কয়েকটি অজানা নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ: ১ম পর্ব

সম্প্রতি প্রচারিত মিনি-সিরিজ “Chernobyl” আরও একবার মানুষের সামনে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের ভয়াবহ দিক গুলো সামনে এনেছে। কিন্তু চেরনোবিল ডিজাস্টার এ বিশ্বের একমাত্র নিউক্লিয়ার বিপর্যয় নয়। চলুন চেরনোবিলের মতো  আরও ভয়াবহ কিছু নিউক্লিয়ার ডিজাস্টার সম্পর্কে জেনে আসা যাক।

দ্য কিশতিম ডিজাস্টার

 দ্য কিশতিম ডিজাস্টার
দ্য কিশতিম ডিজাস্টার

১৯৫৭ এর সেপ্টেম্বরের দিকে রাশিয়ার ওজিইয়র্স্ক (Ozyorsk) ছিলো এক বদ্ধ নগরী। শহরটি মায়াক প্ল্যান্টের (Mayak plant) চারদিকে গড়ে উঠেছিলো। প্ল্যান্টটি মূলত নিউক্লিয়ার অস্ত্র ও জ্বালানীর জন্য প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করতো।

১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্ল্যান্ট গঠনের শুরুর দিকে মায়াক প্ল্যান্টের ৬টি রিয়েক্টরের হাই-লেভেল বর্জ্যগুলো সরাসরি কাইজাইলটাস লেকে (Lake Kyzyltash) ফেলা হতো। লেকটি যখন পুরোপুরি নিউক্লিয়ার বর্জ্যে কুলসিত হয়ে গেল, তখন তারা প্ল্যান্টের বর্জ্যগুলো কারাচায় লেকে (Lake Karachay) ফেলা শুরু করে। এ লেকটিও কিছুদিন পর বিষাক্ত হয়ে ওঠে।

ওজিইয়র্স্কের টেরিটোরিয়াল ম্যাপ
ওজিইয়র্স্কের টেরিটোরিয়াল ম্যাপ

১৯৫৩ সালের দিকে কর্মীরা তরল নিউক্লিয়ার বর্জ্য অপসারণের জন্য একটি স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি তৈরি করে। কিন্তু বর্জ্যগুলো ক্রমাগত নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার কারণে ক্রমশ গরম হতে লাগলো। ১৯৫৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, একটি ট্যাংকের কুলার বিকল হয়ে পড়ল। এরকারণে ট্যাংকটি প্রায় ৭০ থেকে ১০০ টন টিএনটি এর সমান শক্তি নিয়ে বিস্ফোরিত হলো। যদিও বিষ্ফোরণে সরাসরি কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, তবু ধারণা করা হয় এই বিষ্ফোরণে প্রায় আনুমানিক ২০ MCi (৮০০ PBq) রেডিওতরঙ্গ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিলো। সিজিয়াম-১৩৭ আর স্টোরিয়াম-৯০ নিয়ে গঠিত ২ MCi (৮০ PBq) রেডিওনিউক্লিডসের একটি গুচ্ছ উত্তরপূর্ব দিকে ধেয়ে গিয়ে প্রায় ৫২ হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চল বিষাক্ত করে তুলেছিলো। এই সুবিশাল এলাকায় তখন প্রায় ৩ লাখের মতন মানুষ বাস করত। জায়াগাটিকে ইস্ট-উরাল রেডিওএক্টিভ ট্রেস, East-Ural Radioactive Trace (EURT) নামে অভিহিত করা হয়।

ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিতে, সাথে সাথেই এলাকাটি খালি করতে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। কিন্তু এক সপ্তাহ পর , ১৯৫৭ এর অক্টোবরের ৬ তারিখ, প্রায় ১০ হাজার মানুষকে তাদের বাসস্থান থেকে সড়ানো হয়েছিলো।

নানান গবষণায় প্রায় ২০০ থেকে ৮ হাজারেও বেশি মানুষ এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলো বলে বলে ধারণা করা হয়। ২০০১ সালের একটি গবেষণায় জানা যায়, এ দুর্ঘটনার কারণে ৬৬ জন মানুষ গুরুতর রেডিয়েশন সিন্ড্রমের কারণে চিকিৎসাধীণ ছিলো।

