পৃথিবী স্থির, পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে সকল তারকামন্ডল, সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র! আমার কথা শুনে আপনি হয়তো ভাবছেন আমি পাগল হয়ে গিয়েছি, অথবা আমার মাথা ঠিক নেই! কিন্তু একসময় এটাই ছিল সবার কাছে সত্যি।
একবার ভেবে দেখুন, বিষুবরেখা বরাবর পৃথিবীর পরিধি হল ৪০০৭৫ কিলোমিটার। বিষুবরেখায় অবস্থিত যে কোন জায়গা, পৃথিবীর দৈনিক ঘূর্ণনের কারনে, ঘণ্টায় ১৬৭০ কিলোমিটার বেগে পাক খাচ্ছে, এটা বিশ্বাস করা খুব সহজ নয়। আবার পৃথিবী সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে। পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যকার গড় দূরত্ব হল ১৪৯৫৯৭৮৯০ কিলোমিটার। এক বছরে পৃথিবী ২৩.১৪ ১৪৯৫৯৭৮৯০=৯৩৯,৯৫০,৪৭০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে। এক বছরে আছে ৮৭৬০ ঘন্টা। পৃথিবী ঘন্টায় ১০৭৩০০ কিলোমিটার বেগে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। কল্পনা করুন তো আমাদের পৃথিবী, বাড়িঘর, গাছপালা, পাহাড় পর্বত, নদী সমুদ্র, বাতাস নিয়ে, ঘণ্টায় ১৬৭০ কিলোমিটার বেগে নিজে বনবন করে ঘুরছে, এবং একই সাথে, ঘণ্টায় ১০৭৩০০ কিলোমিটার বেগে সূর্যর চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে। আপনি যদি এই তথ্যগুলো সাধারণ মানুষকে জানান তাহলে তার কি খুব সহজে বিশ্বাস হবে? তাহলে আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগের মানুষের জন্য এই জিনিসগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বাস করা খুব কঠিন ছিলো।
তবুও সেসময় কিছু দার্শনিক অন্যরকম চিন্তা করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ‘ফিলোলাস’ (খ্রীষ্টপূর্ব ৪৮০-৪০৫), তিনি সক্রেটিসের সমসাময়িক গ্রীক দার্শনিক ছিলেন। ফিলোলাস মহাবিশ্বের একটি প্রতিরূপ প্রদান করেন যেখানে এক বিশাল আগুনের গোলককে কেন্দ্র করে দশটি সমকেন্দ্রিক বৃত্তে পাঁচটি গ্রহ, সূর্য, পৃথিবী, চাঁদ, স্থির তারামন্ডলী এবং একটি রহস্যজনক বস্তু, (ফিলোলাস এর নাম দিয়েছিলেন পালটা পৃথিবী বা counter earth) ঘুরছে। সেসময়ে গ্রীকদের কাছে ১০ ছিলো একটি পবিত্র সংখ্যা। তাই ঘূর্নায়মানদের সংখ্যা ১০ করার জন্য ফিলোলাস তার প্রতিরূপে পালটা পৃথিবী রেখেছিলেন।
ফিলোলাসের মতো প্রায় একই রকম একটি মডেল দিয়েছিলো আরেক গ্রীক দার্শনিক এরিস্টার্কাস (খ্রীষ্টপূর্ব ৩১০-২৫০)। তবে তিনি মডেলটির কেন্দ্রে আগুনের গোলকের পরিবর্তে সূর্যকে রেখেছিলেন।
তবে বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল ভূকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের প্রতিরূপ দেয়। আর গ্রীকরা এরিস্টটলের প্রতিরূপটিই গ্রহণ করেছিলো। কারন পৃথিবীর গতি সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিলোনা। আপাত দৃষ্টিতে তারা দেখতো সূর্যই পূর্ব থেকে পশ্চিমের দিকে গতিশীল, এবং পৃথিবী তার নিজের জায়গাতেই স্থির রয়েছে। তাই তাদের কাছে এরিস্টার্কাসের থেকে এরিস্টটলের মহাবিশ্বের প্রতিরূপটি বেশি গ্রহণযোগ্য ছিলো। এছাড়া এরিস্টটলের ভূকেন্দ্রিক মডেলে বিশ্বাসীরা তর্ক করেছিলেন যে, বিশ্ব সূর্যকেন্দ্রিক হলে তারাদের উপর প্যারালাক্স প্রভাব দেখতে পাওয়া যেত, কিন্তু সেটা দেখতে পাওয়া যায় না। প্যারালাক্স হল পর্যবেক্ষকের অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে লক্ষ্যস্থলের স্থান পরিবর্তন। সহজেই এটা বুঝতে পারা যায়। বাম চোখটি বন্ধ করে ডান চোখ দিয়ে দূরবর্তি কোন বস্তু লক্ষ করুন। এবার, ডানহাতটি প্রসারিত করে, বুড়ো আঙ্গুলটি দূরবর্তি বস্তুটির সাথে একলাইনে আনুন। এবার ডানচোখ বন্ধ করে বাঁ চোখ দিয়ে বস্তুটি দেখুন। বুড়ো আঙ্গুলের প্রেক্ষিতে দূরবর্তি বস্তুটি বাঁ দিকে সরে গিয়েছে। এটাই হল প্যারালাক্স প্রভাব।
চিত্রঃ১ একটি তারার উপর প্যারালাক্স প্রভাব দেখান হয়েছে।
উপরের চিত্রে যেমন দেখানো হয়েছে, সূর্য কেন্দ্রিক মহাবিশ্ব হলে এই প্যারালাক্স প্রভাব দেখা যেতো। ছয়মাস অন্তর অন্তর তারাদের অবস্থান বদলে যেতো। যেহেতু সেটা হয় না সুতরাং, তারা যুক্তি দিয়েছিল যে পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে না।
তবে যাই হোক, এরপরও এরিস্টটলের ভূকেন্দ্রিক মডেলটিতে একটি সমস্যা থেকে যায়, আর তা হচ্ছে পৃথিবী থেকে গ্রহগুলোর গতিপথ লক্ষ্য করলে একটি আশ্চর্যজনক জিনিস দেখা যায়। একটি গ্রহ পূর্ব দিকে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে যায়, এরপর তার গতিপথ পালটিয়ে উলটো দিকে(পশ্চিম দিকে) চলতে শুরু করে। আবার হঠাৎ থেমে গিয়ে গতিপথ বদলায় এবং আবার পূর্ব দিকে চলতে শুরু করে। গ্রহগুলোর এই গতিপথকে বলা হয় রেট্রোগ্রেড।
চিত্র: ২ গ্রহদের বিপ্রতীপ গতি।
এসময় আবির্ভাব হয় মিসরীয় গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ ক্লডিয়াস টলেমির (৯০-১৬৮ খ্রিস্টাব্দ) । গ্রহগুলোর এধরণের গতির ব্যাখ্যার জন্য তিনি এরিস্টটলের মডেলটির কিছু উন্নতি সাধন করেন। টলেমির এই উন্নত মডেলটিতে গ্রহগুলো একটি বৃত্তে ঘুরছে যার নাম দেয়া হয় এপিসাইকেল এবং এই এপিসাইকেল আরো বড় একটি বৃত্তাকার পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে যার নাম দেয়া হয়েছিলো ডেফারেন্ট। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবী কিন্তু ডেফারেন্টের কেন্দ্র নয়! ডেফারেন্টের কেন্দ্র হচ্ছে পৃথিবী ও ইকোয়ান্ট নামক এক কাল্পনিক বিন্দুর মধ্যবিন্দু।
চিত্র:৩ বিপ্রতীপ গতি ব্যাখ্যা করার জন্য টলেমীর মডেল
এবার একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন যে টলেমির এই উন্নত মডেলটি গ্রহগুলোর রেট্রোগ্রেড বা বিপ্রতীপ গতিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এই মডেলে পৃথিবীর সাপেক্ষে গ্রহটির গতিপথ উলটে যাবে এবং এই রেট্রোগেড গতিকে ব্যাখ্যা করা যাবে। টলেমির এই মডেলটি এতোই ভালো হয়েছিলো যে ১৬শ শতক পর্যন্ত এর বিকল্প কোন মডেল ছিলো না।
তবে যতোই উন্নতি সাধন করা হোক, প্রকৃত সত্য হচ্ছে পৃথিবী বা কাল্পনিক বিন্দু ইকোয়ান্ট কোনটিই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়!
