রাডার এমন একটি টার্ম যে, বিজ্ঞানপ্রেমী হলে এটা সম্পর্কে কিছুটা নলেজ বাই ডিফল্ট জানা থাকবেই। ভাবুন, ঝড়ের রাতে/প্রচন্ড কুয়াশায়, একটি জাহাজ, সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় আছে, কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেনা কেউ যে আসেপাশে কোনো জাহাজ/বরফের চাই বা অন্য কিছু আছে কিনা, এমন অবস্থায় কিভাবে পরিত্রান সম্ভব?

আবার ধরুন, অন্ধকার রাতে বিমানের বেলার ইমার্জেন্সী ল্যাণ্ড করার প্রয়োজন পড়ল।
কিন্তু প্রচন্ড কুয়াশা ও রাতের বেলা হওয়ার কারণে পাইলট দেখতেই পাচ্ছে না কিছু, এমতাবস্থায় কিভাবে ল্যান্ড করবে????
যেকোন মূহূর্তে কিছু হয়ে যেতে পারে, খুব দ্রুত কাজ করে হবে,নাহলে বিপদ।
কি উপায় তৈরি করেছে বিজ্ঞান এখানে???
উত্তর হল: এর জন্যে লাগবে চোখ, ঠিক মানুষের চোখের মতই, কিন্তু সেই চোখের নাম হল রাডার, যা ঘন কুয়াশা/রাতের আধারের স্তর ভেদ করেও অনেক দূরে থাকা কোন বস্তুর অবস্থান নিশ্চিত করে থাকে,যার ফলে আগে থেকেই সতর্ক থাকা যায় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
রাডার এর পূর্নরূপ হল: RADIO DETECTION & RANGING
তো চলুন তাহলে আমাদের আজকের রাডার-নামা শুরু করা যাকঃ
টপিকটি বিশাল হওয়ায় আমরা একে দুই পার্টে ভাগ করেছি ,আজকে প্রথম পার্টে আমরা যে যে বিষয় আলোচনা করবো তার একটা লিস্ট এখানে দিচ্ছিঃ
- রাডার কি?
- রাডার কি সিস্টেম না ডিভাইস?
- না থাকলে কি কি সমস্যা হবে?
- একটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এর কি ভূমিকা?
- রাডার কিভাবে কাজ করে?
- রাডারের যন্ত্রাংশ কি কি?
- রাডার স্টেশন কি?
তো চলুন শুরু করিঃ
রাডার বলতে রেডিও ডিটেকশন অ্যান্ড রেঞ্জিং, যোগাযোগের মাধ্যমের মধ্যে অন্যতম, এইযে বিমানের/জাহাজের চলাচল/আকাশসীমার উপর নজরদারি রাখা/সামনের রাস্তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা ইত্যাদি কাজ ই রাডার করে থাকে। রাতের বেলায় বাদুড় যেভাবে প্রতিধ্বনি কে কাজে লাগিয়ে সামনের পথের কোন বস্তুর অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে, ঠিক সেভাবেই রাডারও রেডিও তরঙ্গকে কাজে লাগিয়ে আশেপাশে বস্তুর অবস্থান সুনিপুণভাবে শনাক্ত করে থাকে।

