পার্টিকেল এক্সিলারেটর হলো একধরনের যন্ত্র যা কোন চার্জিত কণার গতিশক্তি বৃদ্ধি করে এগুলোকে প্রক্ষেপক বা মিসাইল হিসেবে ব্যবহার করে কোন বস্তুকে উচ্চগতিতে আঘাত করা হয়। আঘাত করে পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভাঙা এবং নিউক্লয়নের ট্রান্সমিউটেশন ঘটানো হয়। এখানে চার্জিত কণা বলতে ইলেকট্রন, প্রোটন, আলফা পার্টিকেল, ডিউটেরন বোঝানো হয়েছে। এই এক্সিলারেটর গুলো এখন নিউক্লিয়ার সাইন্স এবং হাই-এনার্জি পার্টিকেল ফিজিক্স এর একটি ব্যাসিক উপকরণে পরিনত হয়েছে। উচ্চশক্তির এসব কণা দিয়ে নিউক্লিয়ার রিয়্যাকশন ঘটিয়ে একদিকে যেমন বিভিন্ন নতুন কণা আবিষ্কৃত হয়েছে তেমনি নিউক্লিয়াসের জটিল গঠন সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও উদ্ভাবিত হয়েছে। নিউক্লিয়ার ফোর্স কিভাবে নিউক্লিয়ন গুলোকে একসাথে আবদ্ধ করে রাখে তাও উদ্ভাবিত হতে সাহায্য করেছে এই যন্ত্র । এই প্রবন্ধে আমরা বিভিন্ন প্রকার পার্টিকেল এক্সিলারেটর এবং এগুলোর ব্যাসিক ক্রিয়াকৌশল সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করব।
এই এক্সিলারেটরের ডিজাইন এবং গঠন কয়েকটি বিষয়ের সমন্বয়ে হয়, এখানে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিক এবং ভ্যাকুয়াম টেকনিক যেমন ব্যবহৃত হয় তেমনি মেকানিক্যাল এবং বিশুদ্ধ পদার্থবিজ্ঞান ও ব্যবহৃত হয়।
বর্তমানে প্রধানত তিন ধরনের এক্সিলারেটর প্রচলিত আছেঃ
১.স্ট্যাটিক
২.লিনিয়ার এবং
৩. সার্কুলার
স্ট্যাটিক এক্সিলারেটর বা স্ট্যাটিট্রন
এই প্রকার এক্সিলারেটর হলো ভ্যান ডি গ্রাফ জেনারেটর ( Van de Graaff Generator). এটি একটি কণাকে 12MeV পর্যন্ত শক্তিতে ত্বরিত করতে পারে। এটি সাধারণত ইলেকট্রন, প্রোটন, ডিউটেরন এবং আলফা-পার্টিকেলের মতো চার্জিত কণাকে ত্বরিত করতে ব্যবহৃত হয়।
লিনিয়ার এক্সিলারেটর বা লিনিয়াক
এটি ইলেকট্রনকে প্রায় 40 GeV এবং প্রোটনকে 50MeV শক্তিতে ত্বরিত করতে পারে।
সার্কুলার এক্সিলারেটর
এটি আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমনঃ
(i)লরেন্স সাইলোট্রন বা ফিক্সড- ফ্রিকোয়েন্সী সাইলোট্রনঃ এটি প্রোটন, ডিউটেরন এবং আলফা-পার্টিকেলকে 40MeV পর্যন্ত শক্তিতে ত্বরিত করতে পারে।
(ii)সিনক্রোসাইলোট্রন বা ফ্রিকোয়েন্সী- মডুলেটেড সাইলোট্রনঃ এটি লরেন্স সাইলোট্রনের মডিফাইড ভার্সন এবং কণাকে তুলনামূলক বেশি শক্তিতে ত্বরিত করতে সক্ষম।
(iii) বিটাট্রনঃ এটি ইলেকট্রনকে ত্বরিত করতে ব্যবহৃত হয় এবং 300MeV শক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম।
(iv) ইলেকট্রন সাইলোট্রনঃ এটি বিটাট্রনের মডিফাইড ভার্সন এবং ইলেকট্রনকে 6GeV পর্যন্ত শক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম।
