বিজ্ঞানের চোখে সব!

কোনাে কিছু দেখতে হলে দুটো জিনিস লাগে। এক হলাে আমাদের চোখ আর হলাে আলাে। যে বস্তুটি দেখতে চাই, সে বস্তু থেকে আলাে আসতে হবে, যে আলাে আমাদের চোখে পড়বে। তারপর চোখ থেকে সিগন্যাল এসে আমাদের মস্তিষ্কে দেখার অনুভূতি দেবে, এতেই দেখার বিষয়টি পূর্ণতা পায়।

তবে আমাদের চোখ সব ধরনের আলাে দেখতে পায় না। আমাদের দেখার অনুভূতির ওপর নির্ভর করে আলাের বিভিন্ন রঙের নাম দেওয়া হয়েছে, এগুলাে হলাে বেগুনি থেকে লাল। আলাের রং আলাের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা কম্পাঙ্কের ওপর নির্ভর করে। আমরা আলাের যে অংশটুকু দেখি, তা আলাের খুবই নগণ্য অংশ। এর বাইরেও আলাের অনেক তরঙ্গ আছে, যা আমাদের চোখে দেখতে পাই না (আসলে দেখি, একটু পরেই দেখার নতুন একটি সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে)। সে জন্য ওদের রংও জানি না (কিন্তু অন্যভাবে জানি)।।

এখন দেখার দিকে নজর দিই। সাধারণত গাছের পাতা দেখতে সবুজ হয়। ফুলের বিভিন্ন রং আছে—লাল, হলুদ, আকাশ দেখতে নীল ইত্যাদি। একটি বস্তুর রং কীভাবে নির্ধারিত হয়? এটা খুব সহজ। বস্তুর ওপর সাদা আলাে ফেললে বস্তুটি সাদা রং থেকে কিছু রং শুষে নেয় আর বাকিটা প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। যে রংগুলাে প্রতিফলিত হয়, সেগুলােই বস্তুর রং নির্ধারণ করে। বস্তুটি আলাের যে অংশ গ্রহণ করছে না, সেটুকুই বস্তুটিকে রাঙিয়ে দিচ্ছে।

যে ফুল থেকে আলাের লাল রংটা বেশি প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে, সে ফুলটার রং লাল দেখা যায়। কিন্তু বাতির ক্ষেত্রে অন্য হিসাব। টিউবলাইট থেকে সব রঙের আলাে বের হয় বলে টিউবলাইটের আলাে দেখতে সাদা হয়। সােডিয়াম লাইটের আলাে হলুদ হয়, কারণ এখান থেকে শুধু হলুদ আলাে বের হয়ে আসে।

আলাে ছাড়া কি আমরা দেখতে পাই না? আমাদের চোখ আলাে ছাড়া দেখতে পায় না। কিন্তু অন্ধকার ঘরে একটা শব্দ হলে কি বুঝতে পারি না, ওখানে একটা কিছু হচ্ছে! আমরা অবশ্যই বুঝতে পারি। এবং অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে আমরা হয়তাে  বলেও দিতে পারি কী হচ্ছে, যেমন কাচের গ্লাস বা বাটি মেঝেতে পড়ার শব্দ আমরা জানি। সে ক্ষেত্রে বলতে পারি, শব্দ দিয়েও আমরা দেখতে পাই। আচ্ছা, এবার ধরি শব্দও হলাে না, কিন্তু হাত দিয়েও তাে অনুভব করে বলতে পারি, কী ধরেছি। হয়তাে রংটা বলতে পারছি না, কিন্তু জিনিসটা কী, তা তাে বুঝতে পারছি, অর্থাৎ অন্যভাবে দেখতে পাচ্ছি! তার মানে হলাে, আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা কোনাে কিছু অনুধাবন করতে পারাই হলাে দেখা। এবার আলাের দিকে সামান্য একটু ফিরে যাই। শুরুতে বলেছি, আলাের খুব সামান্য অংশই আমরা দেখতে পাই। আসলে তা ঠিক নয়। আলাে নিয়ে কিছুটা পড়লেই আমরা আলাের পুরােটাই দেখতে পাই। আলাের শক্তির হিসাব থেকেই আলাে দেখতে পাই (তরঙ্গদৈর্ঘ্য অথবা কম্পাঙ্ক দিয়ে)। যেমন গামা রশ্মির শক্তি অনেক বেশি, আবার রেডিও ওয়েভের শক্তি অনেক কম। আমাদের চিন্তাতে আলাের এই তথ্য থাকার মানেই হলাে সব ধরনের আলােকে আমরা দেখতে পাই। একটি সাধারণ প্রশ্ন প্রায়ই আসে, আকাশ কেন নীল! খুবই সহজ এর উত্তর, বায়ুমণ্ডল দ্বারা নীল রঙের আলাের বিচ্ছুরণ বেশি হয় বলে।

