অত্যন্ত বিষ্ময়কর আমাদের এই মহাবিশ্ব। আমাদের এ মহাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য রহস্যময় বস্তু। এর মধ্যে কিছু রহস্য আবিষ্কৃত আর বেশি ভাগ সম্পর্কে মানুষের আজও কোনো ধারণা নেই। মহাকাশের এমনি এক চমকপ্রদ রহস্যের নাম হচ্ছে নীহারিকা । ইংরেজীতে একে বলা হয় নেবুলা (Nebula). সাধারন অর্থে নীহারিকার মানে হলো মহাকাশীয় মেঘ। এই নীহারিকায় থাকে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম সহ অন্যান্য আয়োনিত গ্যাস। এছাড়া এখানে থাকে ধূলিকনা ও প্লাজমা। আর এই নীহারিকাই হলো নক্ষত্র ও তারার জন্মভূমি । এখান থেকেই জন্ম নেই এরা। এক্ষেত্রে গ্রাভিটি ধূলিকণা এবং অন্যান্য গ্যাসীয় কণাগুলো একত্রিত হয়ে ধীরে ধীরে গঠন করে নক্ষত্র এবং তারা। আজ আমরা আলোচনা করবো এই নীহারিকার ইতিহাস নিয়ে । সেই সাথে জানাবো উল্লেখযোগ্য অনেকগুলো নীহারিকার সম্পর্কে।
আমরা জানি নীহারিকা থেকে জন্ম নেয় নক্ষত্ররাশি। অনেক নীহারিকাতে দূর অতীতে নক্ষত্রের জন্ম হয়েছে আবার এখনও কোনো নীহারিকাতে নক্ষত্র তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। যেমন: ঈগল নীহারিকার (Eagle Nebula) কথাই ধরা যাক । এই নীহারিকায় যে মেঘস্তম্ভ রয়েছে তাকে নক্ষত্র সৃষ্টির আধার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। নাসার বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন “Pillars of Creation”। ঈগল নীহারিকার এই অঞ্চলে গ্যাস, মহাকাশীয় ধূলা এবং অন্যান্য উপাদান জমাট বেঁধে একটি ভারি পিণ্ডের সৃষ্ট করেছে। এই পিণ্ড ঘূর্ণায়মান অবস্থায় আশপাশের আরও বহু বস্তুকে আকর্ষণ করছে । এর ফলে ক্রমাগত এটি আরো বড় আকার ধারণ করছে। ধারণা করা হয়, এই জমাটবদ্ধ বস্তু পিণ্ড থেকে এক সময় বহু নক্ষত্র জন্ম লাভ করবে । এভাবেই এই নীহারিকায় এক সময় জন্ম নেবে গ্রহ উপগ্রহ ধূমকেতুর মতো নানা ধরনের মহাকাশীয় বস্তু।
আবার অনেক নীহারিকার সৃষ্টিও এই নক্ষত্র ও তারা থেকেই। অল্প জীবনকালের কিছু ভারী নক্ষত্রের জীবন শেষ হয় বিশাল এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এধরনের নক্ষত্রকে বলে সুপারনোভা। সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে তারার বাইরের অংশ, ধুলো, গ্যাস আর বিপুল পরিমাণ শক্তি অবমুক্ত করে। বিস্ফোরণের ফলে যে শক্তি নির্গত হয়, তা আশেপাশের গ্যাসগুলোতে আয়নিত করে ফেলে। তখন পুরো এলাকাটিকে উজ্জ্বল দেখায়। এভাবে সুপারনোভার ধ্বংসস্তুপ থেকে জন্ম হয় এই নীহারিকার।
