রাধানাথ শিকদারঃ একজন উপেক্ষিত বিজ্ঞানী

মাউন্ট এভারেস্টের নাম শুনেনি এমন খুব কম ব্যাক্তি-ই খুঁজে পাওয়া যায় । এটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যেটির উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার (২৯,০২৯ ফিট)। এর নেপালি নাম সাগরমাথা, তিব্বতী নাম চোমোলাংমা । ধবধবে সাদা বরফে ঢাকা এই সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সবার কাছেই অতি প্রিয় একটি দর্শনীয় স্থান ।

তবে এর পেছনে যে এক বাঙ্গালির ভূমিকা রয়েছে, তা কি আমরা জানি? তিনি না থাকলে যে সুউচ্চ এই পর্বতশৃঙ্গ মানুষের অগোচরেই থেকে যেত! চলুন আজ বিজ্ঞানবর্তিকার পাতা থেকে সেই প্রিয় ব্যাক্তির সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া যাক ।

নামঃ রাধানাথ শিকদার

জন্মঃ ১৮১৩

রাধানাথ শিকদার ছিলেন একজন বাঙালি গণিতবিদ ছিলেন যিনি হিমালয় পর্বতমালার ১৫ নং শৃঙ্গের (চূড়া-১৫) উচ্চতা নিরূপন করেন এবং প্রথম আবিষ্কার করেন যে, এটিই বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এই পর্বত শৃঙ্গটিকেই পরে “মাউন্ট এভারেস্ট” নামকরণ করা হয়।

বাল্যকালঃ  তিতুরাম শিকদারের বড় ছেলে রাধানাথ জন্মেছিলেন ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে। সঠিক তারিখ জানা যায় না, মায়ের নামও অজানাই থেকে গেছে। জোড়াসাঁকোর শিকদার পাড়ায় ব্রাহ্মণ বংশে রাধানাথের জন্ম। রাধানাথের ছিল এক ভাই ও তিন বোন। ভাই শ্রীনাথ ছিল দু’বছরের ছোট। শিকদারেরা মুসলমান আমলে প্রধান শান্তিরক্ষক হিসাবে কাজ করত। এই কাজ বংশপরম্পরায় করার জন্য তাদের মধ্যে লেখাপড়ার চর্চা অনেক কমে এসেছিল।

শিক্ষাজীবনঃ

রাধানাথ শিকদার শৈশবে গুরু মহাশয়ের পাঠশালায় পড়ার পরে ফিরিঙ্গি কমল বসুর স্কুলে বিদ্যাভ্যাস করেন। রাধানাথ তার ডায়েরিতে নিজের পড়াশোনার কথা ও তখনকার শিক্ষাদানের পদ্ধতি সম্বন্ধে সবিস্তারে লিখে গেছেন। তাঁর হস্তলিখিত এই বিবরণের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ ১২৯১ বঙ্গাব্দের আর্য দর্শন পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তার অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো—
“ ১৮২৪ খৃঃ আমি হিন্দু কালেজের [Anglo-Indian College] নবম বা সর্ব্বনিম্ন শ্রেণিতে প্রবিষ্ট হই।…… D’ Ansleme সাহেব, ৪ জন সহকারী শিক্ষক ও উচ্চশ্রেণিস্থ বালকগণ শিক্ষাকার্য্য নির্বাহ করিতেন। পর বৎসর ৫ম শ্রেণিতে উন্নীত হই।।… আমি মলিস (Mollis ) সাহেবের নিকট ইংরাজি শিক্ষা করি। … ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে আমি ৪র্থ শ্রেণীতে উন্নীত হই এবং ডিরোজিও সাহেবের অধীনে উপদেশ গ্রহণ করি”। ……… ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হই।’
এ থেকে বোঝা যায় রাধানাথ পাঠ্যাবস্থায় কোনো কোনো ক্লাসে ডবল প্রমোশন পান। রাধানাথ হিন্দু কলেজে পড়েন সাত বছর দশ মাস। হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের শেষ তিন বছর তিনি অধ্যাপক ডি. রস এবং অধ্যাপক জন টাইটলারের কাছে অধ্যয়ন করেন। রাধানাথ টাইটলারের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন। তিনি রাধানাথকে বিশেষ মেধাসম্পন্ন মনে করতেন। সে সময়ে ভারতবর্ষের কয়েকজন ব্যাক্তির মধ্যে রাধানাথ ছিলেন একজন যিনি ছাত্র অবস্থাতেই নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিকা গ্রন্থের পাঠ নেন। তিনি এসব পাঠ নেন তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক জন টাইটলারের কাছ থেকে ।

( উল্লেখ করা যেতে পারে যে রাধানাথ শিকদার এবং রাজনারায়ণ বসাকই ছিলেন প্রথম দুই ভারতীয় যারা নিউটনের প্রিন্সিপিয়া পড়েছিলেন। )অধ্যাপক জন টাইটলারের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে রাধানাথ বলেছেন,

