কোয়ান্টাম টানেলিং

সহজ কথায় কোয়ান্টাম টানেলিং হলো একটি কোয়ান্টাম ঘটনা যেখানে ক্ল্যাসিক্যাল পদার্থ বিদ্যা অনুযায়ী যে বাধা অতিক্রম করা সম্ভব নয় কিন্তু কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী কোনো কণা সেই কাজটি করতে পারে। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সে পর্যাপ্ত পরিমাণে শক্তি না থাকলে কোনো কনা একটি নির্দিষ্ট বাধাকে অতিক্রম করতে পারে না, কিন্তু কোয়ান্টাম ফিজিক্স অনুযায়ী একটি কণা যেহেতু তরঙ্গ হিসেবে আচরণ করতে পারে তাই কোনো বাধা অতিক্রম করতে এর শক্তি একেবারে শূন্য না হয়ে এর বিস্তার এক্সপোনেশিয়ালভাবে কমতে থাকে। বিস্তার বা অ্যাম্প্লিটিউডের এই কমে যাওয়ার সাথে সাথে বাধা বা দেয়ালের অপর পাসে ওই কণাকে পাওয়ার সম্ভাবনাও কমতে থাকে। এখন বাধার দেয়াল যদি যথেষ্ট ছোট হয় তাহলে তরঙ্গের বিস্তার অপর পাসে একেবারে শূন্য হয় না এবং ওই পাসে কণাটিকে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ বাধার অপর পাসে কিছু কণা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

কোয়ান্টাম টানেলিং আবিষ্কার
১৯২৭ সালে F. Hund “ডাবল-ওয়েল ” পোটেনশিয়াল সিস্টেমের গ্রাউন্ড স্টেট এনার্জি নির্ণয় করার সময় প্রথম এই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন। ডাবল-ওয়েল পোটেনশিয়াল সিস্টেম হলো একই শক্তির দুটি ভিন্ন অবস্থা যা একটি পোটেনশিয়াল ব্যারিয়ার দিয়ে আলাদা করা হয়।

See the source image

চিত্রে সমশক্তির দুটি অ্যামোনিয়া অণু একটি ব্যারিয়ার দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। এই
অণু দুইটি ক্ল্যাসিক্যালি প্রেডিক্টেড সময়ের চেয়ে অনেক কম সময়ে ব্যারিয়ার অতিক্রম করতে পারে। কারন কণা দুইটি ক্ল্যাসিক্যাল নিয়ম ভেঙে অনেক কম শক্তি নিয়ে ব্যারিয়ারের ভিতর দিয়ে টানেল হতে পারে।

একই বছর L. Noedheim বিভিন্ন বস্তুর পৃষ্ঠে ইলেক্ট্রন রিফ্লেকশনের ক্ষেত্রে এই টানেলিং পর্যবেক্ষণ করেন। পরবর্তী কয়েক বছরে Oppenheimer হাইড্রোজেনের আইয়োনাজেশন রেট নির্ণয়ে এই টানেলিং সফল ভাবে ব্যবহার করেন।

প্রকৃতিতে কোয়ান্টাম টানেলিং

কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মতো দৈনন্দিন জীবনে কোয়ান্টাম টানেলিং এর সম্পর্ক খুবই কম। প্রকৃতির কিছু মৌলিক ঘটনার পিছনে এই কোয়ান্টাম টানেলিং কে কারণ মনে করা হয়। এটা ধারণা করা হয় যে মহাবিশ্বের শুরই হয়েছিল একটি কোয়ান্টাম টানেলিং ঘটনার মাধ্যমে। যেখানে মহাবিশ্বকে একটি নন-জ্যামিতিক(স্থান-কালের ধারনা ব্যতিত) অবস্থা থেকে স্থান, কাল, পদার্থ ও জীবন সম্বলিত বর্তমান মহাবিশ্বে রুপান্তরিত হয়েছে।

