গত ২ অক্টোবর তারিখে ঘোষণা দেয়া হয়ে গেল ফিজিক্স বা পদার্থবিজ্ঞান ক্ষেত্রে দেয়া নোবেল পুরষ্কারের।
যেমনটা আমরা জানি, প্রতিবছরই নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় নির্দিষ্ট কোনো ক্ষেত্রে এক বা একাধিক ব্যক্তির উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার কারণে। আর এবারের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল দেয়া হয় যে দুইটি ক্ষেত্রের উপর নির্ভর করে তার একটি হল Optical Tweezers (Arthur Ashkin/50%, Bell Laboratory, USA) এবং অন্যটি দেয়া হয় Ultrashort Pulse এর ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্যে।
আর আজকের আমাদের আয়োজন হল এই Ultrashort Pulse নিয়েই।
পুরষ্কারের অর্ধাংশ প্রদান করা হয় এই Ultrashort Pulse অবদান রাখার জন্যে যার একটি ভাগে রয়েছে ফ্রান্সের École Polytechnique ও আমেরিকার University of Michigan এর গবেষক Gérard Mourou
আর অপরভাগে রয়েছে Candaর University Of Waterloo এর Donna Strickland ।

উভয়কেই পুরস্কৃত করা হয় এপর্যন্ত রেকর্ডকৃত সবচাইতে ক্ষুদ্র লেজার পালস সফলভাবে উৎপন্ন করা এবং তার পদ্ধতির জন্যে।
তো কথা হল জনসাধারণের মনে বা এমনকি বিজ্ঞানমনষ্কদের মনেও সাধারণ অর্থে প্রশ্ন আসতে পারে,
কি এই Ultrashort Pulse যার জন্যে একেবারে নোবেল পুরষ্কারই পেয়ে গেলেন এরা দুইজন!
কিই বা এর ব্যবহার?! আদতে মানবসভ্যতায় এর অবদানই বা কি হবে!
আর তাই, বিষয়টা নিয়ে আলোচনার জন্যেই আজকের আমাদের এই আয়োজন।
প্রথমেই আসি পালস কি, সেপ্রসঙ্গে।
পদার্থবিজ্ঞানে পালস হচ্ছে একধরণের তড়িৎচৌম্বকীয় শক্তি যা কোনো উৎস থেকে একটা ধাক্কার সাথে বের হয়। তাই একে Electromagnetic Pulse বা EMPও বল হয়। (EMPর ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পড়ে আসতে পারেনঃ https://bigganbortika.org/emp-technology-and-curse/)
যেহেতু আলোও উৎসঅনুসারে একধরণের তরঙ্গ, এটিরও আর সকল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক শক্তির মত নিজস্ব পালস বা ধাক্কা রয়েছে। আর আলট্রাশর্ট পালস হচ্ছে তেমনি খুবই উচ্চপর্যায়ের পালস বা শক্তির বিচ্ছুরণ।
উল্লেখ্য তরঙ্গ আর পালস এক নয়, পালসকে সহজভাষায় তরঙ্গের ধাক্কা বলা যায়, যা তরঙ্গের দৈর্ঘ্য (তরঙ্গের একটি চুড়া/Crest থেকে আরেকটি চুড়ার দূরত্ব বা একটি খাদ/Trough থেকে আরেকটি খাদের দূরত্ব), তরঙ্গের মধ্যরেখা হতে এর প্রশস্ততা (Amplitude), তরঙ্গের Crest ও Through এর সমন্বিত প্রশস্ততা বা ভাইব্রেশন/Vibration ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। পালস আর তরঙ্গ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে প্রতি সেকেন্ডে কোনো উৎস, কি পরিমাণ তরঙ্গ বিচ্ছুরিত করছে (প্রতি তরঙ্গ = হার্জ) বা একটি সাইকেল পূরণ করছে তার উপর পালসও নির্ভর করে।
ব্যাপারটা উল্টোভাবেও বলা যায়, – প্রতিটা তরঙ্গ বিচ্ছুরিত হবার জন্যে কতটুকু সময় নিচ্ছে তার উপর পালসও নির্ভর করে। কোনো তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য (wavelength) কম মানে সে তুলনামূলক অল্প সময়ের ব্যবধানে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আর আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুবই কম (ন্যানোমিটার হিসেবে) হওয়াতে প্রতিসেকেন্ডে এর বিচ্ছুরণের হারও বেশি। ফলে আলোকরশ্মির বেলায় সৃষ্ট প্রতিটা পালসের সময়কালও খুব কম!