দ্য উইন্ডস্কেল ফায়ার

উইন্ডস্কেলের রিয়েক্টর
উইন্ডস্কেলের রিয়েক্টর

কিশতিমের দুর্ঘটনার দু’সপ্তাহ যেতে না যেতেই, উইন্ডস্কেল ফ্যাসিলিটির ইউনিট ১ এর দুটি রিয়েক্টরে আগুন লাগে। এই ফ্যাসিলিটিটির অবস্থান ছিলো যুক্তরাজ্যের,কাম্ব্রিয়ার সেলাফিল্ডে।

এই রিয়েক্টর দুটো বানানো হয়েছিলো ব্রিটেনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের চাহিদা মেটানোর জন্য। একটি নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর থেকে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে যে পরিমাণ অর্থ আর সময় খরচ হবে তার থেকে একটি ইউরেনিয়াম প্ল্যান্টে এর থেকে ১০গুণ বেশি খরচ হবে বলেই প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের জন্য নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর তৈরীর সিদ্বান্ত নেওয়া হয়েছিলো।

রিয়েক্টরগুলোর কোর বিশাল গ্রাফাইট ব্লকের ভিতরে ছিলো, যেখানে ফুয়েল কার্টিজের জন্য আনুভূমিক ছিদ্র ছিলো। প্রতিটি কার্টিজ এলুমিনিয়াম দিয়ে ঢাকা ১২ ইঞ্চি লম্বা ইউরেনিয়াম রড দিয়ে গঠিত ছিলো। রিয়েক্টরটিকে ৪০০ ফুট লম্বা চিমনির সাহায্যে পরিচলন পদ্ধতিতে ঠাণ্ডা করা হত।

উইন্ডস্কেলের রিয়েক্টরের ডায়াগ্রাম
উইন্ডস্কেলের রিয়েক্টরের ডায়াগ্রাম

উইন্সটন চার্চিল যখন যুক্তরাজ্যকে হাইড্রোজেন বোমা তৈরীর নির্দেশনা দিলেন, তখন উইন্ডস্কেলের ফুয়েল লোড গুলোতে ট্রিটিয়াম উৎপাদনের জন্য পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় রিয়েক্টরের কোর আরও গরম হয়।

অক্টোবর ১০, ১৯৫৭ এর সকাল বেলায়, কোরের তাপমাত্রা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে লাগলো। ক্রমান্বয়ে সেটা ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌছালো। কুলিং ফ্যান এনে বাতাস  প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো, কিন্তু এতে ঘটনা আরও খারাপের দিকে মোড় নেয়। অতঃপর অপারেটররা বুঝতে পারে কোরে আগুন লেগেছে।

কর্মীরা কোরে প্রথমে কার্বন ডাইঅক্সাইড ব্যাবহার করে , এরপর ব্যবহার করে পানি। কিন্তু কোনোটাই কাজে দিচ্ছিলো না। সবশেষে রিয়েক্টর বিল্ডিংয়ে বাতাস চলাচলের পথ বন্ধ করে আগুন নেভাতে হয়।

আগুনের কারণে যুক্তরাজ্য আর ইউরোপে আয়োডিন-১৩১ এর প্রায় ৭৪০ TBq (২০,০০০ curies), সিজিয়াম-১৩৭ এর ২২ TBq (৫৯৪ curies) এবং জেনন-১৩৩ এর ১২,০০০ TBq (৩২৪,২০০ curies)  রেডিওএক্টিভ রেডিওনিউক্লিডস ছড়িয়ে পড়েছিলো।

উইন্ডস্কেলের সাথে তুলনা করলে, ১৯৮৬ এর চেরনোবিল বিস্ফোরণে এর চেয়ে বেশী আর ১৯৭৯ সালে যুক্তরাস্ট্রের দ্য থ্রি মাইল আইল্যান্ড দুর্ঘটনা  এর চেয়ে প্রায় ২৫গুণ বেশি জেনন-১৩৫ মুক্ত হয়েছিলো। তবে আয়োডিন, সিজিয়াম আর স্ট্রোন্টিয়ামের পরিমাণ কম ছিলো।