এই ভুল ধারণাটিকেই বিজ্ঞানের সত্যের আলোতে উঠে আসে নিকোলাস কোপার্নিকাস নামের এক গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদের হাত ধরে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৪৭৩ সালে পোল্যান্ডের তোরণ শহরে জন্ম নিয়েছিলেন। তার পিতা মিকোলাস ছিলেন একজন তামার ব্যবসায়ী এবং মা বারবারা ছিলেন গৃহবধূ। খুব অল্প বয়সেই নিকোলাসের তার পিতা-মাতার মৃত্যু হয়। তার আশ্রয় হয় তার মামা লুকাসের কাছে। মামা লুকাস তোরাণ শহরেই তার প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। এরপর নিকোলাস ক্রাকো বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাটিন, ভূগোল, দর্শনশাস্ত্র, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা অধ্যয়ণ করেন। গণিতে তার অসামান্য দক্ষতা ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে তিনি তোরণ শহরেই ক্যাথলিক চার্চের পাদ্রী হিসেবে চাকরীতে যোগ দেন। পরবর্তিতে মামার পরামর্শে চার্চ থেকে ছুটি নিয়ে তিনি ইতালীর বোলোগান বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় আইন বিষয়ে শিক্ষা নিতে ভর্তি হন। এরপর পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং চিকিৎসাবিদ্যায় তিনি শিক্ষা নিতে শুরু করেন। এরপর ছুটি শেষ হয়ে যাওয়াতে তিনি তা সম্পূর্ণ না করেই ফিরে যান। পরবর্তিতে ছুটি বাড়িয়ে তিনি আবারো ফিরে আসেন ইতালীতে এবং মাত্র ৭ বছরে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
বোলোগান বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীনই তিনি তখনকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডোমেনিকা মারিয়া নভেরা দে ফেরেরার সাথে পরিচিত হন এবং তার সহকারী হিসাবে যোগদান করেন। তার কাছে থেকেই নিকোলাস জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সেই সময় জ্যোতির্বিদ্যার পাঠ্যক্রম অনুযায়ী তিনি শিখেছিলেন পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের মডেল সম্পর্কে। সেখান থেকেই তিনি টলেমির তত্ত্বের ভিত্তিতে চাঁদের গতিপথের বিশ্লেষণ সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণ যাচাই করেন।
তবে টলেমির ইকোয়ান্ট ব্যবহার নিকোলাস কোপার্নিকাসের পছন্দ হয়নি। তাই তিনি ফিলোলাসের আগুনের গোলাকেন্দ্রিক মডেলটিতে আগুনের গোলার পরিবর্তে সূর্যকে বসানোর চিন্তা-ভাবনা করলেন (কোপার্নিকাস হয়তো এরিস্টার্কাসের সৌরমডেল সম্পর্কে তখন জানতে পারেনি, তার বই On the revolution of the celestial spheres শুধু ফিলোলাসের নাম পাওয়া গিয়েছে)। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সূর্য কেন্দ্রিক মডেলের গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে গ্রহদের গতিপথের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। কোপার্নিকাস গীর্জা থেকে কিছু চুন, পাথর, জ্যোতির্বিদ্যার অল্প কিছু যন্ত্র নিয়ে ছোট একটা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বানিয়ে ফেললেন এবং অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে আকাশের গ্রহ-তারাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তার পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন যে পৃথিবীর পরিবর্তে সূর্য মডেলের কেন্দ্র হয় তাহলে কাল্পনিক বিন্দু ইকোয়ান্টের দরকার হয়না। কিন্তু কোপার্নিকাস জানতেন তার এই মডেলটি রোমান ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃপক্ষের পছন্দ হবে না। তাই তিনি বেনামে তার এই মডেলটির সংক্ষিপ্ত মতবাদ De hypothesibus motuum coelestium a constitutis commentariolus এই বইটিতে প্রকাশ করে এবং কিছু বন্ধুকে বিতরণ করেন। কোপার্নিকাসের মডেলটি ৭টি স্বয়ংপ্রমাণিত সত্যর উপর ভিত্তি করে ছিলো:
