সম্প্রতি প্রচারিত মিনি-সিরিজ “Chernobyl” আরও একবার মানুষের সামনে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের ভয়াবহ দিক গুলো সামনে এনেছে। কিন্তু চেরনোবিল ডিজাস্টার এ বিশ্বের একমাত্র নিউক্লিয়ার বিপর্যয় নয়। চলুন চেরনোবিলের মতো আরও ভয়াবহ কিছু নিউক্লিয়ার ডিজাস্টার সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
১ম পর্ব পড়ুন এখানে।
দ্য গইয়ানিয়া একসিডেন্ট
১৯৮০’র দশকে , ব্রাজিলের গইয়ানিয়াতে (Goiânia) Instituto Goiano de Radioterapia (IGR) নামের একটি প্রাইভেট রেডিওথেরাপী হাসপাতাল ছিলো। ১৯৮৫ সালে হাসপাতালটি নতুন স্থাপনায় স্থানান্তরিত হলেও সিজিয়াম-১৩৭ বেসড থেরাপী ইউনিটটি রয়ে যায়। এই সিজিয়াম-১৩৭ লেড আর স্টিলের তৈরি একটি শিল্ডিং ক্যানিস্টারে আবদ্ধ ছিলো।
আইনি ঝামেলার কারণে সেই স্থাপনা থেকে ক্যানিস্টার সরানো সম্ভব হয়নি। তবে কোর্ট থেকে যন্ত্রপাতি সুরক্ষিত রাখতে একজন নিরাপত্তাকর্মী নিযুক্ত করা হয়েছিলো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৮৭ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর , নিরাপত্তাকর্মীটি সেখানে ছিলেন না। সেই সুযোগে রবার্তো দোস সান্তোস আলভেজ আর ওয়েগনার মোতা পেরেরা (Roberto dos Santos Alves and Wagner Mota Pereira) নামের দু’জন স্থাপনাটিতে অনুপ্রবেশ করে। তারা দু’জন যন্ত্রপাতিগুলো একটা হুইলব্যারোতে (একচাকার ছোট ঠেলাগাড়ি) নিয়ে পালায়। আর সেগুলো আলভেজের বাড়িতে এনে লুকায়।
যখন তারা যন্ত্রপাতিগুলো খুলে ফেলা শুরু করলো, দুজনেই সাথে সাথে তখন বমি করতে লাগলো। পরেরদিন , পেরেরা তার হাতে পোড়া দাগ খেয়াল করলো। শেষপর্যন্ত হাতের বেশ কয়েকটি আঙ্গুল কেটে ফেলতে হলো।
অন্যদিকে আলভেজ কাজ চালিয়ে গেল। সে স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে ক্যানিস্টারটি ছিদ্র করে ফেললো। সে চেরেনকভ রেডিয়েশনের নীল আভা খেয়াল করেছিলো। আলভেজও তেজস্ক্রিয়া থেকে নিস্তার পেলো না। হাত পুরে গেল। গোটা হাতটা কেটে বাদ দেওয়ার আগে সে যন্ত্রপাতিগুলো ডেভেয়ার আলভেজ ফেরেরা (Devair Alves Ferreira) নামের এক পুরানো মালের আড়ৎদার কাছে বেঁচে দিলো।

