বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেলেন পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো বস্তু যার বয়স আমাদের সৌরজগত থেকেও বেশি!

ধরুন আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। হোঁচট খেলেন এক খন্ড শিলায়। কৌতূহলবশত সেটি পরীক্ষা করতে গিয়ে জানলেন সেই শিলায় অবস্থিত কোনো এক উপাদানের বয়স পৃথিবী ছাড়িয়ে সৌরজগতের চেয়েও বেশি! ব্যাপারটা ঠিক ভুতুড়ে না?

সম্প্রতি এমনই কিছু খুঁজে পাওয়া গেছে পৃথিবীর বুকে, যার বয়স আমাদের সৌরজগতের চেয়েও কয়েকশ মিলিয়ন বছর বেশি! বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন খুবই ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক মাটিচূর্ণ অথবা ধুলি কণা বলা যায় যার বয়স ধারণা করা হচ্ছে ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন বছরের মধ্যে। অথচ আমাদের সূর্যের বয়স মাত্র ৪.৬ বিলিয়ন বছর। প্রশ্ন হলো এই অতি ক্ষুদ্র কণাগুলো কীভাবে পৃথিবীতে এলো? খুবই সহজ উত্তর, বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উল্কাবর্ষণ হয়। এই কণাটি এরকমই কোনো এক উল্কা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
“এটা আমার জীবনের সেরা কিছু উত্তেজনা পূর্ণ রিসার্চগুলোর মধ্যে একটি”, বলেন কসমোক্যামিস্ট Phillip Heck যিনি University Of Chicago এর Museum of Natural History বিভাগে কাজ করছেন। তিনি আরো বলেন যে, ” এটিই পৃথিবীর মধ্যে পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো ধাতব কোনো পদার্থ যা আমাদের ধারণা দেয় গ্যালক্সির অভ্যন্তরীণ তারা গুলো কীভাবে গঠিত হয়েছিল।”

অবশ্য এইরকম রহস্যময় পুরোনো বস্তুগুলো উল্কার মাধ্যমে পৃথিবীতে আসার নজির আগেও দেখা গিয়েছে। তবে সেগুলো এতোটাই সূক্ষ্ম আর জটিল যে খুব গভীরভাবে শিলায় লেগে থাকে এবং খুঁজে বের করাও কঠিন। এসব দানাদার পদার্থগুলো কে বলা হয় “Presolar Grains”. এরকম একটি উল্কা পাওয়া যায় যেটা বহন করেছিল ” Presolar Grains” (Presolar Grain হলো সে সকল আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূলির দানা যা আমাদের সূর্যের গঠনের আগে মহাকাশে বিচরণ করত)।

Murchison Meteorite নামক এই উল্কাটির ভর ছিল ১০০ কিলোগ্রাম। ১৯৬৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার Murchison এর আকাশে বিস্ফোরিত হয়। The Field Museum এ রক্ষিত ছিল প্রায় ৫২ কিলোগ্রাম Murchison Dust. দীর্ঘসময় ধরে বিজ্ঞানীরা এটি নিয়ে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এই উল্কাপিণ্ডের অভ্যন্তরে ছিল বিপুল পরিমাণ আণুবীক্ষণিক খনিজ যাদের বলা হয় সিলিকন কার্বাইড। এই বস্তুগুলোর উপস্থিতি দেখেই নিশ্চিত হওয়া যায় সেগুলো আন্তঃনাক্ষত্রিক এবং অন্য অর্থে Presolar! তবে সেই সময় অর্থাৎ ১৯৯০ সালে সেগুলোর একেবারে নির্দিষ্ট কোনো বয়স বের করা কঠিন ছিল এবং যন্ত্রপাতিও আধুনিক ছিল না।

এইসকল সিলিকন কার্বাইড সেই ১৯৯০ সালেই আলাদা করা হয়ে গেছিল উল্কা থেকে। উল্কাপিণ্ডকে পিষে পাউডারের মতো তৈরি করে সেখানে এসিড মিশিয়ে বাদ দেয়া হয় সিলিকাকে। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতি, অণুবীক্ষণ যন্ত্র না থাকায় বিজ্ঞানীদের বিশেষ বেগ পেতে হয়। তাঁরা সঠিকভাবে তখন দানাগুলো বিশ্লেষণ করতে পারেননি।
তাই Heck এবং তাঁর দল ঠিক করলেন প্রাপ্ত দানাগুলোর যতরকম সম্ভব বিশ্লেষণধর্মী পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে একটি ফলাফল বের করা যায়। এজন্য তিনি ব্যবহার করেন scanning electron microscopy, secondary ion mass spectrometry and noble gas mass spectrometry যেগুলোর একধরনের মহাজাগতিক রশ্মি বিকিরণের মাধ্যমে উল্কাপিণ্ডের ভেতরে অবস্থিত দানাদার সিলিকন কার্বাইড গুলোকে শনাক্ত করতে পারে৷ যতোবেশি সময় ধরে এই কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি ক্রিয়া করে তত বেশি সময় ধরে সিলিকন কার্বাইড উৎপন্ন হয়ে দৃশ্যমান হয়৷ Heck ব্যাপারটা এইভাবে তুলনা করেন যে আপনি যদি একটি বালতিকে বৃষ্টির মধ্যে নিয়ে রাখেন, এখানে বৃষ্টির পানির পরিমাণ ধ্রুবক হলে যতক্ষণ বালতিটি রাখবেন ততক্ষণ ধরে বালতিটি পানি দ্বারা পূর্ণ হবে। একই উপায়ে যতক্ষণ ধরে রশ্মির বিকিরণ চলবে ততক্ষণ ধরেই সিলিকন কার্বাইড দৃশ্যমান হতে থাকবে। মোট ৪০ টি সূক্ষ্ম দানাদার সিলিকন কার্বাইড সনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে Neon- 3 এবং Helium- 21 আইসোটোপ যা নির্ধারণ করবে সেগুলোর বয়স। যার মধ্যে কিছু দানা প্রায় সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন বছর পুরোনো আর বেশিরভাগই ৪.৬ থেকে ৪.৯ বিলিয়ন বছর পুরোনো। মানে আমারের সূর্যের বয়সের সমান! এই পরীক্ষা ধারণা দেয় আমাদের মিল্কিওয়ের অভ্যন্তরীণ নক্ষত্রগুলো কীভাবে গঠিত হয়েছিল। যে নক্ষত্র থেকে সেগুলো পাওয়া গিয়েছে সেটিও প্রায় ৭ বিলিয়ন বছর আগে গঠিত হয়েছিল৷ তারাগুলোর যখন বিবর্তনের প্রায় শেষ মুহূর্ত চলছিল তখন ঘনীভূত অবস্থায় বিভিন্ন পদার্থ মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেগুলোরই একটি অংশ হচ্ছে এই ধূলি দানা। পরবর্তীতে তা Murchison উল্কাতে কোনো একভাবে স্থান দখল করে নেয় এবং বহুকাল এভাবে বিচরণ করার পর আমাদের পৃথিবীতে পৌঁছায়। Heck আরো বলেন যে,” এই গবেষণা এবং আবিষ্কার তারাদের বিবর্তন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দে। কেউ কেউ ভাবত যে নক্ষত্রের গঠন/ জন্ম ধ্রুবক অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময় ধরেই হয়েছে। কিন্তু এই দানাগুলো প্রমাণ করে যে বিভিন্ন সময় নক্ষত্রের জন্ম এবং বিবর্তন ঘটেছে। এবং এটিই অনুসন্ধানটির প্রধান প্রাপ্তি।”
Source: sciencealert, PNAS

Comments are closed.