করোনা ট্টিটমেন্টে প্লাজমা থেরাপি

প্লাজমা কি???

রক্ত থেকে শ্বেত রক্তকণিকা, লোহিত রক্তকণিকা, অনুচক্রিকা এবং অন্যান্য কোষীয় উপাদান আলাদা করার পর হালকা হলুদ রঙের যে তরল অংশ অবশিষ্ট থাকে সেটিই হল প্লাজমা। এটি মানুষের রক্তের বৃহৎ একটি অংশ, শতকরা ৫৫ ভাগ। এতে রয়েছে পানি, অ্যান্টিবডি, খনিজ উপাদান এবং প্রোটিন। প্রায় ১০০ বছর আগে Emil Adolf von Behring শারীরতত্ত্ব এবং মেডিসিনে প্রথম নোবেল পুরষ্কার পান। তিনি দেখান যে, ডিপথেরিয়া চিকিৎসায় প্লাজমা ব্যবহার করা যায় (ডিপথেরিয়া অ্যান্টিটক্সিন)

কনভালেসেন্ট প্লাজমা

মানবদেহে যখন কোনো জীবাণু প্রবেশ করে তখন স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের রোগ প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং প্রস্তুত হয় অ্যান্টিবডি। এই অ্যান্টিবডি শরীরের রোগ-জীবাণুকে প্রতিরোধ করে, ধ্বংস করে এবং প্রত্যাহার করে। একজন আক্রান্ত রোগী সুস্থ হলে তার শরীরের প্লাজমাকে কনভালেসেন্ট প্লাজমা বলা হয় যার মধ্যে উক্ত জীবাণুর নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি থাকে। এই প্লাজমা যদি একই জীবাণুতে আক্রান্ত অন্য রোগীর দেহে সঞ্চালিত করা হয় তাহলে একইভাবে উক্ত রোগীর শরীরেও এই অ্যান্টিবডি রোগ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। কিছু গবেষক এবং চিকিৎসক, করোনা থেকে সেরে উঠা রোগীর প্লাজমা ব্যবহার করে করোনায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা আরম্ভ করেছে। যারা কোভিড-১৯ হতে সুস্থ হয়েছেন, তাদের শরীরে করোনা ভাইরাস বিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে থাকে। যেটি করোনা ভাইরাসকে শনাক্ত করতে সক্ষম এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থাও তৈরি করতে পারে।

থেরাপি যেটি ১০০ বছর ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে

আসলে প্লাজমা থেরাপি বা অ্যান্টিবডি থেরাপির চিন্তাটি কোথা থেকে এসেছে? সেটি জানার জন্য আমাদের ১০০ বছর পেছনে যেতে হবে। এই থেরাপির আইডিয়াটি আসে ১৯ শতকে। যখন ফিজিওলজিস্ট Adolf Von Behring এবং ব্যাকটেরিয়োলজিস্ট Kitasato Shibasaborou আবিষ্কার করেন যে, ডিপথেরিয়ার চিকিৎসায় প্লাজমাতে বিদ্যমান অ্যান্টিবডির ব্যবহার সম্ভব।

তখন থেকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্লাজমা বা অ্যান্টিবডি থেরাপিটি ব্যবহার হয়ে আসছে। এ পদ্ধতিটি ব্যাকটেরিয়াল এবং ভাইরাল ইনফেকশন উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার সম্ভব । উদাহরণস্বরূপ- মেনিনজাইটিস, নিউমোনিয়া, হাম ইত্যাদি

১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর মহামারি এবং ১৯৩০ এর দশকে হামের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছিল। একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে ইবোলা, সার্স এবং ‌’এইচ-ওয়ান-এন-ওয়ান’ এর মতো রোগের চিকিৎসায়ও এটি ব্যবহার করা হয়েছে।

Adolf Von Behring

প্লাজ়মা কনভালসেন্ট থেরাপি বা প্লাসিড (কনভালসেন্ট প্লাজ়মা টু লিমিট কোভিড-১৯ অ্যাসোসিয়েটেড কমপ্লিকেশনস ইন মডারেট ডিজিজ)