ফেরেরা যন্ত্রপাতি থেকে বিচ্ছুরিত নীল আভায় মুগ্ধ হয়ে, জিনিষগুলো নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো। পরবর্তী তিনদিন সে তার বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় দাওয়াত দিয়ে এই নীল আভা দেখালো।
ফেরেরার ভাই কিছু সিজিয়াম তার বাড়িতে এনে, মেঝেতে ছিটালো । সেখানে তার ৬বছর বয়সী মেয়ে লাইডা দাস নেভেস ফেরেরা (Leide das Neves Ferreira) মেঝেতে বসে আইসক্রিম খাচ্ছিলো।
ঘটনাক্রমে , ফেরেরার স্ত্রী সিজিয়ামগুলোকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। এর ফলে লোকাল মিডিয়াতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ফাঁসের কথা প্রচার পেলো। ২৫০ জন তেজক্রিয়া দূষণে আক্রান্ত হয়েছিল, এর মধ্যে ১২৯ জনের অভ্যন্তরীণ দুষণে আক্রান্ত হয়েছিল।
ছয় বছর বয়সী লাইডা, ফেরেরার স্ত্রী গ্যাব্রিয়েলা (৩৭), ফেরেরার দুজন কর্মচারী ইসরায়েল ব্যাপিস্টা (২২), এডমিলসন আলভেস ডি সুজা (১৮), এই ৪ জন তেজস্ক্রিয় দুর্বলতায় মারা গিয়েছিলো।
গইয়ানিয়ার দুর্ঘটনার কারণে গইয়ানিয়ার এরোপোর্তো, সেন্ট্রাল আর ফেররোভিয়ারোস জেলাগুলো প্রবলভাবে তেজস্ক্রিয় দূষণে আক্রান্ত হয়েছিলো। এরমধ্যে আলভেজের বাড়ি, ফেরেরার পুরানো মালের আড়ত, তার ভাই আইভোর বাড়িতে প্রবলভাবে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়া পাওয়া গিয়েছিলো।

ন্যাটো সাইন্স ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি সিরিজ অদ্ভুদভাবে ৩টি বাসে, ৪২টি বাড়িতে, ১৪টি গাড়িতে, ৫টি শুকরে আর প্রায় ৫০হাজার টয়লেট পেপারের রোলে তেজস্ক্রিয় দূষণ খুঁজে পেয়েছিলো।
গইয়ানার এই দুর্ঘটনাটি ইন্টারন্যাশনাল নিউক্লিয়ার এন্ড রেডিওলজিকাল ইভেন্ট স্কেলে ৫ম মাত্রার। ১৯৯০ সালে এই দুর্ঘটনার উপর নির্মিত সিনেমা ব্রাজিল ফিল্ম ফেস্টিভালে (Festival de Brasília film festival) বেশ কয়েকটি পুরষ্কার জিতে নেয়। এছাড়াও ১৯৯৪ সালে স্টার ট্রেক : দ্য নেক্সট জেনারেশন টিভি সিরিজটির একটি পর্ব “Thine Own Self” এ দুর্ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বানানো হয়েছিলো।
ক্যানাডার চক নদীর দুর্ঘটনা
ক্যানাডার অন্টারিওতে চক নদীর অবস্থান। ১৯৫২ এর ডিসেম্বরের ১২ তারিখ, চক রিভার নিউক্লিয়ার ল্যাবেরটরিজ এর NRX রিয়েক্টরে একটি পাওয়ার এক্সকারশন আর তাপ নিরুদকের আংশিক ক্ষতিগ্রস্থের ঘটনা ঘটে। যান্ত্রিক ট্রুটির কারণে কোরের ভেতর কন্ট্রোল রডগুলো নামানো যাচ্ছিলো নাা আর ফুয়েল রড গুলো অনেক গরম হয়ে উঠেছিলো। এরফলে কোর গলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।

চেরনোবিলের মতোই, হাইড্রোজেন গ্যাসের কারণে একটি বিস্ফোরণে হাজার-টন রিয়েক্টর ভেসেল সিলটি উড়ে যায়। এমনকি চেরনোবিলের মতই সাড়ে ৪ হাজার টনের তেজস্ক্রিয় পানির অস্তিত্ব চক রিভার রিয়েক্টর বিল্ডিংয়ের বেসমেন্টে পাওয়া যায়। দুর্ঘটনায় , দশ হাজার কুরী মাত্রার তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
আমেরিকার নেভার অফিস্যার জিমি কার্টার (পরবর্তীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন) এর নেতৃত্বে , ইউ.এস নেভীর ১৩ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবক দল এই বিপর্যইয়টি পরিষ্কার করতে কাজ করে।

ইন্টান্যাশনাল নিউক্লিয়ার ইভেন্ট স্কেল অনুযায়ী চক নদীর দুর্ঘটনাটিও ৫ম মাত্রার ছিল।
তথ্যসুত্র – ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং