওনা দেই চাঁদের পানে। তবুও সেখানে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবেন বলে ভাবছেন? এই লাগামহীন গতিতেও পৌছুতেই লাগবে পাঁচ মাস!

কেমন হত যদি না থাকতাে চাঁদ?  যদি চাঁদ না থাকতাে তবে পৃথিবীর বা পৃথিবীর মানুষদের কি কিছু এসে যেত? তা বৈকি! চাঁদের অনুপস্থিতিতে আমরা কেবল আলােকোজ্জ্বল মনােমুগ্ধকর রাত থেকে বঞ্চিত হতাম বা কবিরা চাঁদ নিয়ে পাতার পর পাতা কবিতা লেখার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হতেন শুধু তাই নয়।

চাঁদের উপস্থিতি পৃথিবী গ্রহটাকে অধিষ্ঠিত করেছে এক অন্য মাত্রায়। চাঁদ না থাকলে থাকতাে না কোন জোয়ার-ভাটা, এমনকি থাকতাে না আমাদের পরিচিত ২৪ ঘণ্টায় দিন। রাতের আবর্তন! ৬ ঘণ্টায়ই আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম সারতে হত! আমরা দেখতে পেতাম না সূর্যগ্রহণ। যার ফল হত সৌরজগত সম্বন্ধে আমরা যতদূর জানি সেটিও হয়ে পড়ত ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা।

চাঁদ নিয়ে নানা লােকগাথা চাঁদে মানুষ আছে তা রেনেসাঁ পরবর্তী যুগে এমনকি বিজ্ঞানীরাও বিশ্বাস করতেন। ইউরেনাস গ্রহ আবিষ্কার করা বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্শেলের লেখায় এরকম বিশ্বাসের প্রতিফলন পাওয়া যায়। হার্শেল একধাপ এগিয়ে চাঁদে মানুষ থাকার ব্যাপারটিকে অভিহিত করেছেন ‘চিরন্তন সত্য বলে! আরেক কিংবদন্তি জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলারও প্রায় একই কথার প্রতিধ্বনি করেছিলেন। ‘সােমনিয়াম’নামে চাঁদ নিয়ে একটি বই লেখা হয়েছিল। গ্রন্থের প্রধান চরিত্র ডুরাকোটাস এক প্রেতাত্মার মাধ্যমে চাঁদে গিয়ে পৌছায়। চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর ছায়া চাঁদে গিয়ে পড়ে, এই ফাকে ছায়া আরােহণ করে সেই প্রেতাত্মা।

ডুরাকোটাসকে পৌঁছে দেয় চাঁদের বন্দরে। তবে কল্পনার ক্যানভাসে আঁকা এসব গালগল্প লিখলেও কেপলার অবহিত ছিলেন যে আমরা শুধু চাঁদের একটি পৃষ্ঠ দেখি, অন্য পৃষ্ঠটি নয়। সে যুগের অনেক বিজ্ঞানীর বিশ্বাস ছিল যে চাঁদে বায়ুমন্ডলও আছে। মানুষ বিশ্বাস করত চাঁদের প্রাণীরা হরেক রকম হয়। স্বয়ং কেপলারও চাঁদের অধিবাসীদের বর্ণনা দিয়েছিলেন। সাপ আকৃতির, মাছ সদৃশ, ডানাওয়ালা উভচর বা লােমশ আরাে অজস্র মানুষ এই ধরনের লেখনী দ্বারা জীবের অস্তিত্বের জানান দিতে চেয়েছিলেন।

তবে উনিশ শতাব্দীতেই চাঁদে প্রাণী থাকার ব্যাপারটা নাকচ হয়ে যায়। এমনকি চাঁদে অভিযানের আগ পর্যন্তও চাঁদে গাছপালা আছে এমন ধারণা টিকে ছিল।

