বিজ্ঞানের চোখে “ঘুম”

জীবনের এক- তৃতীয়াংশ সময় আমরা ঘুমিয়ে কাঁটাই। হ্যা ঠিকই পড়েছেন। তিন ভাগের একভাগ। যদি আপনার বয়স হয় ২১, তবে এরই মধ্যে আপনি ৭ বছর ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। কিন্তু আমাদের অধিকাংশেরই ধারণা নেই চোখ বন্ধ করে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার পর কী ঘটে? কতক্ষণ ধরে ঘটে? কেন ঘটে? এর প্রয়োজনীয়তা কী? কোনো দ্বিতীয় চিন্তা না করেই আমরা চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ি।

১৯৫০ সালে REM বা Rapid Eye Movement আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত বিজ্ঞান, ঘুমকে এক প্রকার অবহেলা করে আসছিলো। কিন্তু REM আবিস্কার হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে শুরু করলেন যে অবচেতন মনের ক্রিয়াকলাপ, আমাদের চিন্তার চেয়েও বেশী বৈচিত্র-পূর্ণ। কয়েক শতাব্দী আগেই আমরা ভাবতাম, ঘুম হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কের রিসেট বাটন , যেটার ফলে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রসার ঘটার সাথে সাথে আমরা জানতে পারলাম, ঘুম হচ্ছে মানুষ এবং প্রাণীর জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা।

Image result for what happen when we sleep

বাইরে থেকে দেখলে যদিও মনে হয়, ঘুমিয়ে পড়লে আমরা তেমন কিছুই করিনা, কিন্তু নিউরোসাইন্স বলছে ভিন্ন কথা। মানুষের ঘুমের প্যাটার্ন মস্তিষ্কের দুটি কেমিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক সিগন্যাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আমরা যখন জেগে থাকি তখন থ্যালামাস, হাইপোথ্যালামাসের নিউরোট্রান্সমিটার, সেরিব্রাল কর্টেক্সকে গভীর থেকে জাগিয়ে রাখে, অর্থাৎ আমাদের চেতন সজাগ থাকে। কিন্তু সারাদিন জুড়ে নিউরন গুলো শক্তি উৎপাদনের জন্য ভেঙ্গে ATP তৈরী করে। এই বিক্রিয়ায় বাই প্রোডাক্ট হিসেবে এডেনোসিন তৈরী হয়। যা কিনা হাইপোথ্যালামাসের কাছে স্লিপ নিউরন গুলোকে জাগিয়ে তোলে। আমাদের মস্তিষ্কের একেবারে কেন্দ্রীয় অঞ্চল বায়োলজিকাল ঘড়ি হিসেবে কাজ করে। দিনের আলো ফুটলে,  চোখের রেটিনাতে আলোক সংবেদী নিউরনগুলো মস্তিষ্কের সেই কেন্দ্রীয় অঞ্চলে সিগনাল দেয়। এই নিউরনগুলো এমন ভাবে ট্রেনিং দেওয়া থাকে যাতে করে বায়োলজিকাল ঘড়ি , এ ক্ষেত্রে সুইচ পৃথীবীর ২৪ ঘন্টার দিন-রাতের চক্রের সাথে সমন্বয় করে অন-অফ করতে পারে। যাতে শরীর বুঝতে পারে কখন ঘুম পাবে, আর কখন জেগে থাকতে হবে। এই চক্রকে বলা হয় Circadian Rythm.

Image result for human brain anatomy diagram while sleep

যখন অন্ধকার হয়, তখন এই মাস্টার সুইচ মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্ল্যান্ডকে সিগন্যাল দেয় শরীরের রক্ত প্রবাহে মেলাটোনিন হরমোনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে। ঝিমানো শুরু হয়, শরীরে তাপমাত্রাও কিছুটা কমে যায়। এই তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে অনেকেই চাদরের বাইরে শুধু পা বের করে ঘুমাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শরীরের এসব রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ মস্তিষ্ককে একটাই নির্দেশনা দেয় , যখন অন্ধকার হবে, তখন ঘুমাতে হবে। তাই ডাক্তাররা অন্ধকার, ঠাণ্ডা রুমে ঘুমানোর পরামর্শ দেন।

