পৃথিবীর আকাশে ক্ষণিক জ্বলে ওঠা তারাগুলো যে মিল্কিওয়ে সৌরজগতের শুরুর দিককার নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ এমনটাই আবিষ্কার করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। বিগ-ব্যাংয়ের অল্প কয়েক বিলিয়ন বছর পরেই এসব নক্ষত্র পিণ্ডীভূত হয়ে সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে আর আজকের আমাদের এই সর্পিলাকার সৌরজগত গঠন করেছে।
Nature Astronomy তে প্রকাশিত রিপোর্টে, ইন্সটিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স অফ দ্য ক্যানারি আইল্যান্ডের কারমে গ্যালার্ট বলেছেন,
“নক্ষত্রগুলো মহাবিশ্বের সমান বয়সী।”
রিপোর্টতে প্রথমবারের মতন এসব বহু পুরানো নক্ষত্রগুলোর নিখুঁত বয়স জানা সম্ভব হয়েছে। নক্ষত্র গুলোর বয়স ১০ থেকে ১৩ বিলিয়ন বছর।
“মিল্কিওয়ের ভিতরে সবচেয়ে পুরনো নক্ষত্রগুলোকে খুঁজে বের করার কাজটা বেশ মজার ছিলো। কারণ এদের জন্য আমাদের গ্যালাক্সির অতীতের জানলাটি খুলে গেছে।”
বলছিলেন এই গবেষণা কাজে যুক্ত ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার ক্রিস হ্যারিস।
“সৌরজগতের প্রথমদিককার এসব নক্ষত্রের টিকে থাকাটাই একটা বিস্ময়। এদেরকে যখন চিহ্নিত করা গেছে, তখন সৌরজগতের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে এবার জানা যাবে।”
এসব নক্ষত্রের বয়স, গঠন, অবস্থান আমাদেরকে নানান তথ্য দেয়। যেমন, এসব প্রাচিন নক্ষত্র নিয়ে গবেষণাইয় প্রমাণ পাওয়া গেছে , আমাদের সৌরজগতের প্রথমদিকে এক বিশাল গ্যালাকটিক সংঘর্ষ হয়েছিলো।
আনুমানিক প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর আগে, মিল্কিওয়ে আর গায়া-এনসেলাউডাস নামের এক ছোট সৌরজগতের মাঝে সংঘর্ষটি হয়। আজকের দিনে তারই ছোট ছোট টুকরা নীলচে নক্ষত্র হিসেবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমাদের সৌরজগতের আশেপাশে।
গ্যালাকটিক প্রত্নতত্ত্ব
গ্যালার্ট ও তাঁর দল এসব তথ্য ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির গায়া স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন। মহাকাশে এর অবস্থানের ফলে, গায়া কাছের প্রায় অর্ধ-মিলিয়ন উজ্জ্বল নক্ষত্রদের অবস্থা এবং গতি পর্যবেক্ষণ করেছে।
পৃথিবী থেকে প্রায় ৬৫০০ আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্র গুলোর নিখুঁত দুরত্ব বের করেছে এই স্যাটেলাইটটি। গ্যালার্ট আর তাঁর দল এসব নক্ষত্রের সঠিক ঔজ্জ্বল্য এবং তাদের রঙ নির্ণয় করেছে। সেখান থেকে এই দলটি নক্ষত্রের নানান প্যাটার্ণ বিশ্লেষণ করে এদের বয়স নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছে।

সোজা করে বললে এই টিমটি মহাকাশে দুটো ঘনবসতিপূর্ণী এলাকায় নক্ষত্রদের খুঁজে বের করেছে। যেগুলো কোনটির বয়সই ১০ বিলিয়ন বছরের কম নয়। এক অঞ্চলের নক্ষত্রগুলো লালচে এবং অপরটির গুলো নীলচে রঙের। দুটো শ্রেণীর নক্ষত্রই প্রাথমিক ভাবে মিল্কিওয়ের হ্যালোতে অবস্থান করছে।
