শনি গ্রহের নতুন ২০টি উপগ্রহ আবিষ্কার

আমাদের সৌরজগতে বৃহস্পতি গ্রহকে এতোদিন বলা হত মুন কিং। অর্থ্যাৎ চাঁদের রাজা। কারণ এই গ্রহকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে ৭৯ টি উপগ্রহ। তবে বৃহস্পতি যদি রাজা হয় তবে সেই রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলো শনি। ৬২টি উপগ্রহ নিয়ে তার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়তে।

মুন কিং শনি

Carnegie’s Scott S. Sheppard এর নেতৃত্বে এক গবেষক দল শনির নতুন ২০টি উপগ্রহ খুঁজে পায়। শনি গ্রহ তার চারপাশের রিং আকৃতির বলয়ের কারণে এমনিতেই সবার থেকে আলাদা ছিল। এখন যোগ হল নতুন বিশেষত্ব। এখন শনি গ্রহের মোট উপগ্রহ হল ৮২টি। বৃহস্পতিকে সরিয়ে দিয়ে সৌরজগতের নতুন মুন কিং শনি।

শনি গ্রহ

ইন্টারন্যাশনাল এসট্রোনমিকাল ইউনিয়নের মাইনর প্ল্যানেট সেন্টারের পক্ষ থেকে গেলো সোমবার এই নতুন আবিষ্কারের কথা জানানো হয়।

উপগ্রহের ধরণ

আবিষ্কৃত নতুন উপগ্রহ গুলোর ব্যাসার্ধ ৫ কিলোমিটার থেকে ৩ মাইল। এর মধ্যে ১৭টি উপগ্রহ রেট্রোগ্রেড ডিরেকশনে শনিকে প্রদক্ষিণ করছে। অর্থ্যাৎ শনি গ্রহ তার অক্ষ বরাবর যে দিকে ঘূর্ণায়মান এই ১৭টি উপগ্রহ তার বিপরীত দিক থেকে শনিকে প্রদক্ষিণ করে। আর বাকি ৩টি হল প্রোগ্রেড বা শনির ঘূর্ণন দিক বরাবরই এরা শনিকে প্রদক্ষিণ করে।

প্রোগ্রেড উপগ্রহ গুলোর মধ্যে ২টি শনির বেশ কাছাকাছি। এরা শনিকে একবার সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করতে ২ বছর সময় নেয়। অধিকাংশ রেট্রোগ্রেড উপগ্রহ গুলো বেশ দূরে দূরে। দূরের রেট্রোগ্রেড উপগ্রহ গুলো আর একটি প্রোগ্রেড উপগ্রহ মোটামুটিভাবে ৩ বছরেরও বেশি সময় নেয় শনিকে একবার প্রদক্ষিণ করতে। এব্যাপারে শেপার্ড বলেন,

এই উপগ্রহ গুলোর কক্ষপথ নিয়ে আরো গবেষণা করলে এদের জন্ম কিভাবে হল তা জানা যাবে। আর এদের গঠনপ্রক্রিয়ার সময় শনি গ্রহের অবস্থা কি রকম ছিল তাও জানা যাবে।

উপগ্রহ গুলোকে তিনটি ক্লাসটারে ভাগ করা হয়েছে। এক জাতীয় অনেক গুলো বস্তুকে একসাথে ক্লাসটার বলা হয়। কত কোণে বা কতটুকু বেঁকে গ্রহ গুলো শনিকে প্রদক্ষিণ করছে তার উপর ভিত্তি করে তাদের ক্লাসটারে ভাগ করা হয়েছে।

সদ্য আবিষ্কৃত দুইটি প্রোগ্রেড উপগ্রহকে ইনউইট ক্লাসটারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরা ৪৬ ডিগ্রী কোণে শনিকে প্রদক্ষিণ করছে। ইনউইট নামকরণ করা হয়েছে ইনউইট মাইথোলজি থেকে। ইনউইট নামে একটি ধর্ম প্রচলিত আছে। ধারণা করা হচ্ছে এই দুইটি উপগ্রহ কিছুদিন আগেও একত্রে ছিল। অর্থ্যাৎ এই দুই উপগ্রহ মিলে একটি বড় উপগ্রহ ছিল। কোন কারণে তা ভেঙে যায়।

দ্বিতীয় ক্লাসটারটি হল নোর্স ক্লাসটার। এই নামকরণটি হয়েছে নোর্স মাইথোলজি থেকে। সদ্য আবিষ্কৃত সবগুলো রেট্রোগ্রেড উপগ্রহ এই ক্লাসটারের সদস্য। এরাও ৪৬ ডিগ্রী কোণে শনিকে প্রদক্ষিণ করছে। ধারণা করা হচ্ছে এরাও কোন বৃহৎ উপগ্রহের খন্ডিত অংশ। বাকি থাকলো একটি প্রোগ্রেড উপগ্রহ। এটি শনির সবচেয়ে দূরবর্তী উপগ্রহ। এটি গ্যালিক ক্লাসটারের অন্তর্ভুক্ত এবং এটি ৩৬ ডিগ্রী কোণে শনিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। শনির পূর্ববর্তী প্রোগ্রেড উপগ্রহ গুলোর সাথে এর মিল রয়েছে। শনি থেকে এর অবস্থান অনেক দূরে থাকায় এটির শনির আকর্ষণ বলকে ভেদ করে বাইরে চলে যাওয়ার একটি সম্ভাবনা রয়েছে।  এব্যাপারে শেপার্ড বলেন,

