“সুন্দরবনে বাঘ থাকবে না?
তাতে আমার কি?”
“গাছের ঝাড়ে দোয়েল – শালিক ডাকবে না?
তাতে আমার কি?”
“খালেবিলে বক আর ডাহুকের দেখা মিলবে না?
তাতে আমার কি?”
“নদীতে কুমির – শুশুক থাকবেনা?
তাতেই বা আমার কি?”
“সাগর – মহাসাগরে হাঙর – তিমি – ডলফিনেদের দেখা মিলবে না?
আরে ভাই তাতেই বা আমার কি?”
এমন উদ্ভট, বিদঘুটে প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন। অনেক সময়তো পড়াশোনা করা, ডিগ্রিধারী অনেক “শিক্ষিত” ব্যক্তিরাও এমন প্রশ্ন তুলে বসেন! বিশেষ করে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মত যারা সাবলীলভাবে প্রকৃতিকে ভালবাসেন, তাদের অনেকেই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন জীবনে হয়েছেন বা হয়ে থাকেন।
কিন্তু আসলেই কি এসবে আমাদের কিছুই আসে যায়না?
এইযে জীববৈচিত্র বা Biodiversity, এর কি আসলেই কোনো প্রয়োজন, কোনো সম্পৃক্ততা নেই আমাদের সাথে?
আসলেই কি এমন সব বিদঘুটে প্রশ্নের কোনোই সদুত্তর নেই!
শুনতে যেমনই লাগুক না কেনো কিন্তু সদুত্তর আছে। খুব ভালভাবেই আছে। আর ঐযে যেসব ডিগ্রীধারি বা কথিত শিক্ষিতেরা এমন সব প্রশ্ন করেন তাদের ক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর বিখ্যাত উক্তিই বুঝি যুৎসই, “সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত।”
কেউ সুশিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, জীববৈচিত্রের প্রয়োজন অস্বীকার করাটা সবক্ষেত্রেই সীমিত জ্ঞান দ্বারা Ecosystem বা বাস্তুসংস্থানের মত একটা বিশাল আর জটিল ব্যাপারে যাচাই বাছাই ছাড়াই মন্তব্য করে দেয়ার মত বটে। কেনো দরকার আর কিই বা এই জীববৈচিত্রের অবদান সে নিয়েই আমাদের আজকের এই আলোচনা।
জীববৈচিত্র্য বা বায়োডাইভার্সিটি এর প্রয়োজনীয়তা, আর সম্পৃক্ততা কোথায়, তা জানার আর বুঝার জন্যেই অবশ্যই প্রথমত আমাদের বাস্তুসংস্থানের ব্যাপারে জানা উচিত। মজার ব্যাপার হল, আমাদের দেশে বাস্তুসংস্থানের পাঠ সেই স্কুলবেলা থেকেই দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে স্বশিক্ষিত করে গড়ে তোলার চাইতে উচ্চ নাম্বার আর গ্রেডপয়েন্ট যুক্ত সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। ফলে এরাই পরিপক্ক বয়সে গিয়ে “জীববৈচিত্রের কি প্রয়োজন” জাতীয় উক্তি দিয়ে থাকে।
তো যাই হোক, বাস্তুসংস্থানের পুরো ব্যাপারটা একটা food chain বা খাদ্যশৃঙখলা দ্বারা সম্পৃক্ত এটা আমরা অনেকেই জানি কমবেশি। অণুজীবেরা ফসল আর ক্ষুদে উদ্ভিদ উৎপন্ন করাতে সাহায্য করবে আর সেই ফসল আর ক্ষুদে উদ্ভিদ খাবে যথাক্রমে তৃণভোজী আর অন্যান্য নিম্নশ্রেণীর খাদকেরা যাদের মাঝে অনেক কীটপতঙ্গও রয়েছে। আবার তাদের খাবে পাখিরা, ও অন্যান্য জীবেরা যাদের খাবে নখরযুক্ত শিকারি পাখি (Raptor) আর হরিণ ও অন্যান্য তৃণভোজীদের খাবে বাঘ, সিংহ, নেকড়ের মত অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীরা। এরা হচ্ছে উচ্চ শ্রেণীর খাদক।
আর আমরা?