“কলেজের সকল শিক্ষক অপেক্ষা টাইটলার সাহেবের শিক্ষাপ্রণালী অতি উত্তম। তিনি প্রশ্নচ্ছলে শিক্ষা দিতেন। … শেষ তিন বৎসর আমি রস ও টাইটলার সাহেবের বক্তৃতা শ্রবণ করি। ১৮৩০ খৃঃ অব্দে টাইটলার সাহেবের নিকট গণিত শাস্ত্র শিক্ষা করি। এই বৎসর হইতে উচ্চ গণিতের শিক্ষা আরম্ভ হয়। এই বৎসর ইঁহার নিকট নিউটনের প্রিন্সিপিয়া (Newton’s Principia) গ্রন্থের প্রথম ভাগ অধ্যয়ন করি। পর বৎসর সাহেবের বক্তৃতা শ্রবণ ও বাটিতে নিজে চেষ্টা করিয়া উচ্চ গণিতের কতক কতক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করি।”

ছাত্রাবস্থায় তিনি গ্যালিলিও, টাইকো ব্রাহি, জোহানেস কেপনার, শ্রীধর আচার্য এবং ভাস্করাচার্যের বৈজ্ঞানিক লেখা পড়েন। হেলেনিক গণিতবিদ থেলিস, আর্কিমিডিস এবং ইরাটোথেনিসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাধানাথ স্ফেরিক্যাল ত্রিকোণমিতি অধ্যয়ন করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণের প্রতিও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল।

রাধানাথ এবং ভাই শ্রীনাথ দু’জনেই ছিলেন কৃতী ছাত্র এবং মাসিক ষোল টাকা করে বৃত্তি পেতেন। রাধানাথের কলেজে পড়বার খরচ না লাগলেও তার অভ্যাস ছিল বই কেনা। সে সময় তিনি যে টাকা বৃত্তি হিসেবে পেতেন তার বড় একটা অংশ দিয়ে বই কিনে ফেলতেন। পারিবারিক অবস্থা ভালো না থাকায় অনেক সময় পড়ালেখাতে মন দিতে পারতেন না। তিনি লিখেছিলেন,

“কলেজে একমনে পড়িতে পাইতাম না, একবার পড়ার কথা মনে পড়িত, পরক্ষণেই বাটিতে ফিরিয়া যাইয়া কি খাইব, মা বুঝি এখনও কিছু খান নাই, এই সকল ভাবনা মনে উত্থিত হইয়া পড়ার ব্যাঘাত ঘটিত।”

অন্য জায়গা থেকে বই যোগাড় করলে সেটা বেশিদিন তিনি নিজের কাছে রাখতে পারতেন না। বইয়ের দামও ছিল খুব বেশি এবং এদেশে ছিল দুষ্প্রাপ্য। “কালেজের অধ্যক্ষেরা ছাত্রদিগের জন্য ইংলন্ড হইতে পুস্তক আনাইয়া দিতেন।” ধরে নেওয়া যায় বই কিনতেই রাধানাথের বৃত্তির টাকা নিঃশেষ হয়ে যেত। সে সময়ে ডেভিড হেয়ার ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ কমিটির সদস্য, গণিত বিষয়ক অনেক বই দিয়ে তিনি রাধানাথকে সাহায্য করেছিলেন।

রাধানাথের গণিতে ব্যুৎপত্তি এবং মৌলিক চিন্তার পরিচয় মেলে যখন ছাত্রাবস্থাতেই তার দু’টি বৃত্তের ওপর স্পর্শক রেখা (tangent) অঙ্কন করার একটি নতুন পদ্ধতি Gleanings in Science (Vol. III, 1831) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

ইংরাজি ভাষায় রাধানাথের ব্যুৎপত্তি ছিল অসাধারণ। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই ফেব্রুয়ারি মাত্র সতের বছর বয়সে কলকাতার টাউন হলে সেক্সপীয়ারের ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ নাটক থেকে ওরল্যান্ডোর সংলাপ আবৃত্তি করে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন রাধানাথ। কিছু গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষাও তিনি শিক্ষা করেছিলেন।