ব্যাপারটা ঠিক এমন যে কেউ একজন পাঞ্চিং ব্যাগে প্রতি সেকেন্ডে ঘুষি দিচ্ছে যেখানে তার মুষ্টিবদ্ধ হাত হচ্ছে তরঙ্গ এবং তা থেকে যে ঘুষিটা গিয়ে লাগছে ব্যাগে তা হচ্ছে একেকটা পালস। প্রতি সেকেন্ডে ঘুষি বাড়ছে, বাড়ছে পালস!
লোকটা যত দূর থেকে ব্যাগে ঘুষি দিচ্ছে তত ব্যাগ থেকে তার পরবর্তী ঘুষির জন্য ভাঁজ করে নিয়ে আসা হাতের সময় বাড়ছে, যাকে আমরা তরঙ্গদৈর্ঘ্য ধরতে পারি। একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে কাছাকাছি এসে ঘুষি দিলে একটা ঘুষি থেকে আরেকটা ঘুষির সময় কম লাগছে। বাড়ছে প্রতি সেকেন্ডে ঘুষির তীব্রতা!
Ultrashort Pulse ও ঠিক তেমনি। প্রতি সেকেন্ডে এর হার অনেক অনেক বেশি। বা অন্যভাবে বললে বলতে হয় এদের প্রতিটা পালস এর সময়কাল প্রতিটা সেকেন্ড এর বহু কোটি ভাগের এক ভাগ মাত্র! তাই আল্ট্রাশর্ট পালস এর ব্যপ্তি ধরা হয় Picoseconds ও Femtoseconds এর হিসেবে। কত ছোট এই হিসেব জানেন?
পিকোসেকেন্ড হল এক সেকেন্ড সময়কালের এক লক্ষ কোটি (১,০০০,০০০,০০০,০০০) ভাগের এক ভাগ!
আর ফেমতোসেকেন্ড হল এক সেকেন্ড এর দশ কোটি কোটি (১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০) ভাগের একভাগ মাত্র!
কি? মাথা চক্কর দেয়ার মত তাইনা?!
সময়ের এই অকল্পনীয়রকমের ক্ষুদ্রভাগে এমন প্রতিটা পালস উৎপন্ন হয়। এর এই সময়কালের ক্ষেত্রেই আগের যেকোনো রেকর্ড ব্রেক করা অতি অতি স্বল্প সময়ব্যাপী পালস সফলভাবে উৎপন্ন করার মত অকল্পনীয় সূক্ষ্ম কাজের জন্যেই এবারের নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় এই ক্ষেত্রে।
অকল্পনীয় ক্ষণস্থায়ী এই পালস তৈরির জন্যে তারা ব্যবহার করেছেন Chirped Pulse Amplification (CPA) নামক প্রযুক্তিটি।
এই প্রযুক্তিতে প্রথমে একটি লেজার থেকে শর্ট লাইট পালস ছোড়া হয়, একটি বিশেষ রিফ্লেক্টরের মাধ্যমে একটি Pulse Stretcher এ পড়ে। ফলে সেটি থেকে বের হওয়া পালস/সেকেন্ড এ আরো স্ট্রেস বা প্রসারিত হয়ে বের হয়ে অ্যামপ্লিফায়ার এ প্রবেশ করে। সেখানে থেকে আবার পালসটি এ্যামপ্লিফাই বা প্রশস্ত হয়ে বিচ্ছুরিত হয় এবং আবার আরেক বিশেষ প্রতিফলক (Reflector) এর মাধ্যমে একটি Pulse Compressor এ আপতিত হয়। এবং সেখান থেকে যখন পালসটি বের হয়, তখন তার সময়কাল অকল্পনীয়রকমের কমে যায়!