মানুষের চোখের দৃষ্টিসীমা  

কারণ হিসেবে বলা হয় যে আলাের তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম, তার বিচ্ছুরণ তত বেশি (বায়ুমণ্ডলে আলাের বিচ্ছুরণ নির্ভর করে আলাের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চতুর্থ ঘাতের ব্যস্তানুপাতে)। শুধু এই কারণেই আকাশের রং নির্ধারিত হলে কিন্তু আকাশের রং বেগুনি হওয়ার কথা। কারণ, বেগুনি রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম। তার মানে শুধু বিচ্ছুরণের মাধ্যমে আকাশের নীল রং ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। পরিপূর্ণ ব্যাখ্যার জন্য দরকার আরও একটি বিষয়, আর তা হলাে সূর্য থেকে কোন রঙের আলাে কত পরিমাণে আসে এবং কোন রঙের আলাে কতটা বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। আমাদের আলাের প্রধান উৎসই হলাে সূর্য। যদি সূর্য থেকে সমপরিমাণে সব রঙের আলাে আসত এবং সব রঙের আলােই সমহারে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করত, তাহলে আকাশ বেগুনি দেখার কথা। বাকিটা নিজের ভাবনার জন্য রেখে দেওয়া হলাে। আর সূর্যের যে বেশির ভাগই হাইড্রোজেন, তা কীভাবে দেখলাম? অথচ সূর্য কত দূরে! সূর্য ছাড়া আরও দূর নক্ষত্রেও কী আছে, তা-ও পথিবীতে বসেই বলে দেওয়া যায়, অর্থাৎ দেখতে পাওয়া যায়!

এখন বলার চেষ্টা করব ছােট জিনিস দেখা নিয়ে। খুব ছােট জিনিস দেখার জন্য মাইক্রোস্কোপ আছে। কিন্তু একটি বিশেষ মাত্রার ছােট হলে মাইক্রোস্কোপ দিয়েও দেখা যায় না। ভালাে একটি উদাহরণ হলাে পরমাণু বা অ্যাটম। পরমাণুকে আমরা চোখ বা মাইক্রোস্কোপ, কোনাে কিছু দিয়েই দেখতে পাই না। একসময় ধরা হতাে পরমাণুকে ভাঙা যায় না। কিন্তু রাদারফোর্ডের পরীক্ষা আর কোয়ান্টাম মেকানিকস ব্যবহারে এখন পরমাণুকে খুবই স্পষ্ট করে দেখা যায়। পরমাণুর ভেতরে একটি নিউক্লিয়াস আছে আর চারদিকে ইলেকট্রনের মেঘ আছে। এমনকি পরমাণুর ভেতরে একটি ইলেকট্রনের কত কত শক্তি থাকতে পারে, তা-ও গাণিতিকভাবে খুবই সুন্দর করে বােঝা যায়, পরীক্ষার মাধ্যমে যার প্রমাণও আছে। এখন আমরা জানি, একটি প্রােটন বা নিউট্রনের ভেতরে কোয়ার্ক নামে কিছু ক্ষুদ্রতর কণা আছে, যা প্রােটন বা নিউট্রনের বাইরে পাওয়া যায় না। এগুলােও জানা গেছে গণিত এবং কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে।