ডাক্তাদের পরামর্শ থাকলেও ,আধুনিকতার ছোঁয়ায় অন্ধকার খুজে পাওয়া অনিশ্চিত। বর্তমান শতকে আমরা অধিকাংশই আলো দূষণ বা লাইট পলিউশনের স্বীকার। আর্টিফিশিয়াল লাইট যেমন মোবাইল, কম্পিউটার, টিভির ব্লু লাইট আমাদের চোখের জন্য ক্ষতিকারক। রাতে বিছানায় শুয়ে মোবাইল টেপা,কিংবা টিভি দেখায় এই ব্লু লাইট আর সূর্যের আলোর পার্থক্য মস্তিষ্ক করতে পারেনা। এতে মেলাটোনিন হরমোন তৈরী বাধাপ্রাপ্ত হয়। আর্টিফিশাল লাইটের সামনে মাত্রাতিরিক্ত সময় কাটানোর দরুণ বিষণ্নতা, ডায়বেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সারেও ভুগতে হয়। 

প্রাচীনকালে, মানুষজন সুর্যাস্তের পরপরই ঘুমিয়ে পরতো। যাকে First Sleep নামে বলা যেতে পারে। ৪-৫ ঘণ্টা ঘুমানোর পরে জেগে উঠে পড়াশুনো, অন্যান্য কাজ কিছুক্ষন করে আবার ঘুমিয়ে পড়ত। Second sleep শেষ করে উঠত একদম সকালে । এতে করে তারা ১০-১১ ঘণ্টা ঘুমানোর পিছে সময় ব্যয় করত। নতুন গবেষণা বলছে, আমরা যদি আর্টিফিশিয়াল লাইট থেকে দূরে থাকতে পারি, তবে আমরা আস্তে আস্তে আবার এই ফার্স্ট স্লিপ, সেকেন্ড স্লিপের প্যাটার্নে ফিরে যাবো।

আমরা বেশীর ভাগ মানুষই রাতে টানা কয়েক ঘণ্টা ঘুমাই। এতে করে আমাদের শরীরের সার্কেডিয়ান রিদমের ব্যাঘাত ঘটে। প্রচলিত রুটিনের বাইরে গিয়ে যদি আমরা দেরীতে ঘুমাতে যাই, তাহলে আমরা দেরীতে ঘুম থেকে উঠবো না। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, আমরা কম সময় ঘুমাতে পারবো। ফলাফল স্বরুপ আমাদের শরীর পর্যাপ্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত হবে। আজকের দিনে বাস্তবতা হলো একজন কিশোর রাতে ঘুমাচ্ছে ৫ ঘণ্টা আর প্রাপ্তপবয়ষ্ক ঘুমাচ্ছে সাড়ে ৬ ঘণ্টা, যেটা কিনা প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক সময়।

চোখ থেকে ঘুম হঠাতে চা-কফি, ক্যাপফেইন বেছে নিচ্ছেন অনেকেই। এতে করে এডেনোসিন তৈরীতে বাধা প্রাপ্ত হয়। উল্টোদিকে ঘুম আসার জন্য অনেকেই এলকোহলের শরণাপন্ন হচ্ছে। এতে করে শান্তির ঘুম তো হচ্ছেই না উলটো শরীরে সিডাটিভ প্রয়োগ হচ্ছে বিনা প্রয়োজনে।

সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে ঘুমাতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে। কতটা সেটা?

