জম্বী কথাটা শোনার সাথে সাথেই মানুষের কল্পনার দৃশ্যপটে চলে আসে হাত,পা ,মুখে কোন সেলাইয়ের দাগ এবং অনুভূতিহীন মানুষের কথা। কারো কারো আবার মনে পড়ে যায় রূপকথার ফ্রাংকেস্টাইনের কথা ।
তবে সর্বপ্রথম ১৮১৯ সালে জম্বী কথাটা ব্যাহার করেছিলেন ব্রাজিলের একজন কবি । যা এসেছিল আফ্রিকান শব্দ ‘nZumbi‘ যার অর্থ সোল ,স্পিরিট বা আত্মা ।
বহু আগে যখন বিজ্ঞানকে জাদু মনে করা হত ,তখন জম্বী কল্পকাহিনীর সংজ্ঞাটাও ছিল- জাদুর মাধ্যমে মৃতদেহকে জাগ্রত করে এক অনুভূতিহীন মানুষে পরিণত করা ।
তবে সময়ের ব্যবধান এবং বিজ্ঞানের প্রসারের ফল আজ মানুষের জম্বীর সংজ্ঞার মাঝেও লক্ষ্যনীয়। বর্তমানের জম্বীর গল্পগুলোতে দেখা যায় যে , বিজ্ঞানের কোন জটিল পরীক্ষার ফলে অথবা কোন ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার ফলে মানুষের মস্তিষ্ক আক্রমনের ফলে তাকে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য করে দেয়া অথবা কোন যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য অন্য দেশের এক বায়োলজিক্যাল যুদ্ধ শুরুর পরিকল্পনার থেকে এর সূত্রপাত।
আর এ কাহিনীগুলোর জনপ্রিয়তার প্রমানই যেন বেশ কয়েক বছর আগে মুক্তি পাওয়া কোরিয়ান ছবি ‘এ ট্রেন টু বুসান’.
তবে বাস্তবে মানব জাতির মাঝে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মত জম্বী না থাকলেও আমাদের চারপাশের প্রনীজগতে বিশেষ করে পতজ্ঞ বা ইনসেক্টস প্রজাতীতে এমন অনেক উদাহরণ বিদ্যমান। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় হল ফাঞ্জাই বা ছত্রাক এবং পিপড়ার গল্প যা এ আর্টিকেলের সর্বশেষে বলা হয়েছে।
জালবোনা মাকড়শাঃ
মাকড়শা সর্ম্পকে যাদের সাধারণ কিছু জ্ঞান আছে তারা আমরা সবাই জানি যে, মাকড়শা তার একই জাল দুধরনের তাঁড় দিয়ে বোনে। একটা তার নিজের হাঁটাচলার জন্য আঠালো বিহীন এবং অন্যটা আঠালো যেনো সেটার কাছে পোঁকামাকড় আসলেই আটকে যায় এবং পরবর্তীতে যা খাদ্যে পরিনীত হয় ঐ মাকড়শার।
উপরের কথাগুলো শুনে মোটা দাগে নিঃসন্দেহে মনে হয় মাকড়ষা একটি অত্যন্ত চালাক প্রানি মনে হচ্ছে, তাই নয় কি?
কিন্তু কখনো যদি বলা হয়, এই অত্যন্ত চালাক প্রানিটিই তার আত্মরক্ষার প্রধান হাতিয়ার তার এই জালটি বোনে তার মৃত্যুর জন্য এবং একই সাথে অন্য একটি পতঙ্গের খাবার এবং নিরাপদ বাসস্থান হবার জন্য। তাহলে একথা কি খুব সহজে বিশ্বাসযোগ্য বা বোধগম্য হবে?