কর্মজীবন

রাধানাথ ‘গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে’ অফিসে ১৮৩১-এর ১৯শে ডিসেম্বর কাজে যোগদান করেন। Great Trigonometrical Survey (G.T.S.)  ছিল ‘সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র অধীনে একটি প্রকল্প। উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির রাজত্বের সীমানা নির্ধারণ করা। প্রশাসনিক, সামরিক ও রাজনৈতিক কারণেই এর প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দে কর্ণেল উইলিয়াম ল্যামটন (William Lambton) ভারতের দক্ষিণ দিক থেকে উত্তরে নেপাল পর্যন্ত দ্রাঘিমার কিছুটা অংশের জরিপ ও দূরত্ব নির্ধারণের কাজ শুরু করেন। প্রথমে ভাবা হয়েছিল এটি শেষ করতে সময় লাগবে ৫ বছর, পরে সেটা ৬০ বছরে দাঁড়িয়ে যায়। সমস্ত ভারতেই জরিপের কাজ করার জন্য ল্যামটনের একটি প্রস্তাব কোম্পানীর অনুমোদন পেলে জরিপের কাজটিকে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে নিয়ে আসা হয় এবং ১৮১৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে প্রকল্পটির নাম হয় ‘দি গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে’ (G.T.S.)। জর্জ এভারেস্ট (George Everest) শুরুতে ল্যামটনের অধীনে কাজ করলেও ১৮২৩ সালের ২০শে জানুয়ারি ল্যামটনের আকস্মিক মৃত্যুর পর তিনিই G.T.S.–এর সুপারিনটেনডেন্ট হন। রাত্রিবেলাও একটি বিশেষ ধরণের বাতি জ্বেলে জরিপের কাজ হত। এ কাজের জন্যই এভারেস্টই উঁচু উঁচু টাওয়ার বা মিনার তৈরি করিয়েছিলেন। এরকম বহু মিনার বিভিন্ন জায়গায় আজও চোখে পড়ে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ১৮২৫-এর নভেম্বর মাসে এভারেস্ট ইংল্যান্ডে চলে যান। ১৮৩০-এ ফিরে এসে ভারতের সারভেয়র জেনারেল (Surveyor General ) নিযুক্ত হন এবং নতুন উদ্যমে G.T.S. এর কাজে লেগে যান।

ভূপৃষ্ঠের একটি অঞ্চলকে পরস্পর সংলগ্ন কতকগুলি ত্রিভুজে ভাগ করে নিয়ে ত্রিভুজগুলির পরিমাপ ও জরিপ করার পর বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট, দূরত্ব ইত্যাদি বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করে একত্রিত করলেই পৃথিবীর মানচিত্র তৈরির প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষ করা যায়। এই ত্রিভুজগুলির বাহুর দৈর্ঘ্য অনেক বেশি হওয়ায় ভূপৃষ্ঠের বক্রতার জন্য ত্রিভুজের বাহুগুলি সরল রেখা হয় না। এ সংক্রান্ত মাপজোকের জন্য স্কুলের নিম্ন শ্রেণির জ্যামিতির জ্ঞান যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন ‘স্ফেরিক্যাল ট্রিগোনোমেট্রি’ (spherical trigonometry) । পৃথিবীর কেন্দ্র দিয়ে যায় এমন একটি তল (plane) দিয়ে যদি পৃথিবীকে দু’ভাগ করে ফেলা যায়, তবে পৃথিবীর উপরিভাগে যে বৃত্তটি তৈরি হয় সেটাকে বলে গ্রেট সার্কেল (great circle)। এই বৃত্তের একটি অংশকে গ্রেট আর্ক (great arc) বলে। প্রযুক্তির যে বিষয়টি দিয়ে এই পরিমাপ বা জরিপ করা হয় তাকে বলে জিওডেসি (Geodesy)।

এভারেস্ট দেখলেন এই কাজের জন্য প্রয়োজন একদল লোকের, যাদের পদার্থবিদ্যা ও গণিতে পারদর্শিতা রয়েছে। তিনি উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান হিন্দু কলেজের (পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ) শরণাপন্ন হলেন। গণিতের শিক্ষক জন টাইটলার রাধানাথের নাম পাঠিয়ে দেন।

জর্জ এভারেস্ট

১৮৩১ সালের শেষদিকে এভারেস্ট আট জন বাঙালী ছাত্রকে কম্প্যুটার হিসাবে নিয়োগ করেন। প্রাথমিক বেতন ছিল মাসে ৪০ টাকা। কিছু পরে ১৯শে ডিসেম্বর রাধানাথ কাজে যোগ দেন। অল্পকালের মধ্যেই দেখা গেল যে রাধানাথের গণিতের জ্ঞান অনেক উচ্চ মানের। তাকে G.T.S. –এর সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে নিয়োগ করা হয়। অবশ্য এই আটজনের মধ্যে রাধানাথ ছাড়া আর কেউই G.T.S.-এ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেন নি।