আমরা গড়পড়তা হারে মিশ্রভোজী বা Omnivorous জাতি যাদের ঘাসপালাও লাগে আবার প্রোটিন বা আমিষের উৎসের জন্যে গরু, ছাগল, মাছ, মুরগীও লাগে। এইযে এই ফুডচেইন বা খাদ্যশৃঙখলা, এর উপর গোটা বাস্তুসংস্থান টিকে আছে। এমনকি যে গাছ সব ভুচর প্রাণীদের অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে তারাও অনেকাংশে টিকে আছে এই ফুডচেইনের উপর! দ্বিতীয় কথা হল এই ফুডচেইন দেখতে একহারা মনে হলেও তা আসলে একহারা না। এটা অনেকটা এমন যে A, B, C, D চারটা প্রাণী চারটা উৎসের উপর টিকে আছে। আবার সেই চারটা প্রাণীর উপর টিকে আছে P, Q, R, S। আবার তাদের উপরে Top Chain এ আছে W, X, Y, Z। এই A, B, C, D আবার একে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। ঠিক তেমনে অন্যান্য স্তরের প্রাণীগুলোও একে অন্যের সাথে আবার নীচে স্তরের ভিন্ন ভিন্ন একাধিক প্রাণীর সাথেও সম্পৃক্ত রয়েছে। যার ফলে গোটা চেইন টা একটা Complex Chain এর রূপ নিয়েছে। এদের মধ্যে বহু পাখি আর কীটপতঙ্গ রয়েছে যেগুলো ফুলের পরাগায়ন সহ উদ্ভিদের অযৌন প্রক্রিয়ায় বংশবিস্তারে একদম সরাসরি সহায়তা করে। পাখিরাতো অসংখ্য, অগণিত বীজ এভাবে বয়ে নিয়ে গিয়ে ছড়িয়ে দেয় বিভিন্ন প্রান্তে! এমনকি কিছু বীজ খাবারের মাধ্যমে পাখির পরিপাক ক্রিয়া হয়ে যাবার ফলে তাদের অঙ্কুরোদগম বা Germination খুব সহজ হয়ে যায়! একই রকম কাজ হয় যখন পাখি কোনো বীজওয়ালা খাবারের শক্ত খোসা ভেঙে ফেলে কোথাও ফেলে দেয়ম। ফলে আমাদের অজান্তেই পাখি আর কীটপতঙ্গেরা গাছপালার বংশবিস্তারে বিস্তৃত আর অপরিহার্য অবদান রাখে! কেননা অযৌন প্রক্রিয়ায় বংশবিস্তারের জন্যে কিন্তু কোনো না কোনো প্রাণীর দরকার পড়বেই!
এইযে কীটপতঙ্গ, এগুলো আবার এইসব পাখির Food Source বা খাদ্যের উৎস। সেই সাথে এরা ব্যাঙ, টিকটিকি ইত্যাদি প্রাণীরও খাবারের উৎস। এখন দেখা গেল পাখি, ব্যাঙ, টিকটিকি সহ অন্যান্য প্রাণীরা যদি এদের খেয়ে কীটপতঙ্গের সংখ্যায় একটা ভারসাম্য বজায় না রাখে তখন তা হানা দিবে ফসল আর ঘাসপালার উপর! তারা ফলমূল থেকে শুরু করে পাতা, ঘাস এমনকি ধানেতেও প্রভাব ফেলবে! শুধুই কি তাই? সাথে বয়ে নিয়ে বেড়াবে অনেক রোগবালাই। এখনি আমরা কীটপতঙ্গ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে আগেপিছে না দেখে কীটনাশক ব্যবহার করি, তখন কি করবো ভেবে দেখেছেন? ফসল খাবো না সামলাবো বা বাড়তে দিবো? নাকি পতঙ্গের হাত থেকে বাঁচতে উড়াধুড়া কীটনাশক ব্যবহার করবো? ফলে আমাদের মাঝে বাড়বে আরো নিত্যনতুন রোগবালাই!