করোনা ট্রিটমেন্টে যে প্লাজমা থেরাপি করা হয় সেটি হল, সদ্য করোনা থেকে সেরে উঠা ব্যক্তি হতে প্লাজমা সংগ্রহ করে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয়। এ চিকিৎসায় রোগীর অ্যান্টিবডি বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। তবে এখনো পর্যন্ত করোনা চিকিৎসায় নির্দিষ্ট কোন ঔষধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। ২০২০ এর ফেব্রুয়ারি মাসেই চীনের চিকিৎসকরা মুমূর্ষু কোভিড রোগীদের প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করে। যা ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশান জীবনরক্ষাকারী বলে মন্তব্য করেছে। আমেরিকা, ব্রিটেন সরকার মুমূর্ষু কোভিড রোগীর জন্য প্লাজমা থেরাপি পরীক্ষার জন্য অনুমতি দিয়েছে। ৮মে ভারতের মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল এই পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই প্লাজমা থেরাপির পরীক্ষা করা হচ্ছে।

কাদের প্লাজমা থেরাপি করা হয়?

যেসব করোনা রোগীর সাধারণ চিকিৎসায় তেমন কোনো ফল হয় না এবং ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অন্যান্য ঔষধে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না তাদের ক্ষেত্রে এ প্লাজমা থেরাপিটি দেওয়া হয়। এসব রোগীদের অনেকেরই এআরডিএস হতে দেখা যায় (Acute Respiratory Distress Syndrome)। এর কারণে রোগীর ফুসফুসের অবস্থা খারাপ হয়ে যায় এবং তাদের জন্য কৃত্রিম পরিবেশের দরকার হয়। যেমন- শ্বাস-প্রশ্বাস এর জন্য ভেন্টিলেটর। কারণ এসব রোগীর প্রায়শই অঙ্গ বা অরগান বিকল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এ থেরাপিটি অন্যান্যদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়, যাদের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের থেকে বেশি – ডায়াবেটিস রোগী, হৃদরোগী এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন ব্যক্তি। সংকটপূর্ণ মুহূর্তে এই পদ্ধতি কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

কারা ব্লাড বা প্লাজমা ডোনেশনের উপযুক্ত?

রক্তঘটিত রোগ বিশেষজ্ঞ, ডাঃ গুলজার এর বক্তব্য অনুসারে যারা ইতিমধ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন এমন যেকোনো ব্যক্তিই হতে পারেন সম্ভাব্য প্লাজমা ডোনার বা প্লাজমাদাতা। আগে কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিলেন আর এখন পরপর দুবার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ প্রমাণিত হয়েছেন এবং নেগেটিভ হওয়ার পর কমপক্ষে ১৪ দিন (কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২৮ দিন) কোনো উপসর্গ দেখা দেয়নি এমন ব্যক্তিই হতে পারেন প্লাজমাদাতা। প্লাজমা দানের আগে নিশ্চিত হতে হবে যে তাঁর শরীরে যথেষ্ট মাত্রায় অ্যান্টিবডি উৎপাদিত হয়েছে কি না। এ জন্য অ্যান্টিবডি টাইটার পরীক্ষা করা হয়। আমাদের দেশের নীতিমালা অনুযায়ী ১: ১৬০ টাইটার হলে প্লাজমা থেরাপির জন্য উপযুক্ত বলে ধরা হয়। রক্ত পরিসঞ্চালনের অন্যান্য শর্ত যেমন রক্তবাহিত রোগের (সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস, এইচআইভি ইত্যাদি) উপস্থিতি, প্লাজমাদাতার ওজন, রক্তচাপ, গর্ভাবস্থা—এই বিষয়গুলো তো দেখতেই হবে।তিনি বলেন,

একজন দাতার শরীর থেকে একবারে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিলিটার প্লাজমা নেওয়া সম্ভব। অ্যাফেরেসিস যন্ত্রের মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দাতার শরীর থেকে পুরো রক্ত না নিয়ে শুধু প্লাজমা নেওয়া সম্ভব। একজন দাতার প্লাজমা দিয়ে তিন ইউনিট পর্যন্ত (প্রতি ইউনিট ২০০ মিলিলিটার) প্লাজমা বানানো যায়। দাতা চাইলে একবার প্লাজমা দেওয়ার পরের সপ্তাহে আবারও প্লাজমা দিতে পারবেন। প্লাজমা দান করার পর ২৪ ঘণ্টায় তিন লিটার পানি পান করলেই এর অভাব পূরণ হয়ে যায়।

Centrifuged Blood

কারা কনভালসেন্ট প্লাজমা গ্রহণের উপযুক্ত?

১. ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় যারা করোনা পজিটিভ

২. যাদের খুবই আশঙ্কাজনক অবস্থা-

  • শ্বাস-প্রশ্বাসের ঘাটতি(≥৩০/মিনিট)
  • ব্লাড-অক্সিজেন সেচুরেশন(≤ ৯৩%)
  • ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে পালমোনারি ইনফিলট্রেটস >৫০%

৩. লাইফ রিস্কিং ডিসিজ(রোগ)

  • রেসপিরেশন ফেইলিউর ( রক্তে অক্সিজেন এল স্বল্পতা বা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের প্রাচুর্যতা)
  • সেপটিক শক
  • একসাথে শরীরের অনেক অঙ্গ বা অরগান বিকল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

প্লাজমা থেরাপির ঝুঁকি

অন্যান্য রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্লাজমা পদ্ধতিটির সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত হয়, রিইনফেকশন এর ঝুঁকি কম থাকে কিংবা একেবারে থাকেই না।

কিন্তু গবেষকদের এবং চিকিৎসকদের মতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে কনভালসেন্ট প্লাজমা – যেটি করোনা ভাইরাসে হতে সেরে উঠা রোগী হতে সংগ্রহ করা হয়, সেক্ষেত্রে ইনফেকশন এর সম্ভাবনা কিছুটা হলেও থেকে যায়। তবে এখন পর্যন্ত এরকম কোনো ঘটনা ঘটার কথা শোনা যায় নি।

যেসব ঝুঁকি রয়ে যায়-

১.অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া

২.ফুসফুসের ক্ষতি

৩.রক্তের মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমণ

৪.শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা

৫.ইনফেকশন- এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি এবং সি

৬.সিভিয়ার সিম্পটম বা জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে প্লাজমা থেরাপি ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।

৭.রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। এতে করে মৃত্যু হওয়ারও আশংকা থেকে যায়।

এসব ঝুঁকি বা ইনফেকশন এর সম্ভাবনা খুবই কম থাকে কারণ ডোনেটকৃত ব্লাডের ক্ষেত্রে FDA এর কিছু ক্রাইটেরিয়া অনুসরণ করতে হয়। ডোনেটকৃৃৃত ব্লাড আগে কয়েক ধাপে পরীক্ষা করা হয়। এরপর প্লাজমা সংগ্রহ করা হয়।

বাংলাদেশে প্লাজমা সংগ্রহের চ্যালেন্জ

জাতীয় প্রযুক্তিগত উপকমিটির প্রধান এবং ঢামেকের বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট (বিএমটি) ইউনিট এবং হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এমএ খান বলেন, কোন দাতার কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হলে ১২ হাজার টাকা মূল্যের একটি বিশেষ কিট দরকার হয়। দাতার রক্তে অ্যান্টিবডির সংখ্যা নির্ধারণের জন্য আলিজা পরীক্ষা চালাতে আরেকটি কিটের দাম পড়ে প্রায় দেড় লাখ টাকা। তিনি আরো বলেন,

প্লাজমা দানের ব্যাপারে এখনো সচেতনতার অভাব রয়েছে। যারা ডোনেট করবেন, তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। এখানে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কিছু নেই। বরং তার প্লাজমা হয়তো অন্যদের সুস্থ হয়ে উঠতে সহায়তা করবে। এটা একেবারে রক্ত দেয়ার মতো একটা ব্যাপার। কিন্তু প্লাজমা সংগ্রহ তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। কারণ এখনো সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের খুব একটা সাড়া পাচ্ছেন না তারা। এজন্য আপাতত চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্লাজমা সংগ্রহ করা হচ্ছে। পুরোপুরি প্রয়োগের আগে আমাদের প্লাজমার একটা ব্যাংক তৈরি করে রাখতে হবে। যাতে অনেককে থেরাপি দেয়া যায়। সেজন্য করোনাভাইরাস থেকে যারা সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাদের এগিয়ে আসতে হবে।

রেফারেন্সঃ

  • https://ccpp19.org/
  • https://www.donatingplasma.org/donation/what-is-plasma
  • https://www.medicalnewstoday.com/
  • https://www.mayoclinic.org/
  • https://m.prothomalo.com/life-
  • https://www.fda.gov/emergency-preparedness-and-response/coronavirus-disease-2019-covid-19/covid-19-frequently-asked-questions
  • https://unb.com.bd/bangla/mobile
  • https://www.fda.gov/vaccines-blood-biologics/investigational-new-drug-ind-or-device-exemption-ide-process-cber/recommendations-investigational-covid-19-convalescent-plasma#Collection of COVID-19
  • https://www.hematology.org/covid-19/covid-19-and-convalescent-plasma
  • https://www.bbc.com/bengali
Comments are closed.