টেলিস্কোপ রহস্য!

টেলিস্কোপের কথা মনে আসলেই সবার প্রথমে ধুপ করে কার নামটা মাথায় আসে বলুন তাে? হ্যাঁ, উনার নাম গ্যালিলিও। পুরাে নাম গ্যালিলিও গ্যালিলি। কিন্তু কথা হচ্ছে, কেন তার নামটাই সবার প্রথমে মাথায় টোকা দিবে? কেননা, এটা হচ্ছে সেই বিষয় যেটা সবাই জানে, তারপরেও ভুল করে। আমরা অনেকেই মনে করি, গ্যালিলিও টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কর্তা। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই তাই?

টেলিস্কোপের সর্বপ্রথম আবিষ্কর্তাকে নিয়ে অনেক খোঁড়াখুঁড়ির পরেও গবেষকরা আসল মানুষটিকে প্রমাণসহ বের করতে পারেননি। টেলিস্কোপের সাথে লেন্সের ব্যাপারটা ওতপ্রােতভাবে জড়িত। আর এই লেন্সের ধারণাটা আপনার আমার সময়কার তাে নয়ই, রীতিমতাে খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকে শুরু হয়েছিলাে। খ্রিস্টপূর্ব ৭১০-৭৫০ এর সময়টাতে ব্যবহৃত হওয়া একটা ক্রিস্টাল লেন্স এখনাে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে, যার একদিক উত্তল লেন্সের বৈশিষ্ট্যের সাথে পুরােপুরি খাপ খেয়ে যায়। যদিও ওটা কী কাজে ব্যবহার করা হতাে তা কখনােই জানা যায়নি, তবে এমনটা তাে ভাবা যেতেই পারে ওটাও হয়তাে কোনাে বেসিক টেলিস্কোপেরই অংশ ছিল?

যাই হােক, ফিরে যাই টেলিস্কোপের ইতিহাসে। এর সর্বপ্রথম আবিষ্কারক হিসেবে যাকে ধরে নেয়া যায় তার নাম ‘লিওনার্ড ডিগস” (Leonard Diggs). তবে দুঃখের ব্যাপার হলাে, এই ভদ্রলােকের ব্যাপারে উল্লেখ করার মতাে ইতিহাস তেমন কিছুই মনে রাখেনি। আবিষ্কারের পর নিজ আবিষ্কারের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে না পারার কারণেই হয়তাে ইতিহাস তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাে। কে জানে? তবে ১৬০৮ সালে একজন ডাচ আইগ্লাস মেকার সর্বপ্রথম তাদের সরকারকে একটি নতুন ধরনের যন্ত্রের প্রস্তাব দেয়। যন্ত্রটিতে একটি টিউবের দুপ্রান্তে দুটি লেন্স সংযুক্ত ছিলাে, যেগুলাে বস্তুর প্রতিবিম্ব বর্ধিতকরণে ভূমিকা রাখতাে। লােকটার নাম ছিলাে “হ্যান্স লিপারশে” (Hans Lippershey)। তবে লিপারশে যখন সরকারকে এই যন্ত্র ব্যবহারের প্রস্তাব দেন এবং একই সাথে আবিষ্কারের পেটেন্টের জন্যে আপিল করেন, তার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় আরাে দুই ডাচ অপটিশিয়ান। ইয়ে, মানে,ঠিক পথের কাঁটা নয়, মানে আপদ হয়ে দাঁড়ায় আর কি… যদিও ঠিক একই সময়ে একই কনসেপ্টের উপর ঐ দুই ডাচ অপটিশিয়ান কাজ করছিলাে, তারপরেও সর্বপ্রথম আবিষ্কারের পর কনসেপ্টটা সবাইকে ঠিকমতাে বােঝাতে পারায় এবং মূলত আগে পেটেন্টের জন্যে আপিল করার কারণে, টেলিস্কোপ আবিষ্কারের ক্রেডিট পেয়ে যান লিপারশে। অল্পের জন্যে বাঁচা!

তাে প্রশ্ন জাগতেই পারে, তাহলে টেলিস্কোপের কথা উঠলেই গ্যালিলিওর নামই বা এত আড়ম্বরের সাথে উচ্চারিত হয় কেন?” উত্তরটা খুবই সহজ। লিপারশের এই আবিষ্কারের ব্যাপারটা গ্যালিলিওকে অনেক বেশি উৎসাহিত করে। তিনি টেলিস্কোপ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। লিপারশের তৈরি করা টেলিস্কোপের বর্ণনা তাে আগেই দিলাম। মােটামুটি বলতে পারেন, পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান মুভিতে জ্যাক স্প্যারাের হাতে থাকা সেই ছােট্ট দুরবিনের মতাে যন্ত্র, যা বস্তুকে তিন গুণ বড় আকারে দেখাতে পারতাে। কিন্তু গ্যালিলিও সেই টেলিস্কোপের ওপর গবেষণা করে এর ক্ষমতাকে প্রথমে ৮ গুণ, তারপর ১০ গুণ এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত পেছনে লেগে থেকে প্রায় ৩০ গুণ বাড়িয়ে ফেলতে সক্ষম হন! একসময় যেই টেলিস্কোপে কিনা শুধুমাত্র দুটো সাধারণ লেন্সের ব্যবহার হতাে, তার চেহারা পাল্টে ফেলে তিনি তৈরি করে ফেলেন উত্তল আর অবতল লেন্সের সমন্বয়ে বিশাল সব টেলিস্কোপ। আরাে কী কী করেছে সেই টেলিস্কোপ দিয়ে শুনতে চান? তিনিই সর্বপ্রথম টেলিস্কোপ দিয়ে চাঁদ পর্যবেক্ষণ করেছেন, জানতে পেরেছেন চাঁদের গায়ে রয়েছে উঁচু নিচু অসংখ্য গর্ত আর পাহাড়। তিনিই সবার আগে বুধের পৃষ্ঠদেশ, বৃহস্পতির চাঁদ, মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সি, শনির বলয় স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণে সক্ষম হন। তাঁর কারণেই হাজার বছরের ভুল ধারণা ভেঙে মানুষের বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। একসময় মানুষ মনে করতাে, পৃথিবী আসলে মহাবিশ্বের কেন্দ্র আর সকল গ্রহ-নক্ষত্র একে কেন্দ্র করে ঘােরে। বৃহস্পতির উপগ্রহগুলােকে দেখেই তিনি এই ভুলটা ধরতে পারেন। যা হােক, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। তা নিয়ে আরেকদিন গল্প করা যাবে।