জানি উত্তরটা হবে না, কিন্তু বাস্তবে ঠিক এটাই হয়। যখন একটি রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা সে তার মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে এবং উপরের জম্বী থিওরিগুলো অনুসারে পরিনীত হয় এক জম্বীতে ।
আর এ সবকিছুই শুরু হয় কোন একদিনের তার নিয়মিত জালবোনা এবং এরপর শিকারীর আগমনের অপেক্ষার মধ্য দিয়ে ।
গল্পটা অনেকটা এমন যে,
কোস্টারিকার এক জঙ্গলে এক গাছের ডালে অথবা হতে পারে কোন ঝোপের মাঝে নিপুণ হাতে মনের মত জালবুনে, কোন এক পড়ন্ত বিকেলের সুন্দর আবহাওয়ায় অথবা এক রৌদ্র উজ্জ্বল দিনে, Plesiometa argyra নামক মাকড়শা নিশ্চিন্ত মনে তার জালে শিকারের অপেক্ষায় বসে আছে।

ঠিক এমন সময় তার মনের ইচ্ছেটা পূরণ করতেই যেন তার জালে Hymenoepimecis argyraphaga নামক এক ওয়াপ্স বা ভিমরুল তার জালে আটকা পড়ল ।
আর মাকড়শাটাও খুশি মনে শিকাড়কে খাবার জন্য এগিয়ে গেল । ভুলেও জানতে পাড়লোনা যে এই খাবারই কিছুদিন পর তার জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এই ভিমরুলকে খাবার পরপরই তা কাড়শার পেটে সেখানে ডিম পারে এবং সেই ডিম থেকে লার্ভা বেড় হবার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করে ।
কিন্তু যে মুহূর্তে ডিম থেকে লার্ভা বের হয় ঠিক সেই মুহূর্তে তারা এক ধরনের কেমিক্যাল বা রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরন করে ।

যার ফলে সেই মাকড়শাটা আস্তে আস্তে তাদের দ্বারা মাইন্ড কন্ট্রল বা মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে এবং এর ফলে পরিন্ত হয় জম্বীতে।

জম্বিতে পরিনত হবার পর। সেই জম্বী মাকড়শাকে দিয়ে তারা এ নতুন ধরনের জাল বুনে কিন্তু এটা এই জম্বী মাকড়শার জন্য নয় বরং তাদের নিরাপদে থাকার জন্য।
এরপর তারা সেই মাকড়শা ঠিক নতুন বোনা জালের মাঝখানে গিয়ে বসে এবং তার চারদিকে এক ধরনের কোকুন বুনে, ঠিক শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হবার সময় শুয়ো পোকা যেমন বুনে ।

এরপর সেই লার্ভা থেকে পূর্নাঙ্গ ভিমরুল না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান করে এবং সেই মাকড়শার দেহ কেই তাদের খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে এবং পূর্ন বয়সে বের হয়ে উড়ে চলে যায় নতুন জীবনের অভিযানে ।
এতো গেলো জম্বী মাকড়শার কথা এবার যাওয়া যাক জম্বী তেলাপোকার কাছে।
জম্বী তেলাপোকা এবং জুয়েল ওয়াপসঃ

তেলাপোকা নামটা কারো মনের আতঙ্কের সৃষ্টি করে, কারো বা আবার ভয়ের, আবার অনেকের মধ্যে সৃষ্টি করে গা ঘিনঘিনে এক ভাব। কারো বা মনে উঁকি দেয় নানা স্মৃতি। তা হতে পারে স্কুলের ব্যাহারিক ক্লাসের মজার স্মৃতি অথবা হতে পারে উড়ন্ত তেলাপোকার ভয়ের স্মৃতি। আর এসব মনে পরার সাথে সাথে দুটি প্রশ্ন হয়তো আমাদের সবার মনেই উদয় হয় যে, এটাতো আমাদের কোন কাজেই আসেনা, তাহলে কেন প্রকৃতিতে এর বসবাস? এবং মশার মত এই তেলাপোকাকে কিভাবে সমূলে উৎখাত করা যায় । এর জন্য অনেকেই হয়তো অনেক ধরনের উপায়ও ব্যবহার করেছেন।
কিন্তু বিজ্ঞানের মতে কিন্তু বাস্তুতন্ত্রে এদের অবদান কম নয় আবার কখনই সমূলে এদের উৎখাত করা সম্ভব নয় । কারন তারা প্রচন্ড চাপ, তাপ এমন কি রেডিয়েশনেও মানিয়ে চলতে পারে এবং চলে এসেছেও ।
যার ফলে ডাইনোসর যুগে ডাইনোসররা মারা গেলেও বেঁচে গিয়েছিল তারা এবং জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমানু বিস্ফরোনের পর মানুষ সহ অন্যান্য প্রানি মারা গেলেও সে ধবংসস্তুপ থেকে জীবিত পাওয়া গিয়েছিলো এই তেলাপোকাকেই ।
কিন্তু কখনো কি ভাবতে পারেন যে , এই অদম্য তেলাপোকার মস্তিষ্ককেই নিয়ন্ত্রন করতে পারে অন্য কেউ? এবং এভাবে তাকে নিয়ে যেতে পারে মৃত্যুর দিকে?