পরমাণু বা অ্যাটম

দেখা বিষয়ে দৈনন্দিন জীবনের একটি উদাহরণ দিই। ব্যাটারির সঙ্গে যুক্ত করলে তামার তারের ভেতর দিয়ে কারেন্ট চলে। এই কারেন্ট কি আমরা দেখতে পাই? হ্যাঁ, দেখতে পাই, কিন্তু আমাদের চোখ দিয়ে নয়, বরং আমার চিন্তা দিয়ে। আমরা জানি, তামার তারের ভেতরে মুক্ত আধান আছে। ব্যাটারির বিভব পার্থক্যের কারণে এই মুক্ত আধান চলতে শুরু করে, যা কিনা কারেন্ট। কী ধরনের আধানের চলাচলে কারেন্ট তৈরি হয়? Hall Effect- এর মাধ্যমে দেখতে পেলাম, তামার তারে ঋণাত্মক আধানের চলাচলের জন্য কারেন্ট তৈরি হয়, এই ঋণাত্মক আধান আর কিছু নয়, আমাদের অতিপরিচিত ইলেকট্রন। একটু বিজ্ঞান পড়লে মােটামুটি সবাই ইলেকট্রনকে জানি, কিন্তু কেউই কখনাে ইলেকট্রনকে চোখে দেখিনি। একইভাবে সেমিকন্ডাক্টর এবং সুপারকন্ডাক্টরে কীভাবে কারেন্ট চলে, তা-ও আমরা দেখতে পাই, অবশ্যই চোখে না, আমাদের চিন্তাশক্তি দিয়ে আমাদের কল্পনায় এগুলাে দেখতে হয়, যার পেছনে আছে গণিত এবং বিশেষ কিছু পরীক্ষা।

এখানে দেখার জন্য গণিতের শক্তির একটু নমুনা দেওয়া যাক। ডিরাক সমীকরণ থেকে দেখতে পাওয়া গেল পজিট্রন। অথচ পজিট্রন বলে তখন কেউ কিছু জানে না। কিন্তু ঠিকই কয়েক বছর পর এই পজিট্রন পাওয়া গেল। বােস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান থেকে দেখানাে হলাে, খুব অল্প তাপমাত্রায়। (মাইক্রো কেলভিনেরও নিচে) বােসনের একটি বিশেষ রূপ থাকবে, যাকে বলে বােস-আইনস্টাইন কনডেনসেট। পদার্থের এই বিশেষ অবস্থা গাণিতিকভাবে ১৯২৪ সালের দিকে দেখানাে হলেও পরীক্ষাগারে ধরা পড়েছে ১৯৯৫ সালে।

পৃথিবীর ভেতরের কী অবস্থা, তা-ও কিন্তু আমরা দেখতে পাই। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে কেন্দ্রের দিকে যেতে থাকলে দু-একশ কিলােমিটার পর থেকেই লােহা ও নিকেলের স্তর শুরু হয়ে যায়, যা প্রথমে কঠিন, তারপর তরল এবং একেবারে কেন্দ্রের কয়েক শ কিলােমিটার আবার কঠিন। এটা কীভাবে দেখতে পেলাম (Seismic Wave)?

সৌরজগৎ কি একসঙ্গে কেউ দেখেছি? আমাদের কেউই সৌরজগৎ একসঙ্গে দেখিনি, আমাদের পক্ষে এভাবে দেখা সম্ভবও না। কিন্তু আমরা জানি, সৌরজগতে কতগুলাে গ্রহ আছে, গ্রহগুলাে সূর্য থেকে কত দূরে আছে, একটি গ্রহের কতগুলাে উপগ্রহ আছে। এই জানাটার মানেই হলাে দেখা। ঠিক একইভাবে আমরা দেখতে পাই, এই মহাবিশ্বে গ্যালাক্সি আছে। পুরাে মহাবিশ্ব সম্পর্কেই বিজ্ঞান আমাদের একটি ধারণা দিয়ে রেখেছে, অর্থাৎ আমরা পুরাে মহাবিশ্বকেই দেখতে পাই।