জি. টি. এস.-এ দুটি বিভাগ ছিল; একটি জরিপ বিভাগ ও অন্যটি গণনা বিভাগ। জরিপ বিভাগের কর্মীরা তাদের পর্যবেক্ষণ ও তথ্য গণনা বিভাগে পাঠালে সেখানে সেসব তথ্য নির্ভুল কিনা সেটা খতিয়ে দেখা হত। এভারেস্ট রাধানাথের গণিতের জ্ঞান যথেষ্ট উঁচু মানের বলেই মনে করতেন। এভারেস্টের কাছে রাধানাথ জরিপের বেশ কিছু তত্ত্ব ও প্রযুক্তির কাজ শিখে নেন। সাধারণ চেন কাজে লাগিয়ে জরিপের কাজ করলে, লব্ধ দূরত্বের শুদ্ধতা ও সঠিকতা বজায় রাখার জন্য কয়েকটি সংশোধন করার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে একটি হল বিভিন্ন ঋতুতে তাপমাত্রার হ্রাস বৃদ্ধির সঙ্গে লোহার চেনের দৈর্ঘের পরিবর্তনজনিত সংশোধন। এটি দূর করার জন্য যে উন্নত পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল, সেটি ছিল ‘কোলবি বার’ (Colby Bar ) বা ‘কম্পেনসেটিং বার সিস্টেম’ (Compensating Bar System )। এই পদ্ধতিতে চেনটি সম্পূর্ণ লোহা দিয়ে তৈরি না করে লোহা ও পিতলের সংযুক্ত পাত দিয়ে তৈরি হয়। তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে একটি ধাতুর প্রসারণ অন্যটির সঙ্কোচনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়ায় তাপমাত্রা জনিত সংশোধনের প্রয়োজন হয় না। এভারেস্ট ইংল্যান্ডে থাকার সময়েই এই পদ্ধতি আয়ত্ত করে নেন। আয়ারল্যান্ডে এই পদ্ধতি সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহৃত হবার পর তিনি ঠিক করেন ভারতে ফিরে তিনি এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে জরিপ করবেন। ১৮৩১ সালে একটি নতুন কমপ্যুটিং বিভাগ খোলা হয় ; ডি. পেনিং (de Penning ) ছিলেন সেখানে চিফ কমপ্যুটার। সে বছরেই এভারেস্টের নেতৃত্বে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের উপর দুটি মিনারের দূরত্ব পরিমাপের মধ্য দিয়েই কোলবি বার পদ্ধতির সার্থক প্রয়োগ ঘটে, রাধানাথও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নতুন পদ্ধতিটি তিনি ভালই রপ্ত করে নিয়েছিলেন।

এভারেস্ট রাধানাথের নিষ্ঠা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও কর্মকুশলতা সম্বন্ধে অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। এভারেস্টের মুখ থেকে কারো প্রশংসা খুব কমই শোনা যেত, কিন্তু রাধানাথ ছিলেন ব্যতিক্রম। ১৮৩৮ সালে তিনি রাধানাথ সম্বন্ধে বলেছিলেন ভারতে এদেশের বা ইউরোপের এমন কেউ নেই যিনি রাধানাথের সঙ্গে তুলনীয়। গণিত বিষয়ে তার সমকক্ষ এদেশে কেউ নেই, এমন কি ইউরোপেও খুব কমই আছে। রাধানাথের উপর এভারেস্ট এতটাই নির্ভর করতেন যে বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য রাধানাথকে ছুটি দিতেও তার ইচ্ছা ছিল না; বরং এভারেস্ট চাইতেন তার বাবাই এসে যেন রাধানাথের সঙ্গে দেখা করেন। এ প্রসঙ্গে ১৮৪১ সালের ৩রা জুলাই দেরাদুন থেকে রাধানাথের বাবা তিতুরামকে লেখা এভারেস্টের একটি চিঠি ছিল –

“I wish I could have persuaded you to come to Dehra Dun for not only it would have given me the greatest pleasure to show you personally how much I honour you for having such a son as Radhanath, but you yourself have, I am sure, been infinitely gratified at witnessing the high esteem in which he is held by his superiors and equals.”

রাধানাথের সাহায্য নিয়ে এভারেস্ট হায়দ্রাবাদের বিদর থেকে মুসৌরির ব্যানোগ পর্যন্ত প্রায় ৮৭০ মাইল দূরত্বের গ্রেট আর্কটি জরিপ করে ফেলেন। এই কাজটি সম্বন্ধে হেনরী লরেন্সের অভিমত হল – “a measurement exceeding all others as much in accuracy as in length.” সি. আর. মার্কহ্যামের (C. R. Markham ) মতে – “one of the most stupendous works in the whole history of science.” এসব মন্তব্যের মধ্যে অতিশয়োক্তি নেই, কারণ দেশের তৎকালীন অবস্থায় এধরণের জরিপের কাজে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত। রাধানাথ যে শুধু গণিত ও পদার্থবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং তার শারীরিক শক্তি ছিল অসাধারণ। এই জরিপের কাজ সম্বন্ধে ‘আর্য্যদর্শন’ পত্রিকা লিখেছে –

“…… যখন রাধানাথ এই বিভাগে প্রবিষ্ট হন তখন জরিপ করিবার অনেক প্রথা অনাবিষ্কৃত ছিল। দেশের অবস্থাও অতি অল্পই জানা ছিল। যে যে কারণে গণনা ভুল হইত সে সকলও অজ্ঞাত ছিল। সে আমলে জরিপ করিতে যে কত কষ্ট সহ্য করিতে হইত তাহা কর্ণেল এভারেষ্টের সুবৃহৎ গ্রন্থে বিশেষ করিয়া লেখা আছে। বরফ, হিম, জল, কাদা, বৃষ্টি ভোগ করিয়াও রাত্রি জাগরণ করিয়া প্রফুল্ল চিত্তে কয়জন লোক কাজ করিতে পারে!” ……।