হ্যাঁ , ঠিক এই অভাবনীয় ঘটনাটিই ঘটে যখন তেলাপোকা এবং জুয়েল ওয়াপস মুখোমুখি হয়।
কোন মেয়ে জুয়েল ওয়াপস যখন তার ডিম পারার সময়ে উপনিত হয় ,তখন সে খোঁজ শুরু করে একটি তেলাপোকার । এরপর সে প্রথমে তার উপর একধরণের বিষাক্ত কেমিক্যাল পুশ করে যা তাকে সাময়িক অবশ বা প্যারালাইজড করে ফেলে।
তেলাপোকা অবস হবার সাথে সাথে সে তার মাথার কাছে যায় এবং গবেষকদের মতে এমন একটি কেমিক্যাল সেখানে পুশ করে যা কিনা , তার মস্তিষ্কের এমন কোন জাগায় কাজ করে যার ফলে সে তার নিজের ইচ্ছাশক্তিতে চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
ঠিক এই মুর্হূতে এই ওয়াপস সেই তেলাপোকার ঘারে চড়ে বসে এবং অনেকটা তার মাথার এন্টেনা বা শুড় ধরে এবং তাকে সে যেখানে যেতে চায় তেলাপোকাটা তাকে সেখানেই নিয়ে যায়। অর্থাৎ একটি নিরাপদ আশ্রয়ে।
একটি নিরাপদ আশ্রয় অর্থাৎ কোন গর্তের ভেতরে যাবার পর সেই ওয়াপসটা তেলেপোকাটার শরীরের ভিতরে ধুকে এবং ডিম পাড়ে আর এভাবেই সে তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আগমনের জন্য একটি নিশ্চিত আবাস স্থল তৈরি করে এবং অপেক্ষায় থাকে তাদের বড় হবার , ডিম ফুটে বের হয়ে আসার এবং পৃথিবীর আলো দেখার।
মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রনকারী বলঃ
ফুটবল , টেনিস বল , ক্রিকেট বল কত প্রকার বলের নামইতো আমরা শুনেছি , কিন্তু মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রঙ্কারী বল ?
কথাটা একটু অদ্ভদ শুনাচ্ছে তাই নয় কি?
উপরের হেডলাইনটা পড়ার পর অনেকের মনেই হয়তো এই প্রশ্নটা এসেছে যে,
এটা আবার কেমন বল অথবা এটা কি সাইন্স ফিকশন গল্পের মতই বুদ্ধির নিয়ন্ত্রক কোন যন্ত্র ?