শুধু কি তা-ই? মহাবিশ্বের শুরু সম্পর্কেও বিজ্ঞান আমাদের একটি ধারণা দিয়েছে। ধারণা করা হয়, প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি বছর আগে আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম। জন্মের পর থেকে কীভাবে মহাবিশ্ব এই বর্তমান অবস্থায় এল, তারও বিভিন্ন ধারণা দেওয়া আছে। তার মানে কি মহাবিশ্বের জন্মের ঘটনাও আমরা দেখতে পাচ্ছি, যা আসলে ১ হাজার ৪০০ কোটি বছর আগের ঘটনা! এগুলাে সবই সম্ভব হয়েছে গণিত এবং বিশেষ বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে। সম্প্রতি তিনটি বিশেষ দেখা নিয়ে লেখাটি শেষ করছি।

হিগস-বােসন দেখতে পেলেন ২০১৩ সালে, যাপিটার হিগসসহ আরও কজন বিজ্ঞানী গাণিতিকভাবে দেখতে পেয়েছিলেন ১৯৬৪ সালের দিকে। হিগস-বােসন দেখা আর ইলেকট্রন দেখা কিন্তু এক রকম নয়। হিগস-বােসন দেখার অনেক জটিলতা আছে, যা সম্ভব হয়েছে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের কারণে। এই শতকের অনেক বড় একটি আবিষ্কার হলাে মহাকর্ষ তরঙ্গ দেখতে পাওয়া, যা আইনস্টাইন গণিতের মাধ্যমে দেখতে পেয়েছিলেন ১৯১৬ সালের দিকে। তার প্রায় ১০০ বছর পর ২০১৬ সালে তা বাস্তবেই দেখা গেল। এর সঙ্গে বিজ্ঞান দেখতে পেল দুটো ব্ল্যাকহােলের নাচ, প্রায় ১৩০ কোটি বছর আগে খুব অল্প সময়ের জন্য দুটো ব্ল্যাকহােল নাচতে নাচতে (ঘুরপাক খেতে খেতে) এক হয়ে যায়।

এবং এই ঘটনা থেকেই বের হয়ে আসে মহাকর্ষ তরঙ্গ। সেই তরঙ্গ ধরা পড়ে লাইগাে নামের যন্ত্রটিতে। মহাকর্ষ তরঙ্গ—যা কিনা সবকিছুর ভেতর দিয়েই যেতে পারে। বিজ্ঞান অচিরেই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরও ভালাে এবং স্পষ্টতর ধারণা দিতে পারবে, এমনকি মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কেও বিজ্ঞানের ধারণা স্পষ্ট হবে। সহজভাবে বললে মহাবিশ্ব এবং এর জন্ম দুটোই আরও পরিষ্কারভাবে আমরা দেখতে পাব। আর লাইগাের সূক্ষ্মতা এত বেশি যে এই যন্ত্রের সাহায্যে আমরা এখন একটি প্রােটনের মিলিয়ন ভাগের মতাে ছােট দূরত্ব অনুধাবন করতে পারি (আসলে দেখতে পারি।

শেষ দেখার ঘটনা হলাে কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তােলা। কী আশ্চর্য! প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি আলােকবর্ষ দূরের একটি কৃষ্ণগহ্বর, যার ভর সূর্যের চেয়ে কয়েক বিলিয়ন গুণ বেশি এবং আকার পৃথিবীর চেয়ে মিলিয়ন গুণ বেশি, বিজ্ঞানের জগতে বর্তমানে এটা খুব আলােচিত এক বিষয়। কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তুলতে বা একে দেখতে কৌতূহলের অন্ত ছিল না। বিজ্ঞান, গণিত, টেলিস্কোপ, কম্পিউটার এলগরিদম—কী নেই এর সঙ্গে! সে জন্য সব শেষে বলতে চাই, সম্যক উপলব্ধির মানেই যদি দেখা হয়, তাহলে বলা যায়, দেখার জন্য গণিত ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী চোখ। অতি ক্ষুদ্র পরিসরে এ দুটো সবচেয়ে সূক্ষ্মতম মাইক্রোস্কোপের চেয়েও সূক্ষ্ম ও বৃহৎ পরিসরে। সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপের চেয়েও শক্তিশালী এবং গণিত ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার পেছনে থাকে মানুষের ভাবনা ওকল্পনা।

Comments are closed.