১। বিশ্বের সমস্ত গ্রহদের কক্ষপথের জন্য কোন একক কেন্দ্র নেই।
২। পৃথিবীর কেন্দ্রটি মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়, কেবলমাত্র চাঁদের কক্ষপথের কেন্দ্র।
৩। মহাবিশ্বের কেন্দ্র সূর্যের কাছাকাছি।
৪। পৃথিবী থেকে তারাদের দূরত্ব পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের তুলনায় অনেক অনেক বেশি।
৫। নক্ষত্রগুলির আপাত দৈনিক ঘূর্ণন পৃথিবীর দৈনিক ঘূর্ণনের জন্য। তারারা নিজেরা স্থিতিশীল।
৬। পৃথিবী বছরে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। আপাত দৃশ্যমান সৌর গতি পৃথিবীর ঘূর্ণনের জন্যই। সূর্য নিজে স্থিতিশীল।
৭। গ্রহদের বিপরীতমুখী গতি সূর্যের চারিপাশে পৃথিবীর গতির কারণে ঘটে।
চিত্র:৪ কোপারনিকাসের মডেলে বিপ্রতীপ গতির ব্যাখ্যা।
৪র্থ, ৫ম এবং ৬ষ্ঠ ভিত্তিগুলো স্বয়ংপ্রমাণিত সত্য এবং তা সূর্যকেন্দ্রিক ও ভূকেন্দ্রিক মডেলের মধ্যকার মৌলিক পার্থক্য। চার নাম্বার সূত্রে কোপার্নিকাস সূর্যকেন্দ্রিক মডেলের প্যারালাক্স প্রভাব না দেখবার কারণ ব্যাখ্যা করলেন। দূরত্ব বাড়লে প্যারালাক্স প্রভাব কমে, কোপার্নিকাস তারাদের পৃথিবী থেকে বহু বহু দূরে পাঠিয়ে প্যারালাক্স প্রভাব ভীষন ভাবে কমিয়ে দিলেন। পাঁচ নাম্বার সূত্রে তিনি বললেন পৃথিবী ঘুরছে। ছয় নাম্বার সূত্রে বললেন সূর্য স্থির কিন্তু গতিশীল মনে হয় পৃথিবীর গতির জন্য, পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।
এটা একটা লক্ষণীয় বিষয় যে কোপার্নিকাস সূর্যকে বিশ্বের কেন্দ্রে স্থাপন করেন নি। কোপার্নিকাস ক্যাথলিক গীর্জার প্রতিক্রিয়া নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন। তিনি নিজেও ছিলেন ধর্মভীরু। বাইবেলে আছে পৃথিবী স্থির। তাই কোপার্নিকাস তার পর্যবেক্ষণ প্রকৃতির সত্য হিসাবে উপস্থাপন না করে, একটি মডেল হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন। সাত নাম্বার সূত্রে কোপার্নিকাস বললেন যে গ্রহদের বিপ্রতীপ গতি সূর্যের চারিপাশে পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে ঘটে। সূর্যকেন্দ্রিক মডেলে গ্রহদের বিপ্রতীপ গতি সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। ৪ নং চিত্রতে সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথবী ও একটি গ্রহের ক্রমবর্ধমান অবস্থানগুলি দেখানো হয়েছে। পৃথিবী নিজের কক্ষপথটি গ্রহটির চেয়ে দ্রুতগতিতে সমাপ্ত করলে একসময় পৃথিবী থেকে গ্রহটিকে উল্টোদিকে যেতে দেখা যাবে।
১৫৩২ সালে তিনি তার বই “দি রিভিউলিসানবাস ওরবিয়া কেলেসটিয়াম” এর কাজ শেষ করেন।
১৫৩৩ সালে জন আলবার্ট ইউডমান্সটার রোমে কোপার্নিকাস তার ত্বত্তের ধারাবাহিক বক্তব্য দেন। পোপ ক্লেমেন(সপ্তম) এবং ক্যাথোলিক কার্ডিনাল এতে খুশী হন এবং এই ত্বত্তের উপর আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৫৩৩ সালের ১ নভেম্বর কার্ডিনাল রোম থেকে কোপার্নিকাসের নিকট একটি চিঠি প্রদান করেন- “কয়েক বছর আগে আমি আপনার কাজ সম্পর্কে অবগত হয়েছি। সে সময় থেকেই আমি অনেক দুঃখ পেয়েছি কারণ আমি জেনেছি আপনি অন্যসব প্রাচীন জ্যোতির্বিদদের মতো নন। আপনি ভিন্ন কিছু করছেন, নতুন কিছু করছেন। আপনি বলেছেন পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারিদিকে যা মহাবিশ্বের কেন্দ্র। আমি আপনার কাছ থেকে এসব শিখেছি জনাব। যদি আপনার অসুবিধা না হয় তাহলে আপনার এই আবিষ্কারগুলো জ্যোতির্বিদদের কাছে পাঠান এবং আপনার লেখাগুলো একত্র করে আমার কাছে পাঠান।“