প্রতিটা দেশ ই তার আকাশসীমার উপর রাডার দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে মনিটরিং করে থাকে, ভুল করে বা ইচ্ছা করে কেউ অন্য কারো সীমানায় ঢুকে পড়লে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নোটিফাইড করা হবে এই বিষয়ে, আর যদি সেই অপর পক্ষ থেকে রেস্পন্স না পাওয়া যায়, তবে বুঝাই যাচ্ছে কি হতে পারে, তাহলে বুঝলেন তো রাডার আসলে কত বড় ভূমিকা পালন করে।
রাডার হচ্ছে এমন একটি সিস্টেম, যার মাধ্যমে বেতার তরঙ্গ উৎপাদন করে দূরবর্তী কোন বস্তুর অবস্থান, আকার, কত বেগে ছুটে চলছে ইত্যাদি তথ্য জানা যায়।
এবার জানা যাক রাডার কি সিস্টেম না ডিভাইস?
প্রথমে আমি সিস্টেম ও ডিভাইসের সাধারন সংজ্ঞা দিয়ে শুরু করি, সাধারণ ভাষায়, কোন একটি জিনিস যদি একটি নির্দিষ্ট কাজ করে থাকে, তবে সেটি ডিভাইস, আর সেটি যদি একই সাথে অনেক গুলো কাজ করে থাকে তবে সেটি সিস্টেম, যেমন রিসিভার একটা ডিভাইস আর কমুনিকেশন একটা সিস্টেম।
তো রাডার হল, সিস্টেম, কেনোনা এটি অনেকগুলো ডিভাইসের সম্বন্বয়ে তৈরি এবং একই সাথে অনেকগুলো কাজ সম্পন্ন করে থাকে।
এবার রাডারের অভাবে কি কি হতে পারে তার ব্যাপারে আসিঃ
আগেই বলেই রেখেছি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা এখনো অপরিসীম, তাই এর অভাবে,
একটি দেশের পক্ষে সীমান্তে নজরদারি করা কষ্টসাধ্য হবে, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পক্ষে।
একটি দেশের সমুদ্রসীমানায় বাইরের জলযান, জাহাজের উপস্থিতি নির্ণয় করা চ্যালেঞ্জিং হবে।
আকাশসীমায় অনঅথরাইজড বিমান, জেট ইত্যাদির যাতাইয়াত নিয়ন্ত্রণ করা সময়সাপেক্ষ+কষ্টসাধ্য হবে, সেই সাথে আসন্ন হামলা রুখার চান্স কমে আসবে, ফলে সেই দেশের সার্বভৌমত্বের উপর বড় একটা প্রশ্ন ঝুলতে থাকবে
আমরা জানি যে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে শনাক্ত করে লোকালয়ে সতর্কতা পৌছানো খুব দরকারি একটি কাজ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানোর জন্যে, সেই কাজ বাধাগ্রস্থ হবে এবং সঠিকভাবে আসন্ন ঝড়, টর্নেডো, সাইক্লোন এর বিপদসংকেৎ আবহাওয়া অফিস দিতে ব্যর্থ হবে, ফলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আকাশচুম্বী হবে।
শত্রুপক্ষের হামলা রুখে দেওয়া ও সময়মত কাউন্টার এটাক করা সম্ভব হবেনা, ফলে যুদ্ধ শুরুর আগেই দশ পা পিছিয়ে থাকতে হবে ইত্যাদি।

তাই বলা যায়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করতে এর বিকল্প নেই, সেই সাথে আসন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে আগাম সতর্কতা প্রেরণে এর বিকল্প এখনো নেই, তাই বুঝতেই পারছেন, এর ভূমিকা কতটা গভীর হতে পারে।
একটি দেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এটি ফার্স্ট লাইন অফ ডিফেন্স হিসেবে কাজ করে।
এতক্ষন ননটেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হল, এবার আমরা টেকনিক্যাল বিষয়ের দিকে যাব,
প্রশ্নটা ছিল রাডার কিভাবে কাজ করে?