১৫০ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত গ্রীক জ্যোতির্বিদ ক্লডিয়াস টলেমি তার ‘আলমাজেস্ট’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, তিনি পাঁচটি আবছা তারা দেখতে পেয়েছেন। তিনি এও লিখেছিলেন, উরসা মেজর এবং লিও নক্ষত্রমণ্ডলীর মাঝখানে তারাবিহীন একটি মেঘাচ্ছন্ন এলাকা দেখেছেন। সর্বপ্রথম সত্যিকারের নীহারিকার কথা উল্লেখ করেন অবশ্য পার্সিয়ান জ্যোতির্বিদ আব্দুর রহমান আল-সুফী। তিনি এন্ড্রোমিডা ছায়াপথের কাছেই একটা মেঘাচ্ছন্ন অঞ্চল দেখতে পান। ১৬১০ সালে ফরাসী জ্যোতির্বিদ পেইরেস্ক টেলিস্কোপ ব্যবহার করে কালপুরুষ নীহারিকা আবিষ্কার করেন। ১৭১৫ সালে এডমন্ড হ্যালি তার দেখা ছয়টি নীহারিকার কথা উল্লেখ করেন। এরপর ধীরে ধীড়ে বিভিন্ন জ্যোতির্বিদের অবদানে আবিষ্কৃত নীহারিকার সংখ্যা বেড়ে চলছিল। এ সংখ্যা আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় উইলিয়াম হার্শেল আর তার বোনের পর্যবেক্ষণের ফলে। এভাবে হাজার খানেক নীহারিকার দেখা পাওয়া যায়। তবে তখনো পুরোপুরি জানা ছিল না নীহারিকা আসলে কী, তারার সাথে এদের সম্পর্ক কী।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল এবং স্লাইফার অনেক নীহারিকা এবং তারার বর্ণালী সংগ্রহ করেন এবং তা পর্যবেক্ষণ করেন। ১৯২২ সালে গবেষণালব্ধ তথ্যের উপর ভিত্তি করে হাবল ঘোষণা দেন যে, নীহারিকা আসলে তারার সাথে সম্পর্কিত। এদের আলো তারা থেকেই আসে। হাবলের ঘোষণার পর সব বিতর্কের অবসান ঘটে।
আমাদের প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমাদের ছায়াপথ আকাশগঙ্গা বা মিল্কিওয়ের বাহিরের সব ছায়াপথকে নীহারিকা মনে করত। তবে প্রযুক্তির প্রসারণ ও পরবর্তীতে শক্তিশালী টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা পাল্টে যায় ও তারা পর্যবেক্ষন করেন আমাদের প্রতিবেশি ছায়াপথ গুলো নীহারিকা নয়।
ফরাসী জ্যের্তিবিদ চার্লস মেসিয়ার যার গবেষণার ষয় ছিল ধূমকেতু। এই ধূমকেতু বিষয়ে তার গবেষণার সন্দেহ দুর করার জন্য তিনি নীহারিকাদের একটি তালিকা তৈরী করেছিলেন।তার তালিকায় তিনি ১০৩ টি নীহারিকার বর্ণনা দিয়েছেন।যে গুলো বর্তমানে এম (M) অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয়।(পরবর্তীতে আরো অনেক নতুন তালিকা তৈরী করা হয়েছে, যেমন এন জি সি (NGC), কল্ডওয়েল ক্যাটালগ ইত্যাদি)।
বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে এই নীহারিকাগুলো বিভিন্ন রকমের আকার-আকৃতি আর রঙয়ের হয়ে থাকে। মহাশূন্যে দেখা পাওয়া নীহারিকাদের সবচেয়ে সহজলভ্য তিনটি আকার হচ্ছে- গোলাকার, ডিম্বাকার, আর বাইপোলার ।
এর মধ্যে সবগুলোই আমাদের ছায়াপথের নীহারিকা নয়,অন্য ছায়াপথের নীহারিকাও রয়েছে। হাইড্রোজেন গ্যাস ও মহাজাগতিক ধূলিকনা দিয়ে গঠিত এই নিহারিকারা দুটি শ্রেনীতে ভাগ হয়ে যায়।