এরপরই ইউরোপের শিক্ষিত লোকের কাছে কোপার্নিকাসের কাজ পৌছুতে থাকে। কোপার্নিকাসে এরপরও তার বইটি প্রকাশ করতে দেরী করেন। তার অন্যতম কারণ ছিলো তিনি তৎকালীন সমাজের অবস্থা সম্পর্কে ভীত ছিলেন। বিদ্বান, পন্ডিত লোকেরা কোপার্নিকাসের দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষন করেন এবং তিনি ধর্মীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন।
অবশেষে তার ছাত্র রেকটাসের সাহায্যে ও চাপে কোপার্নিকাস তার বইটি টিডেমান গিসেকে(কুলমের বিশপ) দেন। তিনি রেকটাসের কাছে বইটি ছাপানোর জন্য জার্মান মুদ্রাকর জন পিটারসের কাছে পাঠান। এই ছাপাঘরটি ছিলো জার্মানীর নুরামবার্গে। বইটি ছাপার কাজ শুরু হলে রেকটাসকে নুরামবার্গ ত্যাগ করতে হয়। রেকটাস এই কাজ তখন আন্দ্রেস ওসেন্দ্রিয়ারের কাছে সমর্পন করে যান। ওসেন্দ্রিয়া, কোপার্নিকাসের অজান্তেই কিছু সূচনা যোগ করে দেন। তিনি বলেন যে- “এই বইয়ে যে বিষয়টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটি সত্য নয়। গণনার সুবিধার জন্য এটি একটি বিকল্প পদ্ধতি, এর সাথে সত্যের কোন সম্পর্ক নেই।”
আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার এই জনক ১৫৪৩ সালের ২৪শে মে ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
নিকোলাস কোপার্নিকাসকে দর্মবার্গ ক্যাথোড্রোলে কবর দেয়া হয়। ১৮০২, ১৯০৯, ১৯৩৯ এবং ২০০৪ সালে কয়েকবার তার কবর খুঁজে বের করার চেষ্টা চালানো হয় তবে তা কেউ খুঁজে পায় নি। এরপর ২০০৫ সালে ১ টি প্রত্নতত্ত্ব দলের প্রধান জেরী গাসোসকি ক্যথোড্রোলের ভূমিতে খুটিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর অবশেষে নিকোলাস কোপার্নিকাসের কবর খুঁজে পাওয়া যায়।
২০১০ সালে ২২ মে দ্বিতীয়বারের মতো নিকোলাস কোপার্নিকাসের অন্তোস্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয় পোল্যান্ডে। ফর্মবার্গের ক্যাথোড্রোল থেকে কোপার্নিকাসের কঙ্কালের অংশবিশেষ সংগ্রহ করা হয়। তার কবর কালো গ্রানাইট পাথর দিয়ে চিহ্নিত করা হয় এবং সেখানে বলা হয় যে নিকোলাস কোপার্নিকাস হেলিওসেন্ট্রিক ত্বত্তের জনক। তার কবরের পাশে কোপার্নিকাস মডেল, সূর্য ও ৬ টি গ্রহের প্রদর্শন করা হয়েছে।
2 Comments
kamruzzaman Emon
কোপার্নিকাস সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে থাকাকালে। তারপর Neil Tyson এর Cosmos দেখে তার সম্পর্কে আরো জানা হয়।
আমি যতদূর জানি কোপার্নিকাস একসময় এরিস্টর্কাস এর লেখা সৌরকেন্দ্রিক মডেলের খোঁজ পায়। তাছাড়া কেপলারের গ্রহগতির সূত্রগুলোও কোপার্নিকাসের কাজ থেকে প্রভাবিত।
যাই হোক, এরিস্টটল আর টলেমির মত গবিতবিদদের গোড়ামির কারণে হাজার বছর মানুষ জাতি ভুল জেনে এসেছিল। এরিস্টর্কাস, কেপলার, কোপার্নিকাস আর গ্যালিলেও দের প্রতি থাকবে বিনম্র শ্রদ্ধা। তাদের কঠোর কাজের মাধ্যমেই আমরা আজকের এই সত্য জানতে পেরেছি।
কোপার্নিকাস আর সৌরকেন্দ্রিক পৃথিবীর ইতিহাস চমৎকারভাবে তুলে ধরার জন্য সারোয়ার ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
Anonymous
এরিস্টার্কাসের মডেল সম্পর্কে তিনি জানতো কিনা, সেটা জানা যায়নি তার বইয়ে, তবে ফিলোলাসের কথা পাওয়া গিয়েছে।
আর কেপলার, কোপার্নিকাসের মডেল থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে ?
কারন তার জন্ম ১৫৭১ সালে, যেখানে কোপার্নিকাস মৃত্যু বরণ করে ১৫৪৩ সালে। ✌