সহজ বাংলায় বলতে গেলে, টর্চলাইটের কথা ভাবুন, লাইটটি জ্বালালে এটি পথ অতিক্রম করতেই থাকে, যতক্ষন না কোনস্থানে গিয়ে আলো বাধা পায়, এবং ফিরে এসে আমাদের চোখে দর্শনানুভূতি জাগায়, ঠিক সেভাবেই রাদার ম্যাগনেট্রন নামক যন্ত্রের মাধ্যমে বেতার তরঙ্গ তৈরি করে বায়ুমন্ডলে ছুড়ে মারে, এবং সেটি সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে ৩,০০,০০০কিলোমিটার/সেকেন্ড বেগে, বলে রাখি, আলো আর বেতার তরঙ্গ একই বেগে চলে, তবে রেডিও তরঙ্গ গুলো অনেক লম্বা হয় আকারে এবং এর কম্পাঙ্ক অনেক কম হয়ে থাকে। আলোক তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ৫০০ ন্যানোমিটার হয়ে থাকে আর রাডারে ব্যবহৃত হওয়া ম্যাগনেট্রন থেকে উৎপন্ন রেডিও তরঙ্গ আলোক তরঙ্গ হতে লম্বায় কয়েক মিলিয়ন গুন লম্বা হয় থাকে।
তারপর সেটি সামনে থাকা কোন বস্তুর পৃষ্ঠে বাধা পেয়ে পূনরায় আগের স্থানে ফিরে আসে, এখানে যখন তরঙ্গ প্রেরন করা হয় তখন রাডার সিস্টেম ট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে, এবং যখন তরঙ্গ ফেরত আসে বাধা পেয়ে, তখন রিসিভার হিসেবে কাজ করে, একে বলে ডুপ্লেক্সার।
অর্থাৎ এ থেকে বুঝা যাচ্ছে রাডার এ ট্রান্সমিটিং & রিসিভিং দুটো কাজ ই একসাথে করতে হয়, যে একসাথে transmitter & receiver হিসেবে কাজ করতে পারে। অর্থাৎ সে তথ্য এন্টেনা কে দিতেও পারে আবার এন্টেনা থেকে নিতেও পারে। এভাবে ship, aircraft navigation এ রাডার সাহায্য করে। শুধু তাই নয়,ঘূর্ণিঝড় কত দূরে অবস্থান করছে সেটাও এই পদ্ধতিতেই জানা যায়।
ধরুন শত্রুপক্ষের জেট বিমান MACH 6 বেগ নিয়ে আকাশসীমার ঢুকে পড়েছে, এখন কিভাবে একে ধরা যায়, অবশ্যই তার জন্যে তার চেয়ে বেশি গতির কাউকে লাগবে, রাডারের নিক্ষেপ করা তরঙ্গের বেগ সেকেন্ডে ৩,০০,০০০কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে, ফলে ১ সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যেই সেটি রাডার স্টেশনের ডিসপ্লে তে ধরা পড়ে যাবে।
রাতের বেলায় বাদুর যেভাবে চলাচল করে ঠিক সেভাবেই রাডার কাজ করে।
যা যা নিয়ে রাডার গঠিতঃ
- Indicator
- Detector
- RF Mixer
- IF Amplifier
- Duplexer
- Antenna
এছাড়াও আরো অনেক আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি থাকে এর সাথে।
এবার রাডার স্টেশন সম্পর্কে কিছু বলার পালাঃ
এটি হল সেই জায়গা যেখান থেকে রাডারে ধরা পরা কোন কিছু নিয়ে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করা হয়।
এটি একটি বেতার স্টেশন,যেখান থেকে তরঙ্গ আকাশে নিক্ষেপ করা হয়,এবং অপারেটররা সার্বক্ষনিক বিষয়গুলা তদারকি করেন ডিসপ্লের সামনে বসে।
বাংলাদেশের কক্সবাজার, বগুড়ায় রাডার স্টেশন রয়েছে।
ব্জানিয়ে রাখি, টাইটানিকে কিন্তু রাডার ছিল না, থাকলে হয়তবা এতগুলো জীবন হারানো লাগতো না।
পরবর্তী পর্বে আমরা রাডারের প্রকারভেদ, এন্টেনা,ভিজুয়ালাইজেশন, রাডার ফাকি দেওয়ার প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করব।

আজ এ পর্যন্তই।
সবাই ভালো থাকবেন