“আমাদের চারপাশ জুড়ে এই হ্যালো রয়েছে। একটা বেলুনের ভেতর একটা পিজ্জাকে কল্পনা করুন। পিজ্জাটা হল আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যাআলাক্সি আর এর চারপাশের বেলুনের ভেতরকার বাতাস আর ধুলোবালি হচ্ছে হ্যালোতে অবস্থিত নক্ষত্রগুলো।”
কিভাবে এই হাজার বছরের পুরোনো নক্ষত্রগুলো এ অবস্থানে আসলো সেটা আবার কয়েক বিলিয়ন বছরের পুরানো অজানা গল্পকে জানতে সাহায্য করে।
যেভাবে তৈরি হলো
বয়স্ক লালচে নক্ষত্রগুলো মহাবিশ্বের অস্তিত্বে প্রথম বিলিয়ন বছরের মাঝে গঠিত হওয়া শুরু করে। গ্যাস, ধুলো, ধাতু জমে আরও আদিম স্টেলার পপুলেশনে যুক্ত হয়। এসব নক্ষত্র একে অপরের সাথে আটকে আদিম মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি তৈরি করে।
আরও তিন বিলিয়ন বছর ধরে এই আদি মিল্কিওয়ে আস্তে আস্তে আরো গ্যাস জমা করে নিউক্লিয়ার ফার্নেসের মাধ্যমে সূর্যের মতন নক্ষত্র তৈরি করে। আকারে মিল্কিওয়ের প্রায় ৩০% ডর্ফ গ্যালাক্সিও একই প্রক্রিয়ায় এর থেকে বড় প্রতিপক্ষের কাছে গ্রাস হয়।
বর্তমানে হারানো এই গ্যালাক্সির নীলচে নক্ষত্রগুলো মিল্কিওয়ের হ্যালোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের একটি আলাদা কেমিক্যাল সিগিনেচার রয়েছে , অনেকটা আংগুলের ছাপের মতন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এ সিগনেচারের মাধ্যমে বুঝতে পারেন এরা মহাবিশ্বের অন্য অঞ্চল থেকে এসেছে এবং অন্য পরিমাণ ধাতু দিয়ে তৈরি।
এসব নীলচে নক্ষত্রদের গতি প্রকৃতিও আলাদা। এদের নিয়ে একই কথা বলেছেন ইউনিভার্সিটি অফ জর্জিয়ানার আমিনা হেলমি ও তাঁর সহকর্মীরা।
আকার পরিবর্তন যেভাবে হলো
ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার জ্যোতির্বিদ নিতিয়া ক্যাল্লিভায়ালিল, যিনি মিল্কিওয়ের মিথষ্ক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেছেন,
গ্যালার্টের টিম গায়া-এনসেলাডাউসের সঙ্ঘর্ষের গুরুত্বপুর্ণ প্রমাণ আবিষ্কার করেছেন, যেটা আমাদের গ্যালাক্সির আকার পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে।
গ্যালাকটিক ডিস্কের হ্যালোতে অবস্থান করা এসব প্রাচীন লালচে নক্ষত্র গুলো এখনো টিকে আছে। এমনকি পৃথিবী থেকে সাধারণ টেলিস্কোপের মাধ্যমে এদের কয়েকটিকে দেখা সম্ভব। এই সঙ্ঘর্ষের ফলে একত্রিত হওয়া নতুন গ্যালাক্সি থেকে যে গ্যাস নির্গত হয়েছে, সেগুলো সাময়িক কিন্তু অতিদ্রুত গ্যালাকটিক ডিস্কে নক্ষত্র গঠন করেছে।
যদিও এই সংঘর্ষ কেন ঘটেছিলো তা এখনো জানা যায়নি, তবুও এই সঙ্ঘর্ষ আমাদের সৌরজগতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ছিলো।
তথ্যসুত্র – ন্যাশনাল জিওগ্রাফীক ডট কম