আশেপাশের এলাকা থেকে লোকজনকে সড়ানো হয়নি। কিন্তু ধারণা করা হয় যে, এই দুর্ঘটনায় অতিরিক্ত প্রায় ২৪০ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলো। দুর্ঘটনার প্রায় টানা একমাস ধরে পার্শ্ববর্তী ৫০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে উৎপাদিত দুধ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিলো।

দুর্ঘটনার পর এখন পর্যন্ত ট্যাংকটি প্রায় ১৫টন ইউরেনিয়ামসহ সিল করা আছে। রিয়েক্টর কোর চলতে থাকা নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার কারণে এখনো কিছুটা গরম হয়ে আছে। ২০৩৭ সালের আগে এটি পুরোপুরি ঠাণ্ডা হবে না। INES এর রেটিং অনুযায়ী লেভেল-৫ এ উইন্ডস্কেলের আগুন লাগার ঘটনাটির স্থান।

সোভিয়েত সাবমেরিন K-19

K-19 ছিলো সোভিয়েতদের Project 658-class submarine গুলোর একটি। অবশ্য ন্যাটো বাহিনী এদেরকে ডাকতো হোটেল-ক্লাস সাবমেরিন। এগুলো ছিলো নিউক্লিয়ার বালিস্টিক মিসাইল সজ্জিত ফার্স্ট জেনারেশন নিউক্লিয়ার সাবমেরিন।

সোভিয়েত সাবমেরিন K-19
সোভিয়েত সাবমেরিন K-19

এপ্রিল ৩০,১৯৬১ সালে, নিয়োগ প্রাপ্ত K-19 শুরুর থেকেই ঝামেলা করছিলো। জুলাই ৪,১৯৬১ সালে এর প্রথম অভিজানে, গ্রীনল্যান্ডের তীর উপকূলে অনুশীলনকালীন হঠাৎ, লিকেজের কারণে  রিয়েক্টরের কুলিং সিস্টেমের চাপ শুন্যে নেমে আসে।

আপদকালীন SCRAM সিস্টেম প্রায় সাথে সাথেই কন্ট্রোল রড গুলোকে প্রবেশ করায়। কিন্তু ক্ষয় তাপের কারণে , রিয়েক্টরেরর তাপমাত্র বেড়ে ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌছায়। এই দুর্ঘটনায়  সাবমেরিনের ভেন্টিলেশন সিস্টেম বাস্পাকারে ফিশন বস্তু ছাড়ে।

সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন জাহাজীদের একটা নতুন কুলিং সিস্টেম তৈরীর নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু এতে কর্মীদের রেডিওএক্টিভ এরিয়ার ভিতর যেয়ে কাজ করতে হতো। পরে কুলিং ওয়াটার সিস্টেমের কল্যাণে রিয়েক্টর কোর পুরোপুরি গলে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়।

কাছেই থাকা আমেরিকান রণতরী K-19 এর ডিস্ট্রেস অল পেয়ে এদের উদ্ধার করার আহ্বান জানায়। কিন্তু সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন সোভিয়েত মিলিটারীর তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে সাহায্য নিতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপরে K-19 আরেকটি ডিজেল চালিত সাবমেরিনের অভিমুখে যাত্রা করে। এই দুর্ঘটনায় জাহাজটি, এর সব নাবিক আর কিছু বালিস্টিক মিসাইল ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

একমাস যেতে না যেতেই রেডিয়েশন এক্সপোজারের কারণে জাহাজটির ৮জন ক্রু মারা যান। পরবর্তী দু’বছরে আরো ১৫জন নাবিক রেডিয়েশনজনিত রোগে মারা যান। পোর্টে থাকা অবস্থায় K-19 এর আশেপাশের প্রায় ৭০০ মিটার জায়গা এবং যেসব ক্রু এর মেরামতের কাজ করেছিলো তাদের  বিষাক্ত করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত নেভী এটার পরিত্যাক্ত রিয়েক্টরটিকে কারা সাগরে (Kara Sea) ফেলে দেয়।

২০০২ সালে হ্যারিসন ফোর্ড, লিয়াম নিসনের মতন তারকা সমৃদ্ধ K-19: The Widowmaker চলচিত্রটি এই বিপর্যয়ের উপর নির্মিত হয়।

তথ্যসুত্র – ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং

Comments are closed.