এর একটি হচ্ছে নিক্ষিপ্ত (Defuse) বা নির্গত নীহারিকা অন্যটি হচ্ছে প্রতিবিম্ব (Reflection) নীহারিকা। আবার এর মধ্যে দুই রকমের নীহারিকা আছে যা সরাসরি মৃত তারাদের সাথে সম্পর্ক যুক্ত,এর একটি গ্রহ নীহারিকা (Planetary nebula) এবং অন্যটি সুপারনোভাজাত নীহারিকা (Super Nova)।এছাড়াও আছে অন্ধকার নীহারিকা।
আমরা এখন প্রধান ভাগে বিভক্ত নীহারিকাসমূহ সহ আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নীহারিকার কথা আলোচনা করবো।
১। কালপুরুষ নীহারিকা (Orion Nebula):
একটি অতিপরিচিত নক্ষত্রমণ্ডল। এ নক্ষত্রমন্ডলে অবস্থিত নীহারিকাই কালপুরুষ নীহারিকা। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে কালপুরুষ বিষ্ণুর ঔরসে মায়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। [উত্তরকাণ্ড, চতুরধিকশততম, বাল্মীকি রামায়ণ]। সুমেরীয়রা কালপুরুষকে একটি জাহাজ হিসেবে কল্পনা করত। প্রাচীন চীনে এটি ছিল রাশিচক্রের ২৮টি রাশির একটি। এর প্রতীক ছিল Xiu। এই রাশিটি সেখানে শেন (তিন) নামে পরিচিত। কালপুরুষের কোমরবন্ধের তিনটি তারা দেখেই তারা এই নামকরণ করেছিল।
এটি মেঘ, গ্যাস ও ধূলিকর্ণা দ্বারা গঠিত মিল্কিওয়ের দক্ষিনে অবস্থিত বিকীর্ণ নীহারিকা যা অন্যতম উজ্জ্বল নীহারিকা। কালপুরুষ রাতের আকাশে খালি চোখে দেখা যায়। এর অবস্থান ১৩৪৪+/-২০ আলোকবর্ষ দূরে। এটি পৃথিবীর নিকটবর্তী বড় তারা গঠন অঞ্চলে অবস্থিত। এই নীহারিকা অনুমান করা হয়েছে ২৪ আলোকবর্ষ জুড়ে। কালপুরুষ নীহারিকাটি রাতের আকাশে সর্বোচ্চ যাচাইকৃত। তারা ও পৃথিবীর গঠন সম্পর্কে কালপুরুষ নীহারিকা অনেক তথ্য প্রকাশে সহায়তা করেছে। ১৬১০ সালে এটি আবিষ্কারের পর ফেহান ব্যস্পটিস্ট নামক এক ব্যক্তি ১৬১৮ সালে এটি পর্যবেক্ষণ করেন ও এই নীহারিকা সম্পর্কে ১৬৫৯ সালে পুরোপুরি তথ্য জানা যায়। ক্রিশ্চিয়ান হওজেন নামক আরেক জ্যোতিবিদ এই সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করেন। এর আগে পুরাতন গ্রন্থ গুলোতে কালপুরুষ নীহারিকাকে “গ্রেট নীহারিকা” বা “গ্রেট কালপুরুষ নীহারিকা” বলা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় নীহারিকা সম্পর্কে আমাদের ধারণা প্রাচীন।
২। গ্রহান্বিত নীহারিকা (Planetary Nebula):
এটি এক গ্যসীয় নীহারিকা। কোনো তারা শ্বেত বামন তারা হওয়ার ঠিক আগে লোহিত দানবে পরিনত হয়। এই লোহিত দানব তারাই তার বহির্ভাগ মহাকাশে নিক্ষেপ করে, আর অন্তর্ভাগ সংকুচিত হয়ে শ্বেত বামন গঠন করে। মহাকাশে নিক্ষিপ্ত ঐ গ্যাসই গ্রহ নীহারিকা গঠন করে। গ্রহ নীহারিকা আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমে অনেক রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে। ছায়াপথের রাসায়নিক গঠন ও বিবর্তন বিষয়ে ধারণা পাওয়া এর অধ্যায়ন জরুরি।এছাড়াও অন্য ছায়াপথের তথ্য লাভের ক্ষেত্রে এদের অবদান অনস্বীকার্য। এটি প্রথম ১৭৬৪ সালে চার্লস মেসিয়র পর্যবেক্ষণ করেন ও এম ২৭ তালিকাভূক্ত করেন পরে ১৭৮০ সালে উইলিয়াম হার্শেল তার টেলিস্কোপে এটি অবিষ্কার করেন। এই নীহারিকাটি অনেরটাই ইউরেনাস গ্রহের অনুরূপ। তাই এটিকে গ্রহান্বিত নীহারিকা বলা হয়ে থাকে।
৩। প্রাক্-গ্রহান্বিত নীহারিকা (Protoplanetary nebula) :
কোনো প্রধান ধারার নক্ষত্র যখন ক্রম বিবর্তনের মধ্য দিয়ে শ্বেত বামনে পরিণত হয়, তখন যে অন্তর্বর্তী সময়ে এই জাতীয় নীহারিকার সৃষ্টি হয়। যখন কোনো নক্ষত্র তার জীবনকাল শেষ করে, তখন নক্ষত্র প্রচুর পরিমাণ ভর হারায়। এর ফলে নক্ষত্রের বাইরের হাইড্রোজেন খোলস হাল্কা হয়ে যায়। একসময় এই নক্ষত্র হাইড্রোজোনের খোলস মুক্ত হয়ে নগ্ন হয়ে যায়। এই অবস্থায় নক্ষত্রকে ঘিরে হাইড্রোজনের হাল্কা কুয়াশা থেকে যায়। নক্ষত্রের এই দশাতে দূর থেকে কুয়াশাঘন আবরণের ভিতর দিয়ে নক্ষত্রকে রঙিন দেখায়। নক্ষত্রের দশাকেই প্রাক্-গ্রহান্বিত নীহারিকা বলা হয়।
৪। সুপারনোভাজাত নীহারিকা( Supernova remnant Nebula):
অল্প জীবনকালের কিছু ভারী নক্ষত্রের জীবন শেষ হয় বিশাল এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এধরনের নক্ষত্রকে বলে সুপারনোভা। সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে তারার বাইরের অংশ, ধুলো, গ্যাস আর বিপুল পরিমাণ শক্তি অবমুক্ত করে। বিস্ফোরণের ফলে যে শক্তি নির্গত হয়, তা আশেপাশের গ্যাসগুলোতে আয়নিত করে ফেলে। তখন পুরো এলাকাটিকে উজ্জ্বল দেখায়। এভাবে সুপারনোভার ধ্বংসস্তুপ থেকে জন্ম হয় এই নীহারিকার।
৫। অন্ধকার নীহারিকা (Dark nebula) :
এই নীহারিকার অন্ধকার মেঘ কোনো আলো বিকিরণ করে না। ঘনত্ব বেশি হবার কারণে এদের পেছনের দিকের নক্ষত্র থেকে আলো আসতে পারে না। আলোকে আটকে দিয়ে অন্ধকার করে রাখে বলেই এই নাম। এই নীহারিকাগুলোর নামও মজার। যেমন- সাপের আকৃতিধারী স্নেক নীহারিকা। আরও আছে ঘোড়ার মাথার মতো দেখতে হর্সহেড নীহারিকা।
৬। কাঁকড়া নিহারিকা (Crab Nebula):
এটি সুপারনোভাজাত নীহারিকার অন্তর্গত। সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে জন্ম লাভ করে এই নিহারিকা। সর্বপ্রথম ১০৫৮ সালে চীন দেশে এর দেখা পাওয়া যায়। এর বিস্ফোরিত নক্ষত্রটির (Supernova)দূরত্ব মাত্র ৫ হাজার আলোকবর্ষ।এর উজ্জ্বলতা ছিলো অনেক বেশি। সুপারনোভা হওয়ার পরেও বহু মাস ধরে একে খালি চোখে দেখা গিয়েছিল। এটি এতো বেশি উজ্জ্বল ছিল যে দিনের বেলায়ও একে দেখা যেত। রাতের বেলায় এর আলোতে বই পড়া যেত।
বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন এটি যদি এর দশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ৫০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকতো তবে এটি আরো ১০০ গুণ বেশি উজ্জ্বল হতো। তখন রাত আর দিনের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকতো না। এই বিস্ফোরনের তীব্রতা পৃথিবীতে আলো প্রদানের ক্ষেত্রে সূর্যের সাথে পাল্লা দিতে পারতো, যদিও সূর্য এর চেয়ে কোটি কোটি গুণ কাছে।
তবে এটি যদি কাছে থাকতো তাহলে তা প্রানীজগতের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরুপ হয়ে দেখা দিতো কারণ এর বিকিরণের কারণে সব প্রাণী ধ্বংস হয়ে যেত।
৭। রিং নিহারিকা (Ring Nebula বা M57 বা NGC 6720) ঃ
এই রিং নীহারিকার চারিদিকের বলয় থাকে যা একধরণের ফাস্টফুড ডোনাটের মত দেখতে। এটি গ্রহান্বিত শ্রেণীর নীহারিকা (Planetary nebula) যা পৃথিবী থেকে ২৩০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এটি বীণা নক্ষত্রমণ্ডলে (constellation of Lyra) অবস্থান করছে। জেলিভর্তি ডোনাটের মত দেখতে নীহারিকাটির কেন্দ্রে একটি শ্বেত বামন তারকা অবস্থান করছে।
৮। বুমেরাং নীহারিকা (Boomerang Nebula):
বুমেরাং অর্থ বাঁকা তীর বা ক্ষেপণাস্ত্র। এটি একটি প্লেটোপ্লানেটারি নীহারিকা যা পৃথিবী থেকে ৫,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এর অবস্থান সেন্টারাস নক্ষত্রমন্ডলে। একে বোটাই নীহারিকাও বলা হয়ে থাকে। এটিকে একটি নক্ষত্র ব্যবস্হা হিসেবে ধরা হয় যা প্লানেটারি অবস্হায় গ্রহের দশার চতুর্দিকে পাক খাচ্ছে। এর অভ্যন্তরীন গ্যাসের নিঃসরণের ফলে এর গঠন প্রক্রিয়া চলছে যেখানে একটি নক্ষত্র পরবর্তী জীবনে ভর হারিয়ে আলো বিকিরিত করতে থাকে। এই গ্যাসের বহির্গমনের বেগ প্রায় ১৬৪ কিমি/সেকেন্ড এবং ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে কারণ তা মহাশূন্যে হারিয়ে যাচ্ছে; এই গ্যাসের বহির্গমনই নীহারিকার এত কম তাপমাত্রা কারণ। ১৯৮০ সালে জ্যোতিবিদ কেইথ টেইলর ও মাইক স্কারট অ্যাংলো-অস্ট্রেলীয় নভোবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে একে পর্যবেক্ষণপূর্বক “বুমেরাং নীহারিকা” নাম দেন। ১৯৯৮ সালে যখন হাবল টেলিস্কোপ ব্যবহার করে একে দেখা হয় তখন একে আরো পরিষ্কার দেখা যায় এবং তখন একে অনেকটা প্রতিসম বালিঘড়ি আকৃতির ন্যায় দেখায়। বুমেরাং নীহারিকার দৃশ্যমান দ্বৈত লোব একটি বৃহৎ ঠান্ডা গ্যাসের বর্তুল ভলিউম দ্বারা বেষ্টিত যা কেবল সাব-মিলিমিটার রেডিও তরঙ্গদৈর্ঘ্য ব্যবহার করেই দেখা যায়। কেন্দ্রের তারার আলো নীহারিকার ধূলিকনার উপরে প্রতিফলিত হয়ে আলোকিত হয়ে উঠে। এটি এই পর্যন্ত জানা সবচেয়ে দুরের শীতলতম স্থান।
