বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম COVID-19। অনেক জায়গাতেই একটি কথা শোনা যাচ্ছে যে, যাদের রক্তের গ্রুপ ‘এ’ তাদের নাকি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। অনেক আন্তজার্তিক সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েও এসেছে কথাটি। কিন্তু এটা কতটুকু সত্য আর এই পরীক্ষার ভিত্তিটাই বা কি, সেটা যথেষ্ট প্রশ্নের সৃষ্টি করে।
নিয়ম অনুযায়ী এই গবেষণাটি এখনো খসরা গবেষণা হিসেবে রয়েছে। এই গবেষণাটি কয়েকজন চীনা গবেষক করেছেন। যেহেতু এর এখনো কোন পাক্ষিক পর্যালোচনা, ক্রস চেকিং এসবের কিছুই হয়নি তাই খসরা গবেষণার চেয়ে একে বেশি কিছু বলা যাবে না। যদিও এই আপাতকালীন সময়ে এ ধরণের গবেষণায় বেশি সময় যে দেওয়া হবে না সেটাই স্বাভাবিক।

চীনা কয়েকজন গবেষক ২১৭৩ জন COVID-19 এ আক্রান্ত রোগীর উপর এই গবেষণা চালায়। চীনের উহান ও শেঞ্জহেন শহরের তিনটি হাসপাতাল ছিল এই গবেষণার ক্ষেত্র।
গবেষকেরা প্রথমে প্রত্যেক এলাকার সাধারণ জনগণের রক্তের গ্রুপের পরিসংখ্যান নেয় তারপর COVID-19 এ আক্রান্ত রোগীদের রক্তের গ্রুপের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষন করেন। মেটা-এনালাইসিসের মাধ্যমে দেখা যায় যে, ‘এ’ গ্রুপের রক্তধারীদের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অন্য রক্তের গ্রুপধারীদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। সেই তুলনায় ‘ও’ গ্রুপের রক্তধারীদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা সবচেয়ে কম।
এর মাঝে বলে রাখা ভালো মেটা এনালাইসিসকে কোয়ান্টেটিভ এনালাইসিসও বলা হয়ে থাকে। যার বাংলা অর্থ পরিসংখ্যানভিত্তিক বা সংখ্যাগত বিশ্লেষণ।
পরিসংখ্যান
এবার এই গবেষণার পরিসংখ্যানটা একটু দেখে নেওয়া যাক। উহানের বাসিন্দাদের রক্তের গ্রুপ অনুযায়ী ভাগ করলে-
- ‘এ’ গ্রুপ- ৩১ শতাংশ
- ‘বি’ গ্রুপ- ২৪ শতাংশ
- ‘এবি’ গ্রুপ- ৯ শতাংশ
- ‘ও’ গ্রুপ- ৩৪ শতাংশ
আর ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে-
- ‘এ’ গ্রুপ- ৩৮ শতাংশ
- ‘বি’ গ্রুপ- ২৬ শতাংশ
- ‘এবি’ গ্রুপ- ১০ শতাংশ
- ‘ও’ গ্রুপ- ২৫ শতাংশ
এই একই ধরণের ডেটা শেঞ্জহেন শহরের ক্ষেত্রেও।
এই পরিসংখ্যান থেকে এটুকু পরিষ্কার যে ‘এ’ গ্রুপধারীদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। কিন্তু তার মানে এরকম কিছু না যে ‘ও’ গ্রুপধারীদের ইমিউনে সিস্টেম খুব বেশি শক্তিশালী আর তাদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কিছু নেই এবং ‘এ’ গ্রুপধারীদের প্রায় সকলেরই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
পরিসংখ্যানে পাওয়া পার্থক্য খুবই কম। এতো কম ব্যবধানের ভিত্তিতে আসলে কোন সিদ্ধান্ত দেওয়া যায় না। তবে যদি পৃথিবীব্যাপী সকল রোগীদের ডেটা থেকে এই বিশ্লেষণটি করা হয় তবে হয়তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো একটি জায়গায় যাওয়া যাবে। তবে এই গবেষণার চেয়ে এখন বেশি প্রয়োজন করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার।
ভাইরাসের সাথে রক্তের গ্রুপের সম্পর্ক
তবে ভাইরাস প্রতিরোধের সাথে রক্তের গ্রুপের সম্পর্কটা একটু দেখে নেওয়া যাক। ABO গ্রুপ গুলো নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো এই আলোচনা। যেহেতু মোট জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশেরও বেশি মানুষ ABO গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। আগে গ্রুপভেদে রক্তের বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে নিই।