যেভাবে হল চাঁদের শুরু

কীভাবে শুরু হয়েছিল চাঁদের? কেনই বা এটি পৃথিবীর চারপাশে ঘুরঘুর করছে? বহু বিজ্ঞানীই আগে মনে করতেন যে চাঁদ একসময় ছিল পৃথিবীর অংশ। তবে চাঁদে অভিযানের পর চাঁদের মাটি বিশ্লেষণকরে তাদের গলায় এখন ভিন্ন সুর। সৌরজগতের সৃষ্টির সময়ে ধুলাে আর গ্যাসের মেঘের মধ্যে সূর্যের কাছের চারটি পাথুরে গ্রহ তৈরি হয়েছিল আগে। এরপর কোটিখানেক বছর বাদে অসংখ্য পাথরখণ্ড একসাথে জোড়া লেগে সৃষ্টি হল পৃথিবীর। সূচনার সময় যখন পৃথিবীর আকার ছিল অসম্পূর্ণ সে সময়ে মঙ্গলগ্রহ আকারের বিশালাকার বস্তুর সাথে হল পৃথিবীর ঠোকাঠুকি। নিমেষে ঘটে যাওয়া এ ঘটনায় পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে বিপুল পরিমাণ বস্তু ছিটকে পড়ল মহাকাশে। যার দরুন পৃথিবীর পাথর গলে বইতে লাগলাে স্রোত। ওই ছিটকে পড়া অংশটিই পৃথিবীর পাশে ঘুরতে ঘুরতে জমাট বাঁধে ও তারপর কক্ষপথ লাভ করে তৈরি করে চাঁদ। চাঁদের কক্ষপথ যে হেলে পৃথিবীর বিষুবরেখার সাথে আছে তা এই সংঘর্ষেরর ফল। ছেলেবেলায় আমরা যে ভিসুভিয়াস, ক্রাকাটোয়া প্রভৃতি আগ্নেয়গিরির কথা জেনেছি চাঁদে ছিল এর চেয়েও বড় আগ্নেয়গিরি।

এই আগ্নেয়গিরি দিয়ে হুংকার ছেড়ে বেরিয়ে আসতাে বিষাক্ত সব গ্যাস আর লাভার বন্যা। এতে এককালে লাভা বেরােলেও এখন অবশ্য আর লাভার দেখা মেলে না। সময় যত বয়েছে সেই গনগনে উত্তপ্ত লাভাগুলােও ক্রমেই শীতল হয়ে এসেছে। পৃথিবীর চেয়ে চাঁদের ওজন বা আয়তন কম হওয়ার জন্যই চাঁদে আগ্নেয়গিরিগুলাে শীতল হয়ে গেছে। পৃথিবীর তুলনায় চাঁদের পাহাড়গুলাে কিন্তু বড়। আর এই পাহাড়গুলাের ‘Crater’ বা গর্তগুলােও বিশালাকায়। এমনটা হবার পেছনে কারণ হল চাঁদের ওজন পৃথিবীর তুলনায় কম। ওজন নির্ভর করে আকর্ষণ শক্তির উপর। চাঁদ পৃথিবীর চেয়ে ছােট হওয়ায় এর আকর্ষণ পৃথিবীর চেয়ে কম। গাণিতিকভাবে তা ছয় ভাগের এক ভাগ মাত্র। তার মানে পৃথিবীতে আপনার ওজন যদি হয় ৬০ কেজি চাঁদে সেই আপনিই হয়ে যাবেন ১০ কেজি। আরাে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে চাঁদে। যেমন ধরুন একটা উঁচু লাফ দিয়ে ৩ ফুট উঁচুতে উঠতে পারবেন। সেই একই লাফ দিয়ে আপনি চাঁদে উঠে যেতে পারবেন ১৮ ফুট! ঠিক এ কারণেই আগ্নেয়গিরিতে যে লাভাগুলাে ছিল সেগুলাে উপরে উঠে যেত। তারপর ছিটকে পড়ত অনেক দূরে। আর তাই পাহাড়ের গর্তগুলাে অনেক ছড়ানাে হয় ।

চন্দ্রগ্রহণ

সূর্যগ্রহণকে খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। যখনই সূর্যগ্রহণ ঘটার সম্ভাবনা থাকে পুরাে পৃথিবীর মানুষ এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সে তুলনায় চন্দ্রগ্রহণ ততটা আগ্রহ জাগায় না। ঘটনাটা অসম্ভব রকমের সুন্দর হলেও অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় না। যদি আমরা একটি অন্ধকার ঘরে বিলিয়ার্ড বলের উপর টর্চলাইট জ্বেলে ফোকাস করি,তাহলে বলে একটি কোণাকৃতির ছায়া পড়বে। এই বলের মতাে পৃথিবীরও নিজস্ব কোনাে আলাে নেই। সূর্যের আলাে যখন পৃথিবীর একপাশে পড়ে তখন পৃথিবীর অন্যপাশে ছায়া পড়ে।