(v) প্রোটন সাইলোট্রনঃ এটি কার্যক্রমের দিক থেকে ইলেকট্রন সাইলোট্রন এর মতো কিন্তু প্রোটনকে শক্তি দিতে পারে এবং প্রায় 10GeV শক্তি দিতে পারে এটি।
(vi) আল্টারনেটিং গ্রাডিয়েন্ট সিনক্রোট্রনঃ Alternating Gradient Synchrotron (AGS) একটি প্রোটন এক্সিলারেটর এবং প্রোটনকে উচ্চ শক্তি দিতে পারে। মস্কোর USSR এর AGS টি 70 GeV শক্তির প্রোটন উৎপাদন এর সক্ষমতা নিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে। শিকাগোর ওয়েস্টনে অন্য আরেকটি AGS তৈরি করা হচ্ছে যেটি প্রায় 200 GeV শক্তির প্রোটন সৃষ্টি করতে পারে।
(vii) অমনিট্রন (Omnitron)ঃ এটি এমন একটি এক্সিলারেটর যা প্রায় হাইড্রোজেন থেকে ইউরেনিয়াম সকল কণার ত্বরিত বিম সৃষ্টি করতে পারে। এমন এক্সিলারেটর USA তে নির্মানাধীন। এটি হালকা কণাগুলোকে প্রায় 500 MeV এবং ইউরেনিয়াম এর মতো ভারি কণাকে প্রায় 300 MeV শক্তি সরবরাহ করতে পারবে। এটির বিম প্রতি সেকেন্ডে 10^12 টি কণা উৎপাদনে সক্ষম হবে।
Stanford Linear Accelerator Laboratory (SLAC)
লিনিয়ার এক্সিলারেটর
লিনিয়ার এক্সিলারেটরে কণা একটি লম্বা বায়ু শূন্য কপার টিউবের ভিতর দিয়ে চলনা করা হয়। Klystron নামক জেনারেটরের সাহায্যে কণার বিম জেনারেট করা হয়। ইলেক্ট্রোম্যাগনেট এর সাহায্যে এই বিমকে সুক্ষ ধারায় পরিণত করা হয়। যখন কণার এই বিম টিউবের শেষ প্রান্তে অবস্থিত টার্গেটে আঘাত করে তখন এই ঘটনা কয়েকটি ডিটেক্টরের সাহায্যে রেকর্ড করা হয়। এবং একই সাথে যেসব সাবএটোমিক কণা তৈরি হয় সেগুলো ও সনাক্ত করা হয়। এই এক্সিলারেটর গুলো আকারে অনেক বড় হয় এবং মাটির নিচে তৈরি করা হয়। এমন একটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর হলো ক্যালিফোর্নিয়ার Stanford Linear Accelerator Laboratory (SLAC) এটি প্রায় ১.৮ মাইল বা ৩কিমি লম্বা।
সার্কুলার এক্সিলারেটর
এটি আসলে লিনিয়ার এক্সিলারেটরের মতো একই কাজ করে কিন্তু এটি লম্বা লিনিয়ার ট্র্যাক এর পরিবর্তে একটি সার্কুলার পথে কণাটিকে কয়েকবার চালনা করা হয়।প্রতি বার চালনা করার সময় এর ম্যাগনেটিক ফিল্ড আগের তুলনায় বেশি শক্তিশালী করা হয় যেন কণার বিমকে যথেষ্ট শক্তিতে ত্বরিত করতে পারে। প্রথম তৈরি সাইলোট্রন ৪ইঞ্চি ব্যাসের ছিল। বর্তমানের একটি সাইলোট্রন হলো ইলিনয়ে অবস্থিত Fermi National Accelerator Laboratory ( Fermilab) এটি প্রায় ১০ বর্গমাইল( ২৫.৬ বর্গকিমি) নিয়ে বিস্তৃত।
CERN