উপরের ছবিটি দেখে আমরা বুঝতে পারি যে প্রতিটি ধরণের রক্তেরই কিছু বৈশিষ্ট্যগত উপাদান রয়েছে। যেগুলো হল এন্টিবডি আর এন্টিজেন। নির্দিষ্ট উপাদানের বাইরের কোন উপাদান রক্তে প্রবেশ করলে রক্তের আদি উপাদান তাকে বহিরাগত শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাকে মেরে ফেলে। এবার একটু ইতিহাসের পাতা উল্টানো যাক।
Norovirus এর কথা মনে আছে? এই ভাইরাসের কারণে লক্ষণ হিসেবে ফ্লু, বমি, ডাইরিয়া ইত্যাদি হতে পারে। এই রোগ এখন আর মহামারী নয়। আমেরিকার ওহিও প্রদেশ থেকে খাদ্য ও পানির সাথে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস মহামারীর জন্ম অবশ্য দিয়েছিল ঠিকই। ২০০৬-০৭ সালে পৃথিবীজুড়ে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল এই রোগে। আর প্রতিবছর গড়ে ৬৮৫ মিলিয়ন মানুষ এই ভাইরাসের শিকার হয়। প্রতিষেধক থাকায় রোগী ৩ দিনেই সুস্থ হয়ে যান।

এই ভাইরাসের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। যখন যে ব্যাক্তির শরীরে প্রবেশ করতো তখন ঐ ব্যাক্তির রক্তের আদি উপাদানের আদলে নিজের রূপ পরিবর্তন করে ফেলতে পারতো। তাই মানুষের খুব একটা অভ্যন্তরীন শক্তি ছিলনা একে প্রতিরোধ করার। কিন্তু রূপ পরিবর্তনের একটি প্যাটার্ন ছিল যাকে ভিত্তি করেই এর প্রতিষেধক তৈরী করা হয়েছিল।
এবার আসি করোনা ভাইরাস প্রসঙ্গে। আমরা অনেকেই জানি যে করোনা ভাইরাস ইতিমধ্যে প্রায় ৩৮০ বারের মতোন তার জিন পরিবর্তন করেছে। আপাতত পাওয়া খসড়া গবেষণার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, করোনা হয়তো ‘এ’ গ্রুপ রক্তের উপাদানের রূপ সহজেই গ্রহণ করতে পারে তাই তাদের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। অপরদিকে ‘ও’ রক্তের গ্রুপে দুই ধরণের এন্টিবডি থাকায় করোনা সেখানে একটু হয়তো হিমশিম খায়। কিন্তু বড় পরিমাণে ডেটা না পেলে কিছুই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। এই পুরো বিষয়টাই এখন হাইপোথিসিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে।
যাই হোক এই বিষয় নিয়ে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। রক্তের গ্রুপ আমাদের বাঁচাতে পারবে না। এই মহামারী থেকে কেবল ও কেবলমাত্র সচেতনতাই পারবে আমাদের বাঁচাতে। তাই সম্পূর্ণ না জেনে সোশ্যাল মিডিয়ার মুখরোচক শিরোনামে বিভ্রান্ত হবেন না। সবার আগে সচতনতা।
তথ্যসূত্রঃ sciencealert, contagionlive, theconversation, knowablemagazine, nhs.uk.