৯। ক্যাট্স-আই নীহারিকা (Cat’s eye Nebula):
ক্যাট্স-আই নীহারিকা দেখতে বিড়ালের চোখের মতো। এটি ড্রেকো তারামন্ডলে অবস্থিত। এটি পৃথিবী থেকে ৩২৬২ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এর ব্যাসার্ধ প্রায় ০.২ আলোকবর্ষ।
১০। হেলিক্স নীহারিকা (Helix Nebula):

হেলিক্স নীহারিকার অবস্থান পৃথিবী থেকে প্রায় ৭০০ আলোকবর্ষ দূরে। এই নীহারিকা “আই অব গড” নামে পরিচিত। এই নীহারিকার বয়স ৯৪০০ থেকে ১২,৯০০ বছর। ২.৮৭ আলোক বর্ষ ব্যসার্ধের এই নীহারিকা ভেতরের অংশ সেকেন্ডে ৪০ কিমি ও বাইরের অংশ সেকেন্ডে ৩২ কি.মি হারে প্রসারিত হচ্ছে। ১৮২৪ সালে জ্যোতিবিদ কার্ল লুডিগ হারডিং এই নীহারিকা আবিষ্কার করেন।
১১। ভেইল নীহারিকা(Veil Nebula) :
ভেইল নিহারিকা(Veil Nebula) ১৪৭০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত । এটি বকমণ্ডলে(constellation Cygnus) অবস্থিত সুপারনোভা অবশেষ ।এই উত্তপ্ত ও আয়নায়িত ধূলা ও গ্যাসের মেঘটিকে স্যার উইলিয়াম হার্শেল ১৭৮৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আবিস্কার করেন। এটি আট হাজার বছর পূর্বে(খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ এর মধ্যে) বিস্ফোরিত একটি সুপারনোভার অবশিষ্টাংশ যা বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। বিস্ফোরিত হওয়ার পূর্বে এর যে মাতৃনক্ষত্রটি ছিল তা সূর্যের চাইতে ২০ গুন বড়। বিশালতায় ১১০ আলোকবর্ষের এই নীহারিকাটি যখন বিস্ফোরিত হয়েছিল তখন পৃথিবীর আকাশে অর্ধচন্দ্রের সমান জায়গা জুড়ে ছিল এবং উজ্জ্বলতায় প্রায় চাঁদের মতই ছিল । তবে নাক্ষত্রিক ঝড়ের জন্য এটি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। নাসার হাবল টেলিস্কোপের মাধ্যমে পাওয়া ছবি থেকে বিকিরণ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা অক্সিজেন,সালফার এবং হাইড্রোজেন এর অস্তিত্ব পেয়েছেন।এক্স-রের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণে আকাশের অনেকটা জুড়ে (৫ টি পূর্ণ চন্দ্রের সমান স্থান) নিহারিকাটিকে দেখা যায়।
১২। ঘোড়ামুখি নীহারিকা বা (Horsehead Nebula বা Barnard 33) ঃ