অকৃতদার রাধানাথের ধ্যান জ্ঞানই ছিল তার আরব্ধ কাজ। হয় ত সেজন্যই “রাধানাথই প্রথম বাঙালী যিনি সার্ভে বিভাগে প্রবিষ্ট হন। তাঁহার পেন্সন গ্রহণের পর আর কোন দেশীয় লোক ইহার কর্ম্মচারী নিযুক্ত হন নাই।” ১৮৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসে জর্জ এভারেষ্ট তার মূল্যবান গ্রন্থ “An account of the measurement of two sections of the meridional arc of India” শেষ করে অবসর নিয়ে দেশে ফিরে যান। ১৮৪৭ সালে তার সে বইটি প্রকাশিত হলে তিনি রাধানাথের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বইটির এক কপি তাকে পাঠিয়ে দেন, তাতে স্বহস্তে লেখা – “ Babu Radhanath …. in acknowledgement of his active participation in the survey.” জর্জ এভারেষ্ট তখন পৃথিবীতে জরিপের কাজে পয়লা নম্বর প্রযুক্তিবিদ ও বৈজ্ঞানিক বলে স্বীকৃত। তার কাছ থেকে এরকম সম্মান লাভ রাধানাথের কাজের উৎকর্ষ ও অবদানকেই তুলে ধরে।

জর্জ এভারেষ্টের পর সারভেয়ার জেনারেল (Surveyor General) হয়ে আসেন অ্যান্ড্রু ওয়া (Andrew Waugh)। তিনিও রাধানাথের গণিতের জ্ঞান ও কর্মদক্ষতার প্রশংসা করতেন। ১৮৫১ সালের ১৫ই এপ্রিল বৃটিশ পার্লামেন্টে ভারতের জি. টি. এস. সম্বন্ধে রিপোর্ট পেশ করার সময় অ্যান্ড্রু ওয়া সাধারণভাবে ভারতীয়দের কাজের কথা তুলে ধরলেও বিশেষ উল্লেখ করেছেন ‘ব্রাহ্মণ বংশীয় নেটিব বাবু রাধানাথ শিকদারের, গণিতে যার জ্ঞান উচ্চ মার্গের।’ ১৯৫১ সালেই রাধানাথকে চিফ কম্পুটার (Chief Computer) পদে উন্নীত করা হয়।

অ্যান্ড্রু ওয়া রাধানাথকে বললেন পূর্ব ভারতের হিমালয়ের চূড়াগুলির দিকে নজর দিতে। হিমালয়ের ৭৯ টি শৃঙ্গের অবস্থান নির্দিষ্ট করা গিয়েছিল, তার মধ্যে ৩১ টির নামকরণও হয়েছিল। বাকি শৃঙ্গগুলি এক একটি সংখ্যা দিয়ে পরিচিত হত। জে. ও. নিকলসন (J. O. Nicholson) জরিপের সময় ১৫ নম্বর চূড়াটি চিহ্নিত করেছিলেন। তার প্রাপ্ত তথ্য কাজে লাগিয়ে জন হেনেসি (John Henesy) চূড়াটির উচ্চতা বের করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সফল হন নি। রাধানাথ এবার এই কাজে হাত লাগালেন। দেড়শ’ মাইল দূর থেকে ছয়টি বিভিন্ন অবস্থান থেকে থিওডোলাইটের (theodolite) সাহায্যে পরিমাপ সংগ্রহ করে গণিতের জটিল পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে অবশেষে তিনি শৃঙ্গটির উচ্চতা নির্ণয়ে সফল হন।

রাধানাথের নেয়া প্রায় ছয়টি রিডিং প্রমাণ করলো, পিক ফিফটিনের উচ্চতা ২৯,০১৭ ফুট, যা পুরনো মাপ অনুযায়ী উচ্চতম পর্বতশৃংগ কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়েও বেশি উঁচু।

এই পিক ফিফটিনের রিডিং নেয়ার জন্য রাধানাথের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল বায়ুমণ্ডলে আলোর প্রতিসরণের জন্য বিচ্যুতি এড়াতে প্রয়োজনীয় সংশোধন নির্ণয় করা। এ সংশোধন নির্ণয় করে রাধানাথ পিক ফিফটিনের উচ্চতা নির্ণয় করে মূল কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। এরপরই সেই দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল যে দৃশ্যের অবতারণা লেখার একদম শুরুতে করা হয়েছে। এরপর বড় সাহেব কর্ণেল ওয়া নিজে তথ্যটি যাচাই করে জনসমক্ষে স্বীকৃতি দিলেন, এই পিক ফিফটিনই হল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পর্বতশৃঙ্গ। কিন্তু এর নাম কী হবে ? এভারেস্ট যখন দায়িত্বে ছিলেন তখন তিনি স্থানীয় এলাকার মানুষের মুখের নাম অনুযায়ী পর্বতশৃংখে  নাম প্রস্তাব করতেন। এভাবেই কাঞ্চনজঙ্ঘা, নন্দাদেবী ইত্যাদি নাম প্রচলিত হয়েছে। কিন্তু এই পিক ফিফটিনের নাম নিয়ে ঝামেলা হলো। কারণ পিক ফিফটিন নেপাল আর তিব্বতের মাঝে অবস্থিত, দুই দেশে এর নাম দুই রকম। তখন কর্ণেল ওয়া নিজের পুরনো প্রভুকে একজন বাধ্য ভৃত্যের মতো খুশি করতে চাইলেন। তিনি রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটিকে একটি চিঠি লিখে পিক ফিফটিনকে ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ নামের প্রস্তাব জানালেন। যে শৃঙ্গ আবিষ্কার বা পরিমাপে এভারেস্টের কোনো ভূমিকাই ছিল না তার নাম হয়ে গেল মাউন্ট এভারেস্ট। রাধানাথ রয়ে গেলেন উপেক্ষিত।