তাে যেটা বলছিলাম, গ্যালিলিও টেলিস্কোপের সর্বপ্রথম আবিষ্কর্তা ছিলেন না ঠিকই কিন্তু টেলিস্কোপে অসামান্য অবদান রেখে বাকিদের অবদানকে সামান্য হলেও ম্লান করে দিয়েছিলেন। আমরা কিন্তু এখনাে জানি না, টেলিস্কোপের সর্বপ্রথম আবিষ্কর্তা কে। কে জানে, হয়তােবা কোনােদিনই সেটা জানবাে না! গ্যালিলিওর পর টেলিস্কোপ নিয়ে আরাে দুজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক কাজ করেছেন। অনুমান করতে পারেন, তাঁরা কারা? আচ্ছা দাঁড়ান সহজ করে দিচ্ছি। এদের মধ্যে একজনের একটা বিশেষ বই সম্প্রতি নিলামে উঠেছে এবং প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন ডলারে বইটির প্রথম সংস্করণ কিনে নিয়েছেন এক অজ্ঞাত ব্যক্তি!

আচ্ছা, আপনারা ভাবতে থাকুন। আমি ততক্ষণে সেই ব্যক্তির “টেলিস্কোপ নিয়ে কৃত কাজগুলাের” ব্যাপারে বলছি। তিনি সর্বপ্রথম বুঝতে পারেন যে, লেন্স ব্যবহারের কারণে টেলিস্কোপে আলাের প্রতিসরণ ঘটে। আর এ কারণে অনেক আলােকশক্তি হয় লেন্স বা অন্যান্য মাধ্যম দ্বারা শােষিত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক এই কারণে তার মাথায় টেলিস্কোপে আয়না ব্যবহারের ব্যাপারটি মাথায় আসে। বিশেষ ধরণের বক্র আয়না ব্যবহার করে টেলিস্কোপে আলাের প্রতিসরণকে কাজে না লাগিয়ে বরং প্রতিফলনকে কাজে লাগানাের মাধ্যমে যদি আলােকরশ্মিগুচ্ছকে একই ফোকাস বিন্দুতে আনা যায়, তাহলে তা পূর্বের তুলনায় আরাে বেশি স্পষ্ট প্রতিবিম্ব আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরবে। আর এ ধরনের টেলিস্কোপকেই এখন আমরা বলে থাকি “রিফ্লেক্টর বা প্রতিফলক টেলিস্কোপ” | আগেরগুলাে যেহেতু প্রতিসরণকে কাজে লাগাতাে তাই তাদের বলা হতাে ‘রিফ্রেটর বা প্রতিসারক টেলিস্কোপ” ।

ধরতে পেরেছেন, লােকটা কে? আচ্ছা যদি এখনাে ধরতে না পারেন, তাহলে আরেকটা সূত্র দিচ্ছি। এবার পারতেই হবে। ঐ বইটার নাম ছিল, ‘ফিলােসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামে….” কি? ধরে ফেলেছেন? হ্যাঁ, তার নাম আইজ্যাক নিউটন। আরেকজন যিনি এর উপর কাজ করেছিলেন তার নাম ছিল কোপার্নিকাস।

যাওয়ার আগে গ্যালিলিওর আরেকটু প্রশংসা করে যাই। যদি আপনাদের কারাে মাঝে টেলিস্কোপের প্রথম আবিষ্কর্তা নয় বলে যদি এখনাে ক্ষোভ থেকে থাকে তাই আর কি… এটা নিশ্চয়ই জানেন যে, প্রত্যেক ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দৃশ্যমান অথবা অদৃশ্যমান আলােক রশ্মির জন্য ভিন্ন ভিন্ন টেলিস্কোপ ব্যবহৃত হয়। যেমন: রেডিও টেলিস্কোপ, ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ, ইউভি (অতিবেগুনি) টেলিস্কোপ অথবা নাসার কোনাে খবরে হয়তাে শুনে থাকবেন নতুন কোনাে মহাজাগতিক রশ্মির কথা যেটা ধরতে ব্যবহৃত হয়-‘কসমিক টেলিস্কোপ”… কত ধরনের টেলিস্কোপই না রয়েছে আমাদের আশেপাশে! এছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেলিস্কোপ “হাবল টেলিস্কোপ” থেকে শুরু করে আধুনিকতম সরল বা ক্ষুদ্র টেলিস্কোপের সর্বশেষ সংস্করণটি পর্যন্ত যে বিজ্ঞানীর অবদানের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় তার নাম গ্যালিলিও।

চুপিচুপি একটা কথা বলি শােনেন, গ্যালিলিওর মৃত্যুর আগে শেষ কথা কী ছিল জানেন? – “পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘােরে”…!

তথ্য সুত্রঃ “Binocular Highlights: 99 Celestial Sights for Binocular Users” থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নেয়া।

Comments are closed.