এখন কথা বলা যাক ঘোড়ামুখি নিহারিকা নিয়ে। ঘোড়ামুখি নিহারিকা বা Horsehead Nebula(Barnard 33) হল পৃথিবী থেকে ১৫০০ আলোকবর্ষ দূরে কালপুরুষ নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত। শ্রেনীবিভাগ অনুসারে এটি একটি ডার্ক নেবুলা বা অন্ধকারাচ্ছন্ন নীহারিকা। রাতের আকাশে ছোটখাটো টেলিস্কোপেই একে দেখা যায় এবং খুজে পাওয়া সবচাইতে সহজ বিধায় নতুন জ্যোতির্বিদদের নিকটে এই নিহারিকা খুবই জনপ্রিয় ।
১৩। লেগুন নীহারিকা (Lagoon Nebula):
এম৮ তালিকাবদ্ধ ধনু নক্ষত্রমন্ডলীতে অবস্থিত একটি জায়ান্ট ইন্টারস্টেলার মেঘ। এটি ৪১০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত ও ৫৫×২০ আলোকবর্ষ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট। লেগুন নীহারিকা ১৬৫৪ সালে জ্যোতিবিজ্ঞানী জিওভান্নি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন। এই নীহারিকাটি খালি চোখে পর্যবেক্ষণ করা যায়। আকাশের মধ্য-উত্তর অক্ষে তাকালে এই নীহারিকাটি দেখা যায়। টেলিস্কোপে এর আকার অনেকটা ডিম্বাকৃতির। পৃথিবীর আকাশে ৯০’ থেকে ৪০’ পর্যন্ত বিস্তৃতি পরিলক্ষিত হয় যা থেকে বোঝা যায় এর অবস্থান মোটামুটি ১১০ থেকে ৫০ আলোকবর্ষ পর্যন্ত। মানুষের চোখ এই রঙের প্রতি খুব কম সংবেদনশীল হওয়ায় টেলিস্কোপ বা বাইনোকুলার দিয়ে পর্যবেক্ষ করলে নীহারিকাটি ধূসর দেখায়।
১৪। ক্যারিনা নীহারিকা (carina nebula/NGC 3324):
ক্যারিনা নীহারিকা(carina nebula/NGC 3324) পৃথিবী থেকে ৭৫০০ আলোকবর্ষ দূরে ক্যারিনা নক্ষত্রমণ্ডলে (constellation carina) অবস্থিত। এটি একটি বিকীর্ণ নীহারিকা (diffusive nebula)। এটি আকাশগঙ্গার ক্যারিনা-ধনু বাহুতে(carina-sagittarius arm) অবস্থান করছে। কালো ধূসর এই নীহারিকাটির মাঝে বর্তমানে নতুন নক্ষত্রের জন্ম ও বিকাশ ঘটছে। নীহারিকাটিতে বেশ কয়েকটি দানব অত্যুজ্জ্বল শ্রেণীর নক্ষত্রদের খোলা গুচ্ছ(open cluster) অবস্থান করছে। আকাশগঙ্গার অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র WR 25 সহ Eta Carinae,HD 93129A. Trumpler 15, Collinder 228, Collinder 232, NGC 3324,NGC 3293 নামের O2 শ্রেণীর দানব নক্ষত্রগুলি এই সকল গুছে অবস্থান করছে। এই সকল নক্ষত্রদের বেশীরভাগের বয়সই অর্ধ মিলিয়ন বছরের কম । অর্থাৎ নক্ষত্র গুলি এখন কেবল শিশুদশা পার করছে।
অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুদের তুলনায় নীহারিকাদের জীবনকাল খুব ছোট হয়ে থাকে, যেটা সাধারণত ১০০০০ বছরের কাছাকাছি। এ কারণেই এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ডাটাবেইসে মাত্র ৩০০০ এর মতো নীহারিকার রেকর্ড আছে। ক্রমান্বয়ে নীহারিকার মাঝে থাকা Red Giant Star এর আয়নিত গ্যাসের মেঘ ঠাণ্ডা হয়ে যায় আর সেই নক্ষত্রটি ধীরে ধীরে ব্ল্যাক হোলে হয়। তখন সে আর আলো ছড়ায় না। তাই তাকে আর দেখাও যায় না।