চিত্রঃ কর্ণেল ওয়ার আঁকা এভারেস্টের ভৌগোলিক স্কেচ; ছবিসূত্র: natureinfocus.in

রাধানাথ শুধু যে জরিপের কাজই করেছেন তা নয়। ১৯২৯ সালে কলকাতার পার্ক ষ্ট্রীটে সার্ভে অফিস চত্তরেই জর্জ এভারেস্ট একটি পরিকাঠামো সহ আবহাওয়া অফিস খুলেছিলেন। ব্যবসাবাণিজ্যের সুবিধার জন্যই এটির প্রয়োজনীয়তা ছিল। এই অফিসের প্রধান ছিলেন ভি. এন. রীস (V. N. Rees)। তার অবসর গ্রহণের পরে ১৮৫২ সালে রাধানাথ সেই পদে নিযুক্ত হন। একই সঙ্গে তিনি চিফ কম্প্যুটার হিসাবে সার্ভের কাজ এবং সুপারিনটেনডেন্ট পদে আবহাওয়া অফিসের কাজ সামলাতেন। ভার নিয়েই রাধানাথ এই বিভাগটি আধুনিক ভাবে গড়ে তোলার কাজে মন দেন। ১৮৫২ সালেই তিনি দৈনিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন। ১৮৫৩ সাল থেকে আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে এসবের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তবে রাধানাথের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল বায়ুর চাপ নির্ণয়ে ব্যারোমিটার রিডিং নেবার সঠিক পদ্ধতির উদ্ভাবন। তাপমাত্রার ওঠা নামার সঙ্গে ব্যারোমিটারের সঙ্গে যে পিতলের স্কেলটি থাকে সেটির দৈর্ঘের পরিবর্তন এবং সেই সঙ্গে ব্যারোমিটারের ভেতরের পারদের সঙ্কোচন-প্রসারণের জন্য আপাত ভাবে যে রিডিং পাওয়া যায় সেটির যথাযথ সংশোধন না করলে গৃহীত মানের শুদ্ধতা বজায় থাকবে না। রাধানাথ এই সংশোধনের জন্য একটি তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। এ ধরণের তালিকা বিদেশে ছিল, কিন্তু রাধানাথ তার নিজের মত করে এটি প্রস্তুত করেছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তার এই উদ্ভাবনী ক্ষমতার বরাবরই প্রশংসা করতেন।

স্বীকৃতি ও উপেক্ষা

রাধানাথের গণিত ও পদার্থবিদ্যার জ্ঞান এবং তার উদ্ভাবনী শক্তি ও অসাধারণ কর্মক্ষমতাকে সার্ভে অফিসের সহকর্মীরা এবং ইংরেজ কর্তৃপক্ষ প্রশংসা ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতেই দেখেছেন। ১৮৫১ সালের ১৫ই এপ্রিল বৃটিশ পার্লামেন্টে জি. টি. এস. সম্বন্ধে যে রিপোর্ট পেশ করা হয় তাতে অন্যান্য কর্মীদের মধ্যে রাধানাথকে বিশেষ ভাবে স্বীকৃতি জানানো হয় –

“… Among them may be mentioned as most conspicuous for ability, Babu Radhanath Sikdar, a native of India of Brahminical extraction whose mathematical attainments are of the highest order.”

জর্জ এভারেস্ট রাধানাথের প্রশংসা করে তার বাবাকে যে চিঠি দিয়েছিলেন তার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। অ্যান্ড্রু ওয়াও রাধানাথের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। রাধানাথের গণিতের জ্ঞান ও অন্যান্য অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে জার্মানীর ব্যাভেরিয়ান শাখার বিখ্যাত ‘ফিলোসফিক্যাস সোসাইটি’ (Philosophical Society)’ তাকে তাদের সদস্য নির্বাচিত করেন। এদেশীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন।

জরিপের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বই ‘ম্যানুয়াল অব সার্ভেয়িং ফর ইন্ডিয়া’ প্রকাশিত হয় ১৮৫১ সালে।

বইটির সূচনায় লেখা হয়েছিল –

“In Parts III (Surveying) and V, the computers have been largely assisted by Babu Radhanath Sikdar, distinguished head of the computing department of the GTSI. The Chapters 15, 17 up to 21 inclusive of Part III, and the whole of Part V are entirely by his own. Besides he compiled a set of auxiliary tables for the surveying department which were found to be greatly useful.”