উত্তরটি হলো না । এটা সাইন্স ফিকশন গল্পের মত কোন যন্ত্র নয় , বরং একধরনের পরজীবি এবং একটি পিপড়ার গল্প। আর এ গল্পটির আছে তিনটি ধাপ যা কিনা চলে এক বৃত্তাকার পথে।
গল্পের প্রথম ধাপঃ
গল্পটার শুরু হবে কোন এক তৃনভোজী প্রনিকে দিয়ে । অনেক সময় তৃনভোজী প্রনী যেমন গরুর অন্ত্র বা পেটের ভিতরে এক ধরনের পরজীবি যা কিনা একধরনের ফ্লাট ওয়ার্ম বা কৃমি থাকে । যারা তাদের দেহের ভেতরে অবস্থান করে এবং সেখান থেকে পুষ্টি আহরন করে । এরপর তাদের জীবন চক্রের কোন এক পর্যায়ে তারা ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম সেই প্রানির মলের সাথে দেহ থেকে বের হয়ে যায় আর এভাবেই প্রথম ভাগের সমাপ্তি ঘটে ।
দ্বিতীয় ধাপঃ
দ্বিতীয় ধাপটি শুরু হয় প্রথম ধাপের শেষ থেকে । অর্থাৎ যখন সেই পরজীবির ডিম সেই তৃনভোজী প্রানির মলের মধ্য দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে তখন তা কোন শামক খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে ।
শামুক সেই ডিম খাদ্য হিসেবে গ্রহন করার পর তা তার পেটে যাবার সাথে সাথেই সেখানে এক ধরনের মিউকাস বা পিচ্ছিল পদার্থ এসে তাকে ঘিরে ফেলে এবং একধরনের সিস্ট গঠন করে । যা পরবর্তিতে সে বমির মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয় যা কিনা দেখতে অনেকটা ছোট ছোট বলের মতো দেখতে এবং নিজের অজান্তেই তৈরি করে বাস্তুতন্ত্রের অন্য আর এক প্রানীর খাবার এবং অনেকটা মৃত্যু ফাঁদ ।
তৃতীয় এবং শেষ ধাপঃ
মূলত এধাপেই সৃষ্টি হয় আরও এক জম্বীর । শামুকের ফেলে দেয়া সেই ছোট ছোট বল গুলোই পিপড়েরা তাদের খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে এবং এটা তাদের শরীরের ভিতরে যাবার সাথে সাথেই তা সেই পিপড়ের মস্তিষ্কে চলে যায় এবং এমন এক ধরনের কেমিক্যাল নিঃসরণ করে যার মাধ্যমে সেই পিপড়ের মস্তিষ্ককে তারা সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়।
এবং এরপর তাকে নিয়ে যায় কোন ঘাস বা পাতার একদম আগাতে এবং সেখানেই তাকে রেখে দেয় । যতক্ষন পর্যন্ত না কোন তৃনভোজী প্রানী সেই ঘাস বা পাতা খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে এবং তা আবার তাদের অন্ত্রে যায় এবং সেখানে গিয়ে এই ডিম পরিস্ফুটিত হয়ে অন্য এক নতুন জীবনের সৃষ্টি হয় এবং শুরু হয় এক নতুন প্রানের ।
জম্বী কাহিনী বা বাস্তব জীবনের জম্বীদের লাইনটা আরো অনেক বড় তবে এর প্রতিটি ঘটনাই ঘটে ইনসেক্ট বা পোকামাকড় শ্রেনীর প্রানীদের মাঝে এবং তা প্রধানত হয় তাদের মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রন হারানোর মাধ্যমে এবং তার মাধ্যমে অন্য কোন প্রানের পৃথিবীতে আগমনের মাধ্যমে ।
তথ্যসুত্রঃ
https://www.tandfonline.com/doi/full/10.4161/cib.3.5.12472
https://www.sciencedirect.com/science/article/abs/pii/S0022201117300824
https://jeb.biologists.org/content/218/15/2315.1.short
https://www.livescience.com/34196-zombie-animals.html
https://www.scientificamerican.com/article/real-life-zombies/