এই কাজেতে প্রতিফলকগুলো মূলত আলোবিভাজক (Grating) হিসেবে কাজ করে যেখানে আলো ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুযায়ী বিভাজিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সম্প্রসারক Grating গুলো পজিটিভ বা ধনাত্মক বর্ণবিচ্ছুরণ (Dispersion) ও সংকোচক Grating ঋণাত্মক বা নেগেটিভ বর্ণবিচ্ছুরণ এর কাজ করে। আলোকবিজ্ঞানে Dispersion হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কোনো একটি মাধ্যম দিয়ে যাবার সময় তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুযায়ী আলোর ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের বিচ্ছুরণের সময়ে পার্থক্য ঘটে থাকে। এই পার্থক্য আপাতদৃষ্টি খুবই সামান্য কিন্তু লেজার পালস এর মত বেলায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রক্রিয়ায় পালসটি Amplifier এর ভেতরে যাবার আগে একে প্রসারিত (Stretched) করে নেয়াটা অনেকগুলো কারণে জরুরী।
প্রশ্ন আসতে পারে পালসটিকে সংকুচিত করার আগে আবার প্রাথমিক অবস্থার তুলনায় প্রসারিত করাটা জরুরী কেনো?
কারণ এতে করে পালস এর Pick power কমিয়ে এনে পালস এনার্জি বা শক্তি একইরকম রাখা যায়, ফলস্বরুপ পুরো প্রক্রিয়ার শেষে গিয়ে অত্যন্ত তীব্র (High Intensity) পালস পাওয়া যায়। এছাড়া এই কৌশলটি পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিকে ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে বাচায়। তাই এমপ্লিফায়ারে প্রবেশের আগে পালসটিকে প্রসারিত করে ফেলাটা অত্যন্ত জরুরী। কেননা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে যে পালস্টি বিচ্ছুরিত হয় তার তীব্রতার সাথে পৃথিবীর কোনো কিছুর তীব্রতারই তুলনা চলেনা! চূড়ান্ত পর্যায়ের পালসটি পেটাওয়াট (১ পেটাওয়াট = ১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০/ দশ কোটি কোটি ওয়াট!) পর্যায়ের ক্ষমতার সমান হয়ে থাকে যা কেবল তারাদের বেলাতেই চিন্তা করে কুলানো যায়!
সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে এব্যাপারটায় খুবই চাতূর্য্যপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করাটা জরুরী ছিল।
ব্যাপারটা পড়তে খুব সহজ বা সাধাসিধে মনে হলেও ব্যাপারটা আদতে তা ছিল না। এই গবেষণায় জেরার্ড মুরু ও ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড তাদের জীবনের কয়েক দশক লাগিয়ে দিয়েছেন!
সময়ের এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্থায়িত্বের আর এমন অকল্পনীয় তীব্রতার পালস তৈরি করাটা মানবসভ্যতার পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ছিল। এবং বলা বাহুল্য নোবেলের মত সর্বোচ্চ পুরষ্কার পাবার যথাযোগ্য দাবিদারও ছিল বটে।
অতিসূক্ষ্ম লেজার পালস নিয়ে গবেষণা অনেকদিনের হলেও জেরার্ড আর ডোনা’র গবেষণালব্ধ ফলাফল আগের সব বাধই ভেঙেছে। একটা পালসের স্থায়িত্বকে সেকেন্ডের কোটি কোটি ভাগে নিয়ে যেতে পারা আর তার ফলে অকল্পনীয়রকমের তীব্র এক লেজার বিচ্ছুরণ পাওয়াটা আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে হয়তো স্রেফ পাগলামো বা অর্থহীন কিছু, কিন্তু এর সাথে জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চার অনেককিছুই সম্পৃক্ত!