তখন আবার রোগবালাই, মহামারি এগুলা সামলাবো নাকি খাবারের জোগান দিবো?!
কি বিচ্ছিরি অবস্থা তাইনা?
অবস্থা আসলে যতটুকু বলেছি তার চাইতেও বহু বহুগুণে বিচ্ছিরি হয়ে যাবে।
এ তো গেল কেবল একদিক! এখন উলটো ভাবি? পাখি, ব্যাঙ, সাপ এগুলো ঠিক আছে। কিন্তু কীটপতঙ্গ নেই!
তখন আবার ঐসব খাদকের খাবারে দেখা দিবে শর্টেজ! ফলে তারা অন্য কোনো উপায় খোঁজার চেষ্টা করবে। তা করতে গিয়ে তাদের মাইগ্রেশন হবে যেমন, তেমনি বহু ছোট ছোট প্রাণী মারা পড়বে! ছড়াবে মহামারি! সবচে বাজে অবস্থা হবে গাছপালার! এদের অনেক প্রজাতিই সঠিক অঙ্কুরিত হতে না পেরে, ছড়াতে না পেরে সংখ্যায় কমে আসবে। দেখা দিবে বনায়নে ঘাটতি! আর বনায়নে ঘাটতি মানে এর সাথে সম্পৃক্ত জীবজগতের ঘাটতি। আবার একই সাথে জীবের জন্যে পর্যাপ্ত অক্সিজেনেরো ঘাটতি! কোনটা ছেড়ে কোনটা সামলাবে তখন মানুষ?

ফার্মিং করা শুরু করবে? কতদুর আর? উৎপাদনের তুলনায় প্রয়োজনের চাপ অনেক বেশি থাকবে। সেই সাথে পরিবেশ তার বসবাসযোগ্যতা বা Habitability হারাবে! আর ঐদিকে অপরদিক থেকে মানুষ তো দেদারসে কার্বন এমিশন করছেই! মানে সব মিলিয়ে “মরার উপর খাড়ার ঘাঁ” এর মত হয়ে দাড়াবে ব্যাপারটা!
শুধু কি তাই? আমরা ইতোমধ্যেই জানি GM বা Genetically Modified খাদ্য আমাদের দেহে প্রচুর পরিমাণে বিরুপ প্রভাব ফেলে। শুধু প্রোটিন সোর্সই নয়। আটা, ময়দা, গম, ধান, সুজি থেকে শুরু করে অগণিত রকমের সবজির উৎপাদন ভারসাম্যহীনতার কারণে বন্ধ হয়ে যাবে! আমাদের খাবারের তালিকা থেকে যে বহু মুখরোচক খাবার উঠে যাবে কেবল তা নয়! আমাদের দেহের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্যে অনেক উপাদান পর্যন্ত আমরা পাবো না। ফলে দেখা দিবে নিত্য নতুন রোগ। গণহারে ফুটে উঠবে, অহরই একে ওকে আক্রান্ত হতে দেখা যাবে যতসব দুর্লভ রোগেতে।
ঠিক যেমনটা এখন টিউমার আর ক্যান্সার কোষের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে দেখা দেয়!
আর্থসামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে বিবেচনা করলে দেশগুলোর কৃষিজ খাতে ধ্বস নামার ফলে একে জিনিষের দাম বেড়ে আকাশ ছুঁই ছুঁই করবে! দেখা দিবে অভাব। অভাব মেটাতে বাড়বে অপরাধ, চুর, ডাকাতি, খুন!
কোন টা ছেড়ে কোনটা সামলাবে তখন এই অত সভ্য মানবসভ্যতা?!
এখন যদি উচ্চপর্যায়ের খাদকের কথা ধরি তাহলে এক কথায় বলবো তারা ঐ নিম্নস্তর আর মধ্যস্তর ঐ দুই স্তরের খাদকের মাঝে এক অকল্পনীয় রকমের ভারসাম্য বজায় রাখে। সেটা কেউ মানুক বা না মেনে মঙ্গল গ্রহে চলে যাক! তাতে বাস্তবতার কিছুই যায় – আসে না!