তারকাদের ফিউশনে টানেলিং

ফিউশন হলো একাধিক ছোট নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে একটি বর নিউক্লিয়াস তৈরির প্রকৃয়া এবং এ প্রকৃয়ায় নতুন বড় নিউক্লিয়াস এর সাথে বিপুল পরিমাণ শক্তিও উৎপন্ন হয়। তারায় সংঘটিত ফিউশন বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন বাদে পর্যায় সারনির আর সব মৌলই তৈরি হয়। তারাগুলোতে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরির ফিউশনের মাধ্যমে তারাদের শক্তি উৎপন্ন হয়।ফিউশন বিক্রিয়া আমাদের ধারনার থেকেও অনেক বেশি পরিমানে নক্ষত্রগুলোতে সংঘটিত হয়। পজিটিভ কণার মধ্যকার বিকর্ষণের কারনে ফিউশন বিক্রিয়ার হার কম হয় কিন্তু যদি টানেলিং ইফেক্ট বিবেচনায় আনা হয় তাহলে ফিউশন বিক্রিয়ার বিক্রিয়ক হাইড্রোজেনের সংখ্যা নাটকীয় ভাবে বেড়ে যায় ফলে ফিউশনের হারও বেড়ে যায়। এখান থেকেই নক্ষত্রদের লক্ষ বছর সুস্থিত ভাবে থাকার কারণ ব্যাখ্যা করা যায়। এই প্রকৃয়াটি এখনো বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত নয় কারণ একটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস গড়ে প্রায় এক হাজার অন্য হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় প্রতিটি ফিউশন বিক্রিয়ার আগে।

মানব শরীরে কোয়ান্টাম টানেলিং

প্রথম দিকে মানুষের গন্ধ নির্ণয় করার ক্ষমতাকে মনে করা হতো নাসাগ্রন্থি “লক এন্ড কি ” প্রকৃয়ায় ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের গঠন শনাক্ত করে তার গন্ধ আলাদা করে, কিন্তু সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে ইথানল (Ethanol) এবং ইথানেথল (Ethanethiol) এর গঠন প্রায় একই হলে ইথানল পান যোগ্য হলেও ইথানেথল পচা ডিমের গন্ধযুক্ত। এটা নির্দেশ করে যে এখানে নিশ্চয় অন্য কোনো মেকানিজম কাজ করে। ধারনাটি এমন যে আমাদের গন্ধগ্রন্থিগুলো কোয়ান্টাম টানেলিং এর মাধ্যমে রাসায়নিক গুলো আলাদা করে। গ্রন্থিগুলো গন্ধ যুক্ত কণাগুলোর উপর অল্প পরিমাণ বিদ্যুৎ চালনা করে ফলে ওই কথাগুলো নির্দিষ্ট কম্পনে কাপতে শুরু করে। ফলে নির্দিষ্ট গন্ধ আলাদা করা যায়। এখন এই বিদ্যুৎ সৃষ্টি করতে হলে গ্রন্থি এবং কোষের অপরিবাহী দেয়ালে ইলেকট্রন টানেলিং এর মাধ্যমে স্থানান্তরিত হতে হবে। কোয়ান্টাম টানেলিং এর নতুন পরীক্ষায় দেখা গেছে অলফেক্টরি স্টিমিউলেটিং এর বিক্রিয়া হাইড্রোজেন এবং ডিউটেরিয়াম বন্ধন ত্বরান্বিত করে। সিদ্ধান্ত হিসেবে পাওয়া যায় যে মনুষ কোয়ান্টাম টানেলিং এর মাধ্যমে অণু পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারে গন্ধ শুঁকে।