Ultrashort Pulse এর উপযোগিতা কি?!
যেমনটা উপরেই বলেছি, আপাতদৃষ্টিতে এটি মনে হতে পারে অর্থহীন, দুইজন বিজ্ঞানীর নিতান্তই নিজের ঝোঁক কিন্তু আদতে কিন্তু তা নয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিষ, যেগুলো আমাদের গোটা সৃষ্টির একেবারে মৌলিক বিষয়গুলোর সাথে সম্পৃক্ত সেগুলোর কিছু আয়ত্তে আসা মানে অনেক কিছুর গোড়াতে চলে যাবার মত, অনেক কিছু একেবারে গোড়া থেকে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যায়ে পরিবর্তন করার মত। এখন চিন্তা করুন যদি হঠাৎ করে পৃথিবীর সমস্ত ভাষা থেকে A এবং এর সমোচ্চরিত বর্ণ উঠে গেছে কারো মাথায় A এর জ্ঞানই নেই তাহলে কি পরিমাণ শব্দ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে!
ভাবা যায়?!
ঠিক তেমনি, পদার্থের গোঁড়ার বিষয়গুলো কিন্তু নির্ভর করে কতগুলো কণা, তরঙ্গ, শক্তি আর এদের সাথে সম্পৃক্ত নিয়মের উপর।
Ultrashort Pulse এর এমন সূক্ষ্ম প্রয়োগও মানবপ্রযুক্তির সামনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
স্রেফ একবার ভাবুন তো লেজার পদ্ধতি কি কি কাজে লাগে?
চিকিৎসাব্যবস্থা থেকে শুরু করে আন্তর্পারমাণবিক কণাসমূহের পরীক্ষণ, ইলেকট্রনের মত চিররহস্যময় কণার আচরণ অনুধাবন, সামরিক প্রযুক্তি, কম্পিউটার প্রযুক্তিসহ বহু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রযুক্তির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই লেজার প্রযুক্তি।
তাই এমন ক্ষুদ্রতর পর্যায়ে পরিবর্তন বৃহত্তম পর্যায়ে প্রযুক্তির উন্নতি সাধনে বড় ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে।
নিউরোসার্জারির মত অত্যন্ত জটিল বিষয়ে নিয়ে আসতে পারে যুগান্তকারী পরিবর্তন। পারমাণবিক পরীক্ষণসমূহে এই প্রযুক্তি একেবারেই নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে, পারে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বহুবিধ বস্তুর প্রক্রিয়াজাতকরণ (Material Processing) সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যায়ে নিয়ে যেতে।
Microtexturing, Tissue Engineering আর Nano – Processing এর মত অত্যন্ত সূক্ষ্ম আর জটিল ক্ষেত্রেও ফেমতোসেকেন্ড লেজার সুদৃঢ় সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে।
Ultrashort Pulse এর ব্যবহার ও উপযোগিতা নিয়ে তাই আগামীতে প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিক খাতে দৃঢ় আশা রয়েছে। যার কার্যকরী দিক আমরা হয়তো খুব শীঘ্রই দেখতে পাবো।
Ultrashort /Femtosecond Pulse নিয়ে আজ আমাদের আলোচনা এপর্যন্তই। আগামীতে হয়তো ফিরবো আবারো নতুন কোনো বিষয় নিয়ে। ততক্ষণে সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন, নিজের খেয়াল রাখুন এবং বিজ্ঞানবর্তিকার সাথেই থাকুন…
তথ্যসূত্র: nobelprize.org ,forbes.com