এখন বলবেন মাছ শিকার?
সেটেশান (Cetacean) বা জলজ স্তন্যপায়ী শিকার?
“আরে… তাতেতো কিছুই যায় আসেনা! সমুদ্র বিশাল!”
জ্বী ভাই ও বোনেরা, যায় আসে। কেউ না জানলে যে যাবে আসবেনা তা না।
উপরের ভাগে যেমন ফুড চেইন আছে তেমনি আছে জলজ পৃথিবীতেও। সেখানেও স্তরভেদের খাদক ভাগ করা। যাদের খাদ্যের একেবারে নিম্নস্তর Phytoplankton আর Zooplankton এ ভাগ করা।আর হাঙর হচ্ছে এদের উপরের স্তরের প্রাণী। এই হাঙরেরা এমন এক মাছের বর্গ, যারা চারশো বিশ মিলিয়ন বা বিয়াল্লিশ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে টিকে আছে। বুঝতেই পারছেন বিবর্তনের এই লম্বা ধারায় তাদেরকে নিতান্তই প্রকৃতির মিথস্ক্রিয়ায় প্রয়োজন আছে বলেই তারা হারিয়ে যায়নি! বদলেছে বহু রূপে! ফলে এদের একেক জাত দেখতে একেকরকম। যার দরুন এরা গিয়ে ফুডচেইনের উচ্চস্তরের সাথে এমন মেশা মিশেছে যে এদের বিলুপ্তি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র নয় শুধু, সামুদ্রিক অভ্যন্তরীণ বাস্তুসংস্থানে তীব্র প্রভাব ফেলবে।
এখন আসি সেই জ্ঞানীগুণী সভ্য মহলের করা “সুন্দরবনের বাঘের প্রসঙ্গে।”
এই এক সুন্দরবনের বাঘ না থাকলে কি হবে তার আগে তাদের কিছুটা হলেও মাথা খাটিয়ে ভাবা উচিত সুন্দরবনে বাঘ আছে দেখে কি হচ্ছে?
প্রথমত, বাঘ ফুড চেইনের একেবারে টপ লেভেল বা সর্বোচ্চ স্তরের খাদক। এরা হরিণ ও অন্যান্য তৃণভোজী খেয়ে বনের স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখে জানেন? এরা না থাকলে হরিণের সংখ্যাও বাড়তে পারতো বেসামালভাবে। অন্তত কিছুটা হলেও হরিণ সংখ্যার ভারসাম্যে এদের প্রভাব রয়েছে। এখন একথা শুনলে আবারো কিছু সভ্য ব্যক্তি ভাববেন “তো? হরিণ বাড়লেতো ভালই! শিকার করে খাওয়া যাবে ইচ্ছেমত!
আরে ভাই, জঙ্গল তো কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না, সেখানে ঢুকে ইচ্ছেমত শিকার করে ফুডচেইনের মাঝে হাত ঢুকাবে কেউ! দেখা যাবে Dodo পাখি, Elephant Bird আর Passenger Pigeon এর মত এদের মেরেও টেরই পাবেনা যে এরা শেষ হয়ে যাচ্ছে। পরে গিয়ে হা হুতাশ শুরু করবে। অন্যান্য কোনো কারণে মারা যাবে? যেমন পরিবেশ দূষণ? তাতে তো ক্ষতি দ্বিগুণ! বাস্তুসংস্থানের স্বাভাবিক শৃঙ্খলা যেমন ভাংছে এক্ষেত্রে তেমনিতেও পরিবেশও দূষণ হবে। আবার বেড়ে গেলে এদের খাদ্য জোগান দিতে চাপ পড়বে বনের উপর। সেই সাথে এদের দ্বারা নিঃসৃত গ্যাস পরিবেশে Green House গ্যাস এর মাত্রা বাড়াবে। এটা অবাস্তব ঠেকলেও এটাই সত্যি। আর এক্ষেত্রে বাঘের মত উচ্চস্তরের খাদকের সত্যিই ভূমিকা রয়েছে তা মানুন আর নাই মানুন!