এই ছায়াকে বলে প্রচ্ছায়া (Umbra)। যখন প্রচ্ছায়ার মধ্য দিয়ে চাঁদ চলাচল করে তখন সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ একই সরলরেখায় অবস্থান করে। পৃথিবী থাকে এ তিনটির মধ্যস্থানে, সূর্যের আলাে চাঁদে পড়ে না ও চাঁদের পৃষ্ঠ অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ে। কারণ, পৃথিবী থেকে দেখতে সূর্যকে চাকতির মতাে লাগে।

প্রচ্ছায়া একটি ছায়া অঞ্চল দিয়ে ঘেরা যার নাম Penumbra। এ ব্যাপারটাও সেসময় চাঁদের অনুজ্জ্বলতার জন্য দায়ী। চাঁদ যখন প্রচ্ছায়ার ভেতর দিয়ে যায় সূর্যের সরাসরি আলাে আর চাঁদে পড়ে না। তবে সূর্যের কিছু রশ্মি এতে তখনও পৌঁছে। পৃথিবীর বায়ুর মাধ্যমে তা বেঁকে যায়।

এই বেঁকে যাওয়া রশ্মির কিছু চাঁদের পৃষ্ঠে পৌঁছে, যদিও চাঁদ তখন পৃথিবীর পেছনে। এই প্রক্রিয়ার ফলে চাঁদ তামাটে রং ধারণ করে। এ ঘটনা চন্দ্রগ্রহণের মাঝামাঝি সময়ে দেখা। যায় । চন্দ্রগ্রহণ প্রতিবার পূর্ণচন্দ্রে ঘটে না কারণ চাঁদের কক্ষপথ পৃথিবীর দিকে কিছুটা হেলানাে। একবার চন্দ্রগ্রহণ ঘটতে পূর্ণচন্দ্রের আবির্ভাব থাকতে হয়। যদি সংযােগস্থলের আগে বা পরে পূর্ণচন্দ্রের উপস্থিতি হয়, তাহলে প্রচ্ছায়া অঞ্চলের চন্দ্রগ্রহণ দেখা যায়। এখনকার দিনে আমরা শতবছর পরের চন্দ্রগ্রহণ সম্বন্ধে অনুমান করতে পারি। কারণ পৃথিবী ও চাঁদের ঘূর্ণন সম্পর্কে বেশ ভালােভাবে জানা গেছে। কিন্তু হাজার বছর আগে ব্যাপারটা সহজ ছিল না। ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী থেলিস চন্দ্রগ্রহণের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন আরও অনেক জটিল পদ্ধতির মাধ্যমে। তিনি জানতেন যে সূর্য ও চাঁদ প্রতি ১৮ বছর ১০ দিনে একই অবস্থানে একবার আসে। যেটি তথাকথিত Saros’ নামে পরিচিত। অতএব পরের সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণও ১৮ বছর ১০ দিনে হবে (যা প্রতি পাঁচটি লিপ ইয়ার পরে হয়)। প্রাকৃতিকভাবে এদের অবস্থানগুলাে পুরােপুরি একই হয় না ও পরের চন্দ্রগ্রহণটি অবিকল হুবহু ঘটে না। তবে ক্যালডিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পদ্ধতি ব্যাবহার করে থেলিস চন্দ্রগ্রহণের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও তিনি জানতেন না গ্রহণের কারণ কী। চন্দ্রগ্রহণের প্রাচীন ধারণাগুলাে বড় অদ্ভুত। তবে পরে আসল কারণ জানা গেছে। অ্যানাক্সাগােরাস সঠিক কারণটি জানতেন ও তিনি আরও অনুধাবন করেছিলেন যে ছায়ার বৃত্তাকার আকৃতির মানে হল পৃথিবী অবশ্যই একটি গেলাকার বস্তু।

Comments are closed.