ইউরোপিয়ান নিউক্লিয়ার রিসার্চ অরগানাইজেশন(European Organization for Nuclear Research) এর ফ্রেন্স ভার্সন(Conseil européen pour la recherche nucléaire) এখানে পদার্থবিদ এবং ইঞ্জিনিয়ার রা মহাবিশ্বের গঠন এবং ফান্ডামেন্টাল কণিকা নিয়ে গবেষণা করে।এখানে পৃথিবীর সবথেকে বড় এবং জটিল যন্ত্র ব্যবহার করা হয় এসব গবেষণায়।এসব গবেষণা পদার্থবিদদের বিভিন্ন কণিকা কিভাবে পরস্পরের সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট করে এবং প্রকৃতির মৌলিক নিয়ম গুলো কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে ধারণা দেয়।
CERN এ যে যন্ত্র ব্যবহৃত হয় সেগুলো হলো পার্টিকেল এক্সিলারেটর এবং ডিটেক্টর। পার্টিকেল এক্সিলারেটর কণা বিম সৃষ্টি করে এবং এই বিম নির্দিষ্ট টার্গেটে আঘাত করে এবং ডিটেক্টর গুলো এ ঘটনা বিস্তারিত শনাক্ত করে। উপরে যে পার্টিকেল এক্সিলারেটরের কাজ বর্ননা করা হয়েছে সেগুলোই CERN এ ব্যবহৃত হয়।
CERN এ বর্তমানে যে এক্সিলারেটর গুলো ব্যবহৃত হয় তার কয়েকটি হলোঃ
লিনিয়ার এক্সিলারেটর ২(Linear accelerator 2)
Linac 2 এটি CERN এ পদার্থ বিদ্যার গবেষণায় প্রোটন ত্বরিত করার স্টার্টিং পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
লিনিয়ার এক্সিলারেটর ৩(Linear accelerator 3)
Linac 3 এটি পদার্থ বিদ্যার গবেষণায় আয়ন তৈরির স্টর্টিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে।
লিনিয়ার এক্সিলারেটর ৪(Linear accelerator 4)
Linac 4 নেগেটিভ হাইড্রোজেন আয়নকে উচ্চ শক্তিতে ত্বরিত করে। ২০২০ সাল থেকে এটি LHC এর প্রোটন বিমের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
দি অ্যান্টিপ্রোটন ডিসিলারেটর(The Antiproton Decelerator)
সকল এক্সিলারেটর কণার গতিশক্তি বৃদ্ধি করতে ব্যবহৃত হয় না। AD অ্যান্টিপ্রোটনের গতি কমাতে ব্যবহৃত হয় যে তা অ্যান্টিম্যাটার গবেষণায় ব্যবহৃত হতে পারে।
দি লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার(The Large Hadron Collider)
২৭কিমি লম্বা LHC পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পার্টিকেল এক্সিলারেটর এটি আলোর কাছাকাছি গতির প্রোটন এবং লেড আয়নের সংঘর্ষ ঘটায়।
দি লো এনার্জি আয়ন রিং(The Low Energy Ion Ring)
LEIR Linac 3 থেকে লং পাল্সের লেড আয়ন সংগ্রহ করে শর্ট,ঘনিভুত করে LHC তে ব্যবহারের উপযোগি করে তোলে
দি প্রোটন সিনক্রোট্রন(The Proton Synchrotron)
এটি CERN এর একটি workhorse হিসেবে কাজ করে এবং এটি সেই তৈরি পর থেকে বিভিন্ন কণার মিশ্রণ কারক হিসেবে কাজ করে আসছে।
দি প্রোটন সিনক্রোট্রন বুস্টার (The Proton Synchrotron Booster)
চারটি সুপারইমপোজড সিনক্রোট্রন রিং লিনিয়ার এক্সিলারেটর থেকে প্রোটন গ্রহণ করে এবং এগুলোকে 800MeV শক্তিতে উন্নিত করে প্রোটন সিনক্রোট্রন এ সরবরাহ করে।
দি সুপার প্রোটন সিনক্রোট্রন (The Super Proton Synchrotron)
এটি CERN এর দ্বিতীয় বৃহত্তম মেশিন। এটি প্রোটন সিনক্রোট্রন এবং LHC এর মধ্যবর্তী ধাপ হিসেবে কাজ করে।