টানেল ডায়োড

টানেল ডায়োড হলো এক প্রকার সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইস যা উচ্চ গতিতে কাজ করতে পারে। দুটি সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের মাঝখানে পাতলা অপরিবাহী পদার্থ যুক্ত করে এ ডায়োড তৈরি করা হয়। এ ডায়োডকে Esaki ডায়োড ও বলা হয়। এটি মাইক্রোওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সী রেঞ্জে ভালো কাজ করে। টানেল ডায়োড একটি দুই প্রান্ত বিশিষ্ট ডিভাইস যেখানে রয়েছে উচ্চমাত্রার ডোপিংকৃত P-N জাংশন। ইলেকট্রন এই জাংশন টানেলিং প্রকৃয়ায় অতিক্রম করে ইলেক্ট্রিক কারেন্ট সৃষ্টি করে। সাধারণ P-N জাংশনের তুলনায় টানেল ডায়োডে ডোপিং এ র পরিমাণ প্রায় ১০০০গুন বেশি হয় তাই এখনে ডিপ্লেশন লেয়ার অনেক বেশি ন্যারো হয় যা প্রায় ন্যানোমিটার মাত্রার। ফলে কম ভোল্টেজ পরিবর্তনে কারেন্টের ব্যাপক পরিবর্তন পাওয়া যায়। টানেল ডায়োড সাধারণত লজিক মেমোরি স্টোরেজ ডিভাইস, রিলাক্সেশন অসিলেটর, এবং আল্ট্রা হাই স্পিড সুইচ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ

স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ কোনো বস্তুর পৃষ্ঠের উপর খুবই শার্প একটি প্রোব স্ক্যানিং করে কাজ করে। প্রোবের মাথা থেকে ইলেক্ট্রিক কারেন্ট তৈরি করে পরীক্ষিত বস্তুর পৃষ্ঠে চালনা করা হয়। এখানে ইলেক্ট্রিক কারেন্টের ইলেক্ট্রন গুলো শূন্য স্থানের ভিতরদিয়ে ওই পৃষ্ঠে টানেলিং এর মাধ্যমে পৌছায়। বস্তুর পৃষ্ঠের অণু পরমাণুর স্তরের উপর দিয়ে এই ইলেক্ট্রন বিম যাওয়ার সময় সেখানের সৃষ্ট গ্যাপ অনুযায়ী ইলেকট্রন বিমের পরিমাণও পরিবর্তিত হয় এবং এই পরিবর্তন যন্ত্রটি রেকর্ড করে সে অনুযায়ী ইমেজ তৈরি করে। এই পদ্ধতিতে কোনো বস্তুর অণু পরমাণুর বিন্যাসের ছবিও নিখুঁত ভাবে তোলা সম্ভব।

ফ্ল্যাস ড্রাইভ

ফ্ল্যাস ড্রাইভে ডাটা সংরক্ষণ করা হয় মেমোরি সেলের একটি নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে। এই মেমোরি সেলগুলো তৈরি হয় “ফ্লোটং গেইট ” নামক এক প্রকার ট্রানজিস্টর দিয়ে। এটি আবার কন্ট্রোল গেইট এবং ফ্লোটিং গেইট নামক দুইটি গেইট দিয়ে তৈরি হয়। ফ্লোটিং গেইটটিকে মেটাল অক্সাইডের ভিতর ট্র্যাপ করা হয়। এই ফ্লোটিং গেইট ট্রানজিস্টর এর স্বাভাবিক অবস্থায় বাইনারী 1 স্টেটে থাকে।এই ফ্লোটিং গেইটে যখন একটি ইলেক্ট্রন অ্যাটাচড্ করা হয় তখন তা অক্সাইড লেয়ারে আটকা পড়ে যায় যা কন্ট্রোল গেইটের ভোল্টেজ লেভেলে প্রভাব ফেলে। এই অবস্থায় ট্রানজিস্টরটি বাইনারী 0 স্টেটে পরিবর্তিত হয়। ফ্ল্যাস ড্রাইভে ডাটা মুছতে হলে এর কন্ট্রোল গেইটে একটি বড় পসিটিব চার্জ প্রয়োগ করতে হয় ফলে ইনস্যুলেটর লেয়ারে আটকে পড়া ইলেক্ট্রন গুলো টানেলিং এর মাধ্যমে সরে যায় এবং ট্রানজিস্টর টি পুনরায় বাইনারী 1 স্টেটে ফেরত যায়।

সুত্রঃ AZoQuantum.com

Comments are closed.