জুপিটারের উপগ্রহ গুলোর মধ্যেও এরকম উপদল রয়েছে। খুব সম্ভবত শনির পূর্বের উপগ্রহ গুলোর মাঝে সংঘর্ষ হয়েছে এবং তার ফলে নতুন উপগ্রহ গুলোর জন্ম হয়েছে। অথবা শনির বলয়ের বাইরে থেকে কোন এস্টরয়েড বা কমেট এসে আগের উপগ্রহ গুলোকে ধাক্কা দিয়েছে আর তারপর এই নতুন উপগ্রহ গুলোর জন্ম হয়েছে।

যদি কোন বড় উপগ্রহ দুই ভাগে ভাগ হয়। আর তার আশেপাশে যদি যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাস আর ধূলিকণা থাকে তবে খন্ডিত অংশটি সেই গ্যাস-ধূলিকণা আকর্ষন করে। এদের মাঝে ঘর্ষণ খুব একটা হয় না। এরা সর্পিলাকারে আবদ্ধ অবস্থায় গ্রহের আকর্ষন ক্ষেত্রের (যে গ্রহের উপগ্রহ) মাঝে ঘুরতে থাকে। শেপার্ডের মন্তব্য অনুযায়ী,

আমাদের সৌরজগতের প্রাক্কালে সূর্যের চারপাশে গ্যাস ও ধূলিকণা ডিস্ক আকারে ঘূর্ণন অবস্থায় ছিলো। এই গ্যাস ও ধূলিকণা মিলিত হয়েই সৌরজগতের সকল গ্রহ তৈরি করে। যেহেতু শনি গ্রহ সম্পূর্ণ ভাবে এখনো গঠিত হয় নি তাই শনির চারপাশে গ্যাস ও ধূলিকণা থাকা স্বাভাবিক।

শনি ও তার উপগ্রহের কক্ষপথ- নাসার তৈরি করা ইলাসট্রেশন

কিন্তু যেহেতু শনির বৃহৎ উপগ্রহ গুলো ভেঙে গিয়েছে। এবং খন্ডিত অংশগুলো গ্যাস ও ধূলিকণার সাহায্যে নতুন উপগ্রহ হিসেবে শনিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তাই বলা যায় শনির গঠিন প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। কিছু গ্যাস ও ধূলিকণা অন্যত্র চলে গেলেও শনির কোন সমস্যা হবে না। গঠন প্রক্রিয়া বাকি থাকলে শনি গ্যাস ও ধূলিকণা উপগ্রহ গঠনে ছেড়ে দিতো না।

আমেরিকার হাওয়াই স্টেটে অবস্থিত মাওনা কেয়া নামক নিশ্চল আগ্নেয়গিরির চূড়ায় পৃথিবীর আবহাওয়া নিরূপণের জন্য সুবারু টেলিস্কোপ প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এই টেলিস্কোপ দিয়েই শনির উপগ্রহগুলো আবিষ্কার করা হয়। গবেষকদলের প্রধান শেপার্ড হলেও তার অন্যতম সহযোগিরা হলেন ডেভিড জেউইট এবং হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্যান ক্লেয়ানা। শেপার্ড আরো জানান,

পৃথিবীর শক্তিশালী সব টেলিস্কোপের সাহায্যে আমরা দানব গ্রহগুলোর সকল ছোট ছোট উপগ্রহ খুঁজার চেষ্টা করছি। এতে করে সৌরজগতের গ্রহ কিভাবে গঠিত হল এবং ঠিক কি প্রক্রিয়ায় তারা আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে সে ব্যাপারেও আমরা জানতে পারবো।

সুবারু টেলিস্কোপ

গত বছর শেপার্ড জুপিটারের ১২টি নতুন উপগ্রহ আবিষ্কার করেন। তার মধ্যে ৫টির নামকরণের জন্য একটি অনলাইন ভিত্তিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত করা হয়। তার নাম ছিল “জুপিটার মুন নেমিং কনটেস্ট”।

গতবারের জনপ্রিয়তা দেখে এবারো শনির নতুন উপগ্রহের নামকরণের জন্যে একটি অনলাইন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এবারের প্রতিযোগিতার নিয়ম হচ্ছে শনির উপগ্রহের নামকরণ ইনউইট, গ্যালিক ও নোর্স মাইথোলজির দানবদের নামানুসারে হতে হবে। প্রতিযোগিতার বিবরণ জানতে ক্লিক করুন এখানে

তথ্যসূত্রঃ science daily, popular mechanics, curiosity.com

Comments are closed.