এর প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে ঠিকই রাধানাথের অবদানের কিয়দংশ ছিল। কিন্তু থ্যুলিয়ার কর্তৃক তৃতীয় সংস্করণ থেকে তার অবদানটুকু রেখে স্বীকৃতি লোপাট করে দেয়া হয়। নিজেদের কায়েমী গদি টিকিয়ে রাখতে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক কাজ অবশ্য সব শাসক গোষ্ঠীই করে থাকে।

স্বনামধন্য বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাProgress of Physics in Past Twenty-five Years’-এ লিখেছেন –

“১৮৫৪ সালে ট্রিগোনোমেট্রিক সারভের মুখ্য গণক ও বিশিষ্ট গণিতবিদ রাধানাথ শিকদার হিমালয়ের একটি লুকিয়ে থাকা শৃঙ্গকে নির্দিষ্ট করে, কয়েক বছর আগে পরিমাপ করা তথ্যের গাণিতিক বিশ্লেষণের দ্বারা দেখিয়েছেন যে এটিই পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।” [অনুবাদ লেখকের]।

এসব তথ্য হয়ত পুরনো নথিপত্র ঘাঁটলে এখনও পাওয়া যাবে, কিন্তু এসব কে মনে রাখে ? সর্বোচ্চ শৃঙ্গটির নামকরণের সময়ে রাধানাথ উপেক্ষিত রইলেন কেন ? এভারেস্টের সঙ্গেও তো তার নামটি যুক্ত করা যেত। এটাই হল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের মানসিকতা। কোন আবিষ্কারের সঙ্গে এদেশের কারো নাম জড়িয়ে রাখা বা কোন বিভাগের সর্বোচ্চ পদে এদেশের কাউকে নিয়োগ করতে তাদের অনাগ্রহ ও অনীহা ছিল অপরিসীম। পরোক্ষ ভাবে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।

যেমন সিডনি জেরাল্ড বুরার্ড (Sidney Gerald Burrard), যিনি ১৯১১ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত ভারতের সার্ভেয়ার জেনেরাল ছিলেন, তিনি তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন –

“About 1852 the chief computer of the office at Calcutta informed Sir Andrew Waugh that a peak designated XV had been found to be higher than any other hitherto measured in the World. The peak was discovered by the computers to have been observed from six different stations; on no occasion had the observer suspected that he was viewing through the telescope the highest point of the earth”.

এখানে কিন্তু রাধানাথের নাম উল্লেখ করা হ’ল না। পরোক্ষ ভাবে বলা হয়েছে ‘the chief computer of the office at Calcutta’, তবু সোজাসুজি রাধানাথের নাম নেই, তবে যাকে বলেছিলেন সেই অ্যান্ড্রু ওয়ার নাম কিন্তু রয়েছে।

ভারত সরকার ২০০৪ সালের ২৭শে জুন তার স্মরণে একটি ডাক টিকিট প্রকাশ করেছেন এবং সম্প্রতি কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে তার নামাঙ্কিত একটি ফলক স্থাপিত হয়েছে।

রাধানাথ কোন কারণে হয়ত সারভে বিভাগ থেকে সরে যেতে চাইছিলেন। এর কারণ অনুমান করা শক্ত। এভারেস্টের আমলে ডেপুটি কালেক্টরের পদে এবং দ্বিতীয়বার অ্যান্ড্রু ওয়ার সময়ে ম্যাজিস্ট্রেটের পদের জন্য তিনি আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সার্ভে বিভাগে তিনি ছিলেন অপরিহার্য, অতএব কোন বারই তাকে ছাড়া হয়নি, একবার নিয়মের দোহাই দিয়ে এবং দ্বিতীয়বার তার মাইনে বাড়িয়ে দিয়ে তাকে আটকে রাখা হয়। যে সব পদের জন্য রাধানাথ দরখাস্ত করেছিলেন সে সব ক্ষেত্রে তার গণিত সংক্রান্ত কোন জ্ঞানই কাজে লাগত না, কাজেই কেন তিনি চলে যেতে চাইছিলেন সেটা স্পষ্ট নয়। আপাত দৃষ্টিতে তার প্রশংসা করা হলেও তাকে তার প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করাই কি এর কারণ ?