এবার আসি আরেক ক্ষেত্রে। ভেবে দেখেছেন এই বাঘ বা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দিয়েই যে আমাদের দেশকে উপস্থাপন করা হয়? আমাদের ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের সম্মানের সাথে Tigers বলে ডাকা হয়। ফলে এই বাঘ সারাবিশ্বের কাছে আমাদের দেশের জৈববৈচিত্রকে তুলে ধরছে। যে কেউ বাংলাদেশ বললে সহজে চিনছে, “ঐযে সুন্দরবন আছে যে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে যে।”
সাথেই এটা আমাদের পর্যটন শিল্পের সাথেও জড়িত রয়েছে।
এখন ভাবুন বাঘ নেই। বিলুপ্ত হয়ে গেছে আমাদের হীনতার কারণে। সারাবিশ্বের কাছে তখন কি একটা বাজে স্বরূপ সৃষ্টি হবে আমাদের চিন্তা করা যায়? মানুষ তখন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বলবে যে এমন দুর্লভ একটা প্রাণীকেও এরা বাচাতে পারেনি! এরা আবার কেমন হবে? শুধু তাই? সুন্দরবনের দিকে পর্যটকদের, গবেষকদের গোটা একটা দলের আগ্রহ হারিয়ে যাবে। শুধু আগ্রহ না অনেকে উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ আর প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাস পর্যন্ত উঠে যাবে আমাদের দেশের উপর থেকে। তখন কিন্তু “আমাদের সব বাঘ খাবার না পেয়ে মাইগ্রেট করে ভারতে চলে গেছে” এমন খোঁড়া যুক্তি দিয়ে কোনো লাভই হবেনা। স্রেফ এই একটা প্রাণীর কারণে আমরা অনেক দিক দিয়েই হেয় হবো। সাথে তা বাস্তুসংস্থানের উপর তো প্রভাব ফেলবেই!

এতকিছু বাদ দিলেও আরেকটা ব্যাপারে এখন আসি। সেটা হল চিকিৎসা আর গবেষণা খাত। পৃথিবীতে পরিচিত গাছপালা দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার (২৫০,০০০) প্রজাতি রয়েছে। যার থেকে কেবলমাত্র পাঁচ হাজার (৫,০০০) প্রজাতিই চিকিৎসা ও মেডিকেল উদ্দেশ্যে অধ্যয়ন ও গবেষণা করে খতিয়ে দেখা হয়েছে। বাকিগুলো তো বাদই দিলাম!
এ তো গেল স্রেফ গাছের কথা। আমরা যে এই সব ফার্মিং করা গবাদি পশুপাখি আর মাছ – চিংড়ি খাই, এগুলো কোথা থেকে এসেছে?
আমরাই বানিয়েছি?
ল্যাবরেটরিতে?
নাকি কোনো পারমাণবিক চুল্লিতে ফেলে দিয়ে?