গবেষকরা এজন্য কয়েকজন মানুষকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করলেন। তিনটা গ্রুপ করা হলো। প্রথম গ্রুপের মানুষেরা ৪ ঘণ্টা, দ্বিতীয় গ্রুপের মানুষেরা ৬ ঘণ্টা আর শে গ্রুপের মানুষেরা ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর সময় পেলো। প্রায় ১৪ দিন এভাবে চলার পর দেখা গেলো যে গ্রুপের মানুষেরা ৮ ঘন্টার মতন ঘুমিয়েছিলো তারা সমস্যা সমাধাণে বাকি দুই গ্রুপের থেকে ভালো করছে। এরপর আরো দু সপ্তাহ যাওয়ার পর ৬ ঘণ্টা ঘুমানোর গ্রুপটাও সমস্যা সমাধাণের ক্ষেত্রে একই ধরণের রেসপন্স দেখালো। স্টাডি করে দেখা গেলো, দু’তিন রাত কম করে ঘুমানোর চেয়ে , এক রাত ভালো করে ঘুমালে শরীর এবং মস্তিষ্ক ফুল রিকভার করতে পারে। এভাবে টানা কয়েকমাস কম ঘুমালে মস্তিষ্ক চিরতরে ড্যামেজ হওয়ার ঝুকি থেকে যেতে পারে। তাই অধিকাংশ রিসার্চ বলে একজন মানুষের কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। প্রতিদিন সাত ঘণ্টার কম সময় ঘুমালে মুটিয়ে যাওয়া, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসের ঝুকি বেড়ে যায়, আর মৃত্যু ঝুকি ১২% বেড়ে যায়। অপরদিকে ৮ ঘণ্টার বেশি ঘুমালেও মস্তিশষ্কের কার্যক্ষমতা বেড়ে যাবে না। মাত্রাতিরিক্ত ঘুমালেও হৃদরোগ, ডায়বেটিসের ঝুকি বাড়ে আর মৃত্যু ঝুকি বাড়ে ৩০%। তাই দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমালে শরীর ও মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত সময় পাবে বিশ্রামের। 

তাহলে ঘুমের প্রয়োজন কী?

সংক্ষেপে বলতে গেলে, বেঁচে থাকার জন্য ঘুমের প্রয়োজন। অনেকসময় না ঘুমানোর জন্য ক্লান্তিতে প্রাণীরা মারা পর্যন্ত যেতে পারে । এছাড়াও আমাদের জিনের ১৫% সারক্যাদিয়ান রিদমের সাথে যুক্ত। ঘুমিয়ে থাকলে আমাদের শরীরে ১০০ ক্যালোরীর মত শক্তি বার্ন হয় । আমাদের মস্তিষ্কে সারাদিনে তৈরি হওয়া আবর্জনা নিউরোগার্বেজ  হিসেবে ঘুমের সময় বের হয়ে যায়। আবার প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স ,যা কিনা সিদ্বান্ত নেওয়ার কাজ গুলো করে, সেখানটা একমাত্র ঘুমের সময় বিশ্রাম পায়। এই প্রিফ্রন্টাল ঘুমের সময়টুকু ছাড়া সারাক্ষণই কিছুনা কিছু নিয়ে চিন্তা করে। তাই পর্যাপ্ত ঘুম অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

ঘুমের সবচেয়ে বড় উপকারিতা হচ্ছে …

সারাদিনে আমরা যা চিন্তার খোরাক পেলাম, নতুন যেসব স্মৃতি জমা হলো সেসব কিছুই ঘুমের মাঝে প্রসেস হয়। আবার পরবর্তী দিনের স্মৃতি আর চিন্তার জন্যেও মস্তিষ্ক তৈরী হয়ে নেয় ঘুমের মাঝে। যারা পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমায় তারা বাকিদের থেকে নতুন কিছু দ্রুত শিখতে পারে, নতুন তত্য দ্রুত প্রসেস করতে পারে, এছাড়াও নতুন নতুন সমস্যা সমাধাণের জন্যও তোইরী হওয়া যায়। যারা ঠিকঠাক ঘুমায় তাদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনার বিকাশ বেশী ঘটে। তাই  নিজের সুস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় রেখে ঘুমের জন্য পর্যাপ্ত সময় বরাদ্দ রাখতে হবে।

তথ্যসুত্র :
1.Dreamland: Adventures in the Strange Science of Sleep by  David K. Randall
2. Sleep: a good investment in health and safety.

3.Sleep Duration and All-Cause Mortality: A Systematic Review and Meta-Analysis of Prospective Studies

4.Rare Genetic Mutation Lets Some People Function with Less Sleep


Comments are closed.