কিছু বৈশিষ্ট্য

শুধু রাধানাথের গণিতের জ্ঞান ও অন্যান্য অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে জার্মানীর ব্যাভেরিয়ান শাখার বিখ্যাত ‘ফিলোসফিক্যাস সোসাইটি’ তাকে তাদের সদস্য নির্বাচিত করে। সে সময়ের ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এ সম্মান লাভ করেছিলেন।

রাধানাথের স্মরণে ভারতীয় ডাকটিকিট; ছবিসূত্র: stampsathi.in

রাধানাথ ছিলেন অত্যন্ত সমাজ সচেতন মানুষ। ১৮৬২ সালে অবসর গ্রহণের পর তার বন্ধু প্যারিচাঁদ মিত্রের সাথে মিলে ‘মাসিক পত্রিকা’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। হিন্দু ধর্মে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি বরাবরই সরব ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক।

রাধানাথের ইংরাজি লেখার মান ছিল অতি উৎকৃষ্ট। অতি অল্প বয়স থেকেই তিনি সুন্দর রচনাশৈলীর পরিচয় দিয়েছেন। তার উচ্ছ্বাসহীন উচ্চ মানের লেখা সে সময়ের পত্র-পত্রিকাতেও প্রশংসিত হয়েছে।

রাধানাথের খাদ্যাভাস ছিল একটু অদ্ভুত ধরণের। তিনি প্রচুর পরিমাণে গোমাংস ভক্ষণ করতেন। তার মতে গোমাংস ভক্ষণ না করলে কোন জাতিই বড় হতে পারে না। তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত বলবান ও দৃঢ় শরীরের মানুষ এবং প্রায়ই নাকি গোরাদের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়তেন। ডিরোজিয়োর (১৮০৯-১৮৩১) প্রতক্ষ্য প্রভাব পড়েছিল রাধানাথের ওপর। ডিরোজিয়োর জন্ম ভারতে এবং জন্মসূত্রে প্রোটেস্টান্ট খ্রীষ্টান হলেও খৃষ্টধর্ম তার মনে তেমন রেখাপাত করে নি। তিনি ছিলেন সব ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিরোধী মুক্ত মনের মানুষ।  রাধানাথেরও ধর্ম সম্বন্ধে কোন গোড়ামি ছিল না। ইসলাম বা হিন্দু কোন ধর্মের দ্বারাই তিনি প্রভাবিত হন নি।  অকৃতদার রাধানাথ সারা জীবন শুধু কাজ নিয়েই ব্যাস্ত থেকেছেন। রাধানাথ পরে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। চন্দননগরে সাহেবদের কবরস্থানে তার কবর আজও রয়েছে। রাধানাথ ইংরাজিতে তার নামের বানান লিখতেন Radhanath Sickdhar.

রাধানাথ ছিলেন অকুতোভয় অসমসাহসী মানুষ। অন্যায়ের খোলাখুলি প্রতিবাদ করতে তিনি পিছপা হতেন না। ১৮৪৩ সালে দেরাদুনে কর্মরত অবস্থায় তিনি একবার ম্যাজিস্ট্রেট ভ্যান্সিটার্টের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। ভ্যান্সিটার্ট তার বিভাগের মাইনে করা লোকদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করাতেন এবং তারা আপত্তি জানালে তিনি চাবুক মারতেন। এই অমানবিক কাজের প্রতিবাদ করায় জর্জ এভারেস্টের কাছে রাধানাথের বিরুদ্ধে সাক্ষী সহ অভিযোগ পেশ করা হয়। অবশ্য এতে রাধানাথের কোন ক্ষতি হয়েছিল কিনা জানা যায় নি।

সাহিত্য-পত্রিকা প্রকাশ

রাধানাথ দীর্ঘদিন বাংলার বাইরে থাকায় ইংরেজি ভাষায় যেমন দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তেমন হয় নি। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ ছিল তখনকার একটি নাম করা পত্রিকা। সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। গভীর তত্ত্ব বিষয়ক রচনা এতে প্রকাশিত হত। কিন্তু এই সংস্কৃত-ঘেঁষা বাংলা ছিল রাধানাথের না-পসন্দ। তার মত ছিল, যে লেখা মেয়েরা বুঝতে পারে না সেটা বাংলাই নয়। তিনি ছিলেন কথ্য ভাষায় রচনা প্রকাশে আগ্রহী। এটার রূপ দিতে তিনি বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে ‘মাসিক পত্রিকা’ ( ‘অবসরে’ এটি পুরানো দিনের পত্রিকা প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে ) নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরে অবশ্য প্যারীচাঁদ ‘আলালের ঘরের দুলাল’ লিখে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে রাধানাথ ছিলেন অত্যন্ত উৎসাহী। বাস্তবিকই ‘মাসিক পত্রিকা’য় প্রকাশিত লেখা পড়তে অল্পশিক্ষিত লোকের কোন অসুবিধাই হত না। রাধানাথও এতে লিখতেন। বহু পরে কথ্য ভাষায় গদ্য রচনার যে রীতি চালু হয়েছিল, এটিই হয় ত তার প্রথম পদক্ষেপ।

শেষ জীবন

চাকরী থেকে অবসর নিয়ে তিনি চন্দননগরের গোঁদলপাড়ায় গঙ্গার পারে বাড়ি তৈরি সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের তিনি খুব ভালবাসতেন। শেষ জীবনে আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব ও ছোটদের সঙ্গেই তার দিন কাটত। ১৮৭০ সালের ১৭ই মে ৫৭ বছর বয়সে আধুনিক ভারতের প্রথম বৈজ্ঞানিকের জীবনাবসান হয়।

Comments are closed.