এগুলো কিন্তু আমরা পেয়েছি এই পরিবেশ থেকেই। এই জীববৈচিত্রতার জন্যেই আমরা একেক প্রাণীর মাঝে একেকরকম খাদ্য উপাদান পাই। শরীর বানাতে, ক্ষয়রোধে যেমন মাংস কাজে দেয়, তেমনি বিভিন্ন অপুষ্টির জন্যে অনেকে বলে “বেশি করে ছোট মাছ খান। মলা ঢেলা খান।”
শুধু কি তাই? এরা যে শুধু আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে তা নয়। এদের দেহের উপাদান, এনজাইম, বিভিন্ন প্রোটিন গঠণ আমাদের নানারকম রোগবালাইয়ের ক্ষেত্রে কাজে দেয়। এগুলোর উপরে প্রতিনিয়ত আমরা গবেষণা করেই যাচ্ছি, অনুপ্রাণিত হয়েই যাচ্ছি আর ক্রমাগত নতুন কিছু না কিছু শিখেই যাচ্ছি। প্রাণীকুল, আর এর জীববৈচিত্র এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি। এই বৈচিত্রতা পুরো সিস্টেমটার প্রয়োজনে সময়ে সময়ে নিজেকে হাজার হাজার, লাখ লাখ ভেরিয়েশন আর ভেরিয়্যান্ট এ ঢেলে দিয়ে বহু যাচাই বাছাই, অভিযোজন এর মধ্যে দিয়ে প্রতিটা জায়গায় প্রয়োজনমত স্থাপিত হয়েছে। ফলে এইযে জীববৈচিত্র দেখতে পান, তা প্রকৃতির কোনো নিছক খামখেয়ালি নয়, প্রতিটা প্রাণী গোটা বাস্তুসংস্থান আর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে ঐ একই Gene এর বহু বহু রকমের এদিক সেদিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রয়োজনমাফিক ভিন্ন ভিন্ন রূপে ঢেলে নিজেকে সাজিয়েছে। কখনো বাটারফ্লাই ইফেক্ট এর কথা শুনেছেন? মুভি না, সত্যিকারের একটা সত্যিকারের থিওরি বা তত্ব Chaos Theoryর অন্তর্ভুক্ত এক বৈজ্ঞানিক ব্যাপার। যেখানে প্রজাপতির তুলনা এইরূপ যে পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে একটা প্রজাপতি ডানা ঝাপটালে সেটার প্রতিক্রিয়া লিনিয়ার পদ্ধতিতে একের পর এক, একের পর এক ঘটনাকে প্রভাবিত করে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে তুমুল ঝড় তৈরি করে ফেলতে পারে! প্রজাপতিটা একটা উদাহরণ বটে।
পরিবেশের জীববৈচিত্রও এমনি এক ব্যাপার, যার একদিক ধরে নাড়া দিলে তা ঘুরেফিরে গোটা ব্যবস্থার উপরই প্রভাব ফেলবে।
ফেলবেই!
প্রকৃতিতে নিছক থাকার জন্যে কিছু নেই। প্রতিটা জিনিষ প্রয়োজনের স্বার্থেই রয়েছে! এমনি যে তেলাপোকার নাম শুনতে আমরা ভ্রু কুচকাই সেই তেলাপোকাও কারণবশতই এই প্রকৃতিতে রয়েছে।
আপামর প্রকৃতি আমাদের জন্যে অকল্পনীয়রকমের বিশাল ধনভাণ্ডার। একে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার মত মূর্খতা মানে শুধু প্রকৃতির ক্ষতি নয়, নিজেদেরই ক্ষতি।
কিছু সত্য সর্বদাই তেতো হয়। তেমনি এক সত্য এই যে স্রেফ ২০০ বছরে আমরা পৃথিবীর যে ক্ষতি সাধন করেছি, গত দুই হাজার বছরেও কোনো প্রাণী পৃথিবীর সেই ক্ষতির দশভাগের একভাগও করতে পারেনি!
আমারা মানুষেরাই, আমাদের স্বজাতিরাই পৃথিবী ও এর জীবজগতের জন্যে সবচাইতে ক্ষতিকর প্রাণী। তাও পৃথিবীর সবচাইতে বুদ্ধিমান ও করিৎকর্মা প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও! সুতরাং একথা বলা বাহুল্য যে পরিবেশের উন্নতি, ক্ষতিসাধন রোধ আর জীববৈচিত্র সংরক্ষণে সবচে বেশি আর বড় দায়িত্ব আমাদেরই…
বিজ্ঞানবর্তিকার এই আলোচনায় আপনাদের সাথে আজ এপর্যন্তই৷
হয়তো আবারো ফিরে আসবো শীঘ্রই নতুন কোনো বিষয় নিয়ে। ততক্ষণ ভাল থাকুন,
সুস্থ থাকুন, নিজের আর পরিবেশের খেয়াল রাখুন।
আর বিজ্ঞানবর্তিকার সাথেই থাকুন…
বেচে থাকুক বনায়ন।
টিকে থাকুক জীববৈচিত্র…
তথ্যসূত্রঃ
